বহুল প্রচলিত একটা গল্প৷ এক লোকের পিঠে আগুন লেগে যায়, কিন্তু সে এতটাই অলস যে, তার পিঠ পুড়ে গেলেও সে নিজেকে না বাঁচিয়ে ফিরে শুয়ে থাকে, অতঃপর মৃত্যুই হয় তার।
বিজ্ঞাপন
মোদ্দা কথা হলো, নিজের অবস্থার পরিবর্তনে নিজেকেই এগিয়ে আসতে হয়। আমাদের দেশের ক্রিকেটের এখন এই হাল। সবাই সব দেখছে, বুঝছে, কিন্তু কেউ ঘুরে দাঁড়িয়ে অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টাটুকু করছে না।
দেশ-বিদেশ যেখানেই বাংলাদেশের খেলা হোক না কেন,আজকাল সমর্থকের কোনো কমতি হয় না, নিজের দেশকে, দেশের ক্রিকেটারদের সমর্থন দিতে হাজির হন লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে। আর সোশাল মিডিয়া তো আছেই। এই যে কিছুদিন আগেই পাকিস্তানের মাটিতে ওদেরকেই ধবল ধোলাই করলো, ইতিহাস লিখলো…পুরো বাংলা এক হয়ে জয়গান গাইলো শান্ত-মিরাজদের। বলা হচ্ছিল জেনজিদের আত্মত্যাগে পাওয়া নতুন বাংলাদেশ মাতলো নতুন উৎসবে। জেনজি বলতেই মনে হলো এই জেনারেশন তো দেখেইনি, বাংলাদেশ ম্যাচ জিতলে কিভাবে সেলিব্রেট করতো নব্বই দশকে বেড়ে ওঠা জেনারেশন, অর্থাৎ মিলেনিয়ালরা। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়, দুই বছর বাদে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানকে হারায়, তখন পুরো দেশ সেজেছিল রঙ্গিন উৎসবে। ওই জয়গুলোই তো বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিল ওয়ানডে আর টেস্ট স্টেটাস । ক্রিকেট বিশ্বে ওঠে বাংলাদেশ নামে নতুন একটা সূর্য ।
সময় পেরিয়ে আজ দুই যুগেরও বেশি, কতটা এগুলো দেশের ক্রিকেট? এই প্রশ্ন উঠলেই শুনতে পাওয়া যায় কেবলই দীর্ঘশ্বাস। নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল, এশিয়া কাপের ফাইনাল, কিংবা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল… প্রতিবারই আফসোসের আগুনে পুড়ে, চোখের জলে বাড়ি ফেরা। বারবারই মনে হওয়া- ইশ, দিনটা যদি আমাদের হতো!
ক্রিকেটে কেন পারছে না বাংলাদেশ?
প্রায় দুই যুগের টেস্ট ও তার চেয়েও বেশি ওয়ানডে ক্রিকেটের অভিজ্ঞতার পরও বাংলাদেশের ক্রিকেটের বড় কোনো অর্জন নেই৷ এখনো ক্রিকেটাররা ‘বড় দলের’ সঙ্গে খেলতে গেলে খাবি খান৷ কেন পারছি না আমরা?
ছবি: R. Satish BabuAFP
কোথায় বাংলাদেশের ক্রিকেট?
বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন কোথায় দাঁড়িয়ে? পুরুষদের ক্রিকেটে এশিয়া কাপ জয়ের খুব কাছাকাছি গিয়েও হোঁচট খেয়েছে তারা৷ ওয়ানডেতে কখনো কখনো কিছুটা ধারাবাহিক সাফল্য দেখা গেলেও টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে তার খুব অভাব৷ সেদিক থেকে নারীরা ২০১৮ টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপ জিতে একমাত্র আন্তর্জাতিক শিরোপা ঘরে এনেছে৷ কেন এই অবস্থা? ডয়চে ভেলে কথা বলেছে ঘরোয়া ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে৷
ছবি: DW
‘ভালো মানের কোচ পাচ্ছি না’
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও তারকা ক্রিকেটার মোহাম্মদ আশরাফুলের মতে, ভালো ব্যাটসম্যান হতে হলে বিভিন্ন ধরনের উইকেটে, ভালো মানের উইকেটে এবং ভালো মানের বোলারের বিপরীতে প্র্যাকটিস করতে হবে৷ এই তারকা ক্রিকেটার বলেন, ‘‘আগে বাংলাদেশে কোচিংয়ের মান ভালো ছিল৷ গত ১৫ থেকে ১৭ বছর আমরা ভালো মানের কোচ পাচ্ছি না৷’’
ছবি: DW
‘ভালো মানের ক্রিকেট অ্যাকাডেমি জরুরি’
