আগুনে প্রাণ যায়৷ প্রশাসন প্রতিশ্রুতি দেয়৷ তারপর আবার সব আগের মতোই হয়ে যায়৷ এটাই রাজনীতির নিয়ম৷ খেলাও বলা যায়৷
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের এক মন্ত্রীবরের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক আড্ডা মারার সুযোগ হয়েছিল৷ একথা সেকথায় হঠাৎই আগুনের প্রসঙ্গ উঠে এলো৷ বাংলাদেশের সীতাকুণ্ডের আগুনের পরিপ্রেক্ষিতেই প্রসঙ্গের জন্ম৷ মন্ত্রী মহোদয় আগুন, থুড়ি দমকলমন্ত্রী নন৷ আগুনে কত মানুষের মৃত্যু হয়, সেই অনুতাপ করতে করতেই আচমকা বলে বসলেন, ‘‘যতই চেষ্টা করুন, আগুন কি আর আটকানো যায়? আগুন হলো স্বয়ং অগ্নিদেব! সভ্যতার সেই শুরু থেকে আগুন ভয় মানুষ৷ পুজোও করে৷’’
বটেই তো! এমন দার্শনিক সমাপতন মনে ধরে রাখতে পারলে তবেই না মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়া যায়! পাল্টা বাক্যে মন্ত্রীবাবুকে এই বাক্যটি বলে উঠে পড়া গেল৷ ভেবে নিতে অসুবিধা হলো না, এর পর কলকাতায় কোথাও আগুন লাগলে এমনই ভাবতে ভাবতে তিনি নিশ্চয় সেখানে গিয়ে পৌঁছাবেন এবং মনের কথা পকেটে রেখে প্রতিশ্রুতি দেবেন, ‘‘এমন আগুন আর কখনো লাগবে না৷ প্রশাসন সবরকম ব্যবস্থা নেবে৷ এবং তারপরই বুক ঠুকে কিছু ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে দেবেন৷’’
আগুনের হাত থেকে বাঁচতে কলকাতার বাজারে যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে
গত কয়েক বছরে কলকাতার নন্দরাম, বাগরি, হাতিবাগান, শিয়ালদহ, বেহালা সহ বেশ কয়েকটি বাজারে আগুন লাগে। সেরকম কয়েকটি বাজারে ঘুরে আগুন প্রতিরোধের ব্যবস্থা দেখল ডিডাব্লিউ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
গড়িয়াহাট বাজারের অবস্থা
দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম প্রধান বাজার হলো গড়িয়াহাট মার্কেট। সেখানে বাজারে আগুন প্রতিরোধের জন্য কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বাজারের একাংশের মেন সুইচের কাছে রাখা হয়েছে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, যা আগুন লাগলে প্রাথমিকভাবে ব্যবহার করা হয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিপজ্জনক তার
গড়িয়াহাটে সবজির বাজারে বিপজ্জনকভাবে তার নেয়া হয়েছে। এর ফলে আগুন লাগার সম্ভাবনা বাড়ে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
হাতিবাগান বাজারের হাল
কিছুদিন আগেই আগুন লেগেছিল হাতিবাগান বাজারে। তারপর আগুনের মোকাবিলায় কিছু ব্যবস্থাও নেয়া হয়। কিন্তু মাছের বাজারে দেখা যাচ্ছে, বিপজ্জনকভাবে তার টানা হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের একান্ত অভাব। সচেতনতারও।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অবহেলায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র
হাতিবাগান বাজারের ছবি। অত্যন্ত অবহেলায় ফেলে রাখা আছে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলি। বাঁশ দিয়ে তার উপর ব্যাগ, থার্মোকলের বাক্স রাখা রয়েছে। যন্ত্রগুলির চেহারা দেখলে সংশয় জাগে, কাজের সময় সেগুলি চালু করা যাবে তো!