ব্যাটসম্যান মো. সাজ্জাদ হোসেন হিমেলের মতে, ‘‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস ব্যাটসম্যান হতে হলে প্রথমত দরকার ভালো মানের একাডেমি এবং ভালো মানের কোচ৷’’ ক্রিকেট কর্তৃপক্ষকে ভালো মানের অ্যাকাডেমি প্রস্তুতে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি৷ তিনি বলেন, যে বিভাগে আন্তর্জাতিক মানের ঠ রয়েছে সে বিভাগের ক্রিকেটাররা ভালো সুবিধা পাচ্ছেন৷ অন্যান্য বিভাগে তেমন সুবিধা নেই৷
ছবি: DW
‘বড় মাঠের অভাব’
সাজ্জাদের মতো একই কথা বললেন জাতীয় দলের ব্যটসম্যান তাজ নেহার৷ ভাল মানের অ্যাকাডেমি তৈরিতে মনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি ডয়চে ভেলেকে এই নারী ক্রিকেটার আরো বলেন, ‘‘আমাদের দেশে অ্যাকাডেমির সংখ্যা খুবই কম৷ মানসম্মত পিচ, নেট এবং অন্যান্য অনুশীলন সুবিধা একজন ব্যাটসম্যানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ আমাদের বড় মাঠের অভাব, ভালো মানের কোচের আন্ডারে প্র্যাকটিস করলে এবং নিয়মিত চর্চা করলে উন্নয়ন করা সম্ভব৷’’
ছবি: DW
‘ফাস্ট বোলার তৈরির উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন’
ফাস্ট বোলার হতে হলে প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম, বললেন তানিয়া আক্তার৷ অলরাউন্ডারর ও ফাস্ট বোলার তানিয়া আক্তারের মতে, সুযোগ-সুবিধার অভাবে নারী ক্রিকেটারেরা পিছিয়ে থাকেন৷ তার মতে, নিয়মিত জিম করার সুবিধা, ভালো মানের কোচ এবং টুর্নামেন্টের আয়োজন করা জরুরি৷ তাছাড়া মেয়েদের জন্য নিয়মিত ক্যাম্প করারও পরামর্শ দেন তিনি৷
ছবি: DW
‘ফাস্ট বলের কৌশল শেখাতে হবে’
ফাস্ট বোলার ও অলরাউন্ডার মো. সানাউল্লাহর মতে, বিশ্ব মানের বোলার হতে প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম৷ প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে আয়োজন করতে হবে৷ একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ বোলিং কোচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ কোচ একজন বোলারকে তার দুর্বলতাগুলো শনাক্ত করতে, নতুন বল নিয়ে কাজ করতে এবং বিভিন্ন ধরনের পিচে বল করার কৌশল শিখতে সাহায্য করে৷
ছবি: DW
‘অনুশীলনে আধুনিকতা জরুরি’
স্পিনার, অলরাউন্ডার মহাদেব রায়ের মতে, একজন ভালো মানের অলরাউন্ডার হতে হলে লক্ষ্য ঠিক রেখে প্র্যাকটিস করে এগিয়ে যেতে হবে৷ তিনি বলেন, এর জন্য আধুনিক ও সুসজ্জিত অনুশীলন সুবিধা অত্যন্ত জরুরি৷ যেমন, ভালো মানের উইকেট, ব্যাটিং মেশিন, ফিটনেস সেন্টার এবং ডেটা বিশ্লেষণ সুবিধা থাকতে হবে৷ এই সুবিধাগুলো একজন খেলোয়াড়কে তার দক্ষতা আরো বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে৷
স্পিনার, অলরাউন্ডার নুসরাত জাহান মনে করেন, বিভিন্ন স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে একজন ব্যাটসম্যান ও বোলার নিজেকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এবং তার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে৷ তার মতে, দেশে নারী ক্রিকেটাররা অনেক পিছিয়ে৷ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের টুর্নামেন্টের সংখ্যা কম৷ পাশাপাশি প্র্যাকটিসে সুযোগ সুবিধা কম৷’’ ক্রিকেটের উন্নয়নে এ সকল সুবিধা বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি৷
ছবি: DW
বিশ্বমানের কিপিং কোচের দাবি সায়েমের
উইকেট কিপার সায়েমের মতে, ভালো মানের উইকেট কিপার পেতে হলে ভালো কোচের অধীনে প্রশিক্ষণ প্রদান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ কোচ একজন উইকেট কিপারের দুর্বলতা চিহ্নিত করে তাকে উন্নতি করতে সাহায্য করতে পারেন৷ মানসম্মত পিচ, নেট এবং অন্যান্য অনুশীলন সুবিধা একজন উইকেট কিপারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ দেশের ক্রিকেটে এ সকল সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি৷
ছবি: DW
‘কোচদের প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি’
ক্লেমন ইন্দিরা রোড ক্রিকেট অ্যাকাডেমি কোচ মো. রিয়াজ উদ্দিন সোহেলের মতে, মানের উন্নয়ন ঘটলেও বাংলাদেশের ক্রিকেটে কোচিং ভালো অবস্থায় আছে, সেটা বলা যাবে না৷ তার মতে, বিভিন্ন অ্যাকাডেমির কোচদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে৷ ‘‘বিদেশি কোচদের সাথে কাজ করার সুযোগ দেওয়া, কোচদের নিয়মিত মূল্যায়ন করা জরুরি৷’’
ছবি: DW
‘প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড বাড়াতে হবে’
গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের কোচ মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ক্রিকেটের উন্নয়ন করতে হলে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে হবে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘দেশে পর্যাপ্ত মাঠ নেই৷ প্র্যাকটিস করার মতো গ্রাউন্ড নেই ভালো৷ ইনডোর প্র্যাকটিসের তেমন সুযোগ নেই৷ বৃষ্টির মৌসুমে প্র্যাকটিস করার সুযোগ হয় না৷’’
ছবি: DW
11 ছবি1 | 11
২০২৩ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অবস্থানটা খুব ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান কোচ স্টুয়ার্ট ল, তার সোজাসাপ্টা কথা- গেল ২৫ বছরে একটুও এগোয়নি বাংলাদেশের ক্রিকেট। বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সাবেক এই কোচ আরো বলেছেন, ১৭ কোটি মানুষের এই দেশ থেকে প্রতিভা বের করে এনে ঠিক পরিকল্পনা করে দেখভাল করতে হবে, তবেই এগোতে পারে এই দেশের ক্রিকেট।
এখন প্রশ্ন হলো, স্টুয়ার্ট ল যা বোঝেন, তা কি আমাদের দেশের কর্তা ব্যক্তিরা বোঝেন না? উত্তর হলো- সবাই সব জানে, আরো ভালো করে বললে সর্ষের মধ্যেই আসল ভূত।
দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট বেহাল, ইনফ্রাস্ট্রাকচার নাজুক, কাজ করার লোক আছে, তবে কাজ হয় না কোনো। ক্রিকেটটা আটকে থাকে চোরাবালিতে। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে শিরোপা জেতা দলটাকে দেখভাল করার থাকে না কেউ। জাতীয় দলে বছরের পর বছর খেলার পরও ক্রিকেটাররা থাকে শিক্ষানবিশ পর্যায়ে। কালেভদ্রে দু-একটা জয় আসে বটে, যার নাম হয়ে যায় ‘ফ্লুক'। বোলাররা খানিকটা এগোলেও বড্ড বেহাল ব্যাটাররা। হেরে গেলে ক্রিকেটাররা দুষেন উইকেটকে। প্রেসের সামনে এসে করেন আত্মসমর্পন, কেউবা হয়ে যান গরম। বিশ্বমঞ্চ থেকে গেল ২৪ বছরে আসেনি কোনো ট্রফি। ওদিকে কোচ বদলে বোর্ড খোঁজে সমাধান। রাজা যায় রাজা আসে, বদলায় না টাইগার ক্রিকেট।
হতাশার আরো একটা চ্যাপ্টারের নাম নারী ক্রিকেট। অথচ দেশের প্রথম বড় সাফল্যটাই এসেছে, নারীদের হাত ধরে। প্রথমবার এশিয়া কাপ জয়। বাংলাদেশের গায়ে লাগে চ্যাম্পিয়নশিপের ট্যাগ।
ওই শেষ, নেই তারও কোনো ধারাবাহিকতা। ২০২৪ নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকেও ফিরতে হয়েছে শুন্য হাতে। অবশ্য কিভাবেইবা থাকবে, যারা এনে দিলো এমন সাফল্য, তাদেরকে করা হয়নি ঠিকঠাক দেখভাল। অথচ এই নারীরাই সমাজের টিপ্পনিকে পাশ কাটিয়ে নারী ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, ছেলেদের ক্রিকেটের মতো নেই নাম-যশ,নেই অর্থ, তবুও এসেছিল এই খেলাটাকে ভালোবেসে। সেই জ্যোতিরা যেন আজ ক্লান্ত পথচারী।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে নতুন আলো এসেছে দেশে, এবার কি বদলাবে চিত্রটা? নাকি ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বটল…ওরা বলবে আর ক'টা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি…। আমরা বলবো চলছে চলুক যেমন খুশি…