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ব্যবস্থা আছে
হাতিবাগান বাজারে বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখা আছে। এই যন্ত্রের অবস্থা তাও তুলনামূলকভাবে ভালো।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বাগরি মার্কেট
বাগরি মার্কেটে কিছদিন আগে আগুন লেগেছে। তারপর বাজারের ভিতরে অন্তত সচেতনতার ছবি দেখা যাচ্ছে। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের অবস্থা ভালো।
বাগরি মার্কেটের বাইরের ছবি। ছোট গলি। তার অনেকটাই দোকানদারদের অধিকারে চলে গেছে। আর উপরে তাকালেই দেখা যাবে তারের জঙ্গল। বিপজ্জনক অবস্থা। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মানিকতলা বাজার
কলকাতার অন্যতম পুরনো বাজার। সেখানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার লাগানো হয়েছে ঠিকই, পাশে তারের জঙ্গলের ছবিও দেখা যাচ্ছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আছে প্রাথমিক ব্যবস্থা
মানিকতলা বাজারে আগুন নেভাবার প্রাথমিক ব্যবস্থা আছে। আগুন নেভানোর যন্ত্রের পাশাপাশি বালি ভর্তি বালতিও আছে। ছোট আগুন নেভাতে যা কাজে লাগে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শোচনীয় পরিস্থিতি
মানিকতলা বাজারের এই অংশটার দিকে তাকালেই দেখা যাবে, পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে তার নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিভিন্ন দোকানে। দেখলেই ভয় লাগে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
নন্দরাম মার্কেটে
নন্দরাম মার্কেটও একাধিকবার আগুন লেগেছে। তারপর এখন সেখানে তারগুলিকে ঠিক করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা
নন্দরাম মার্কেটের এই অংশে আগুন নেভানোর আধুনিক ব্যবস্থা চালু আছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ছাতুবাবুর বাজারে
ছাতুবাবুর বাজার হলো উত্তর কলকাতার একটি পরিচিত বাজার। সেখানে আগুন প্রতিরোধের প্রাথমিক ব্যবস্থা আছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
14 ছবি1 | 14
এ কথা সত্য যে, পুরনো কলকাতার বাজারগুলিকে আধুনিক করে তোলা কঠিন কাজ৷ কয়েকশ বছরের পুরনো বাজার-দোকান-গলি রাতারাতি পাল্টে ফেলা কঠিন৷ সকলেই জানেন, বড়বাজারের বিশাল বিশাল মার্কেটগুলিতে আগুন লাগলে দমকল সেখানে ঢুকতেই পারে না৷ ৪৮ ঘণ্টা ধরে আগুন জ্বলেছে এই বড়বাজারেরই নন্দরাম মার্কেটে৷ কলকাতা সে দৃশ্যও দেখেছে৷ ওই ঘটনার পর তৎকালীন প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তা অধম সাংবাদিককে বলেছিলেন, বড়বাজারের গলি বদলানো যাবে না, কিন্তু দমকলের পরিকাঠামো বদল করা সম্ভব৷ গলিতে ঢুকে আগুনের সঙ্গে লড়াই করার যন্ত্র এখন আছে৷
দশক আগের সেই ঘটনার পর দমকলের পরিকাঠামোয় কোনো উন্নতি হয়নি, এমনটা বলা যায় না৷ কিন্তু সরকারের মানসিকতা বদলায়নি, একথা বলাই যায়৷ এবং সেকারণেই বাজারগুলির লোক দেখানো কিছু উন্নতি হয়, কিন্তু কাজের কাজটি হয় না৷ একের পর এক আগুনের পরে সরকার বলেছিল, কলকাতার পুরনো বাজারগুলির সংস্কার হবে৷ হয়েছে৷ নীল-সাদা রং হয়েছে৷ কোথাও কোথাও খোলা তার কেসিং করা হয়েছে৷ কিন্তু নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না৷ যে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলি দেওয়ালে ঝোলানো আছে, সেগুলি কাজ করে কি না, সময়মতো বদলানো হচ্ছে কি না, তা দেখার লোক নেই৷ তথৈবচ অবস্থা আপৎকালীন পালানোর দরজাগুলির৷ দিব্যি সেখানেও বাজার বসে গেছে৷ এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি৷ অগ্নিদেবতার ভরসায় না থেকে মন্ত্রী মহোদয়রা যদি সেই বিষয়গুলি দেখতেন, তাহলে অগ্নিদেব হয়তো বা রুষ্ট হয়ে রোষানলে বিদ্ধ করতে পারতেন না!
এখানেই শেষ নয়৷ সীতাকুণ্ডের গুদামে আগুন লাগার পর একটি প্রশ্ন উঠেছে৷ সেখানে যে রাসায়নিক মজুত করা হয়েছিল, সে খবর প্রশাসনের কাছে লুকানো হয়েছিল৷ দমকলকর্মীরাও জানতেন না ভিতরে রাসায়নিক৷ এবং সে কারণেই আগুন নেভাতে গিয়ে বেশকয়েকজন দমকলকর্মীর মৃত্যু হয়েছে৷ বাংলাদেশের এই তথ্য গঙ্গাপারেও একইরকম৷ দিনের পর দিন ট্যাংরায় ঠিক এই কারণেই তো আগুন লাগতে থাকে৷ বসত বাড়ির ভিতরে রাসায়নিক মজুত করা হয়৷ প্রশাসন জানে না? নিশ্চয় জানে৷ কিন্তু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হয় না৷ রাজনীতির দাদা-কাকা, ঘুষের স্নেহছায়াতলে দিব্যি বেআইনি কাজ আইনসিদ্ধ হয়ে চলেছে৷ সকলের ঘরে তো আর আগুন লাগছে না, যখন লাগছে, প্রশাসন তখন নড়েচড়ে বসছে৷
দায় কেবল প্রশাসন বা সরকারের নয়৷ দায় আমাদের সকলের৷ আমরা ভুলে যাই, সামান্য স্ফুলিঙ্গ প্রাণঘাতক হয়ে উঠতে পারে৷ সেসব উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে ভুরি ভুরি৷ কিন্তু আইন ফাঁকি না দিলে নাকি ব্যবসা হয় না৷ এটাই আমাদের মানসিকতা৷ আর সেই মানসিকতার উপর দাঁড়িয়ে আছে প্রশাসন৷ আগুন ঠেকায়, কার সাধ্যি?
গত মার্চের ছবিঘরটি দেখুন...
ট্যাংরার বিধ্বংসী আগুন এখন নিয়ন্ত্রণে
শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ আগুন দেখতে পাওয়া যায় ট্যাংরার তিন নম্বর মেহের আলি লেনে। আগুন এখন নিয়ন্ত্রণে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
গুদামে আগুন
একটি ওয়াটারপ্রুফ কাপড়ের গুদামে আগুন লাগে। দমকল জানিয়েছে, গুদামের ভেতরে দাহ্য বস্তু মজুত ছিল। প্রাথমিক অনুমান, গুদামে ওয়েল্ডিং কাজ চলছিল, সেখান থেকে আগুনের ফুলকি ছিটে এই দুর্ঘটনা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী
কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন গোটা গুদাম গ্রাস করে নেয়। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে পড়ে আকাশে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ঘটনাস্থলে দমকল
দমকলের ১৫টি ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে ছিল। রবিবার পর্যন্ত দমকলের ১৫টি ইঞ্জিন ও ৭টি ওয়াটার জেট আগুন নেভানোর কাজ করেছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ঘিঞ্জি এলাকা
গুদামটি ঘিঞ্জি জনবসতিপূর্ণ এলাকায় হওয়ায় দমকলের ইঞ্জিন ঢুকতে পারছিল না। আগুন নেভাতে গিয়েও হিমশিম খেতে হয় দমকলকর্মীদের। দুই জন দমকলকর্মী আহত হন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
এলাকায় আতঙ্ক
অগ্নিকাণ্ডের জেরে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশের বাড়ি এবং বহুতলগুলি খালি করে দেন দমকলকর্মীরা। স্থানীয় যুবকেরাও সাহায্যে এগিয়ে আসে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ঘটনাস্থলে রাজনীতিবিদরা
দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু, উত্তর কলকাতার সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনাস্থলে পৌঁছান।
রবিবার দুপুরেও এলাকা ছিল থমথমে। স্থানীয় মানুষজনের মধ্যে আতঙ্কের ছায়া। মগরীবের নামাজ পড়া শেষ করে মসজিদ থেকে মুস্তাকিন বেরিয়েই দেখে পাশের গুদাম থেকে হু হু করে আগুনের শিখা বের হচ্ছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ভাঙা হচ্ছে গুদাম
পে-লোডার দিয়ে ভেঙে ফেলা হয় গুদামের ভিতরের দিকের দেওয়াল। ভেঙে ফেলা হবে আগুনের তাপে ফাটল ধরা বাইরের দিকের পাঁচিলটিও।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কীভাবে চলছে গুদাম
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন ঘিঞ্জি এলাকায় কীভাবে দিনের পর দিন চলছিল গুদাম? কোনও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না।