1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আগে পেট, তারপর করোনা

১২ জুন ২০২০

পেটে খাবার নেই৷ গায়ে কাপড় নেই৷ ভবিষ্যৎ অন্ধকার৷ দীর্ঘ লকডাউন এবং আমফানের পর করোনা নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ৷

Warteschlange für Essensrationen in Kalkutta
ফাইল ছবিছবি: DW/Prabhakar

কলকাতা বিমানবন্দরে যখন দিল্লির ফ্লাইট নামলো, কাতারে কাতারে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ থার্মাল চেক আপ হলে তবে মুক্তি৷ দীর্ঘদিনের অপেক্ষার শেষে বাড়ি ফেরার সুযোগ হয়েছে সকলের৷ দেখলেই বোঝা যায়, তাঁদের অনেকেই এই প্রথম প্লেনে চড়লেন৷ হয়তো এই শেষ!

হাজার দশেক টাকা খরচ করে বিমানের টিকিট কেটেছিলেন সহযাত্রী শ্রমিক৷ দিল্লির অদূরে একটি কারখানায় কাজ করতেন ঠিকা কর্মচারী হিসেবে৷ লকডাউনে কাজ গিয়েছে৷ বার বার ভেবেছেন হেঁটে ফিরে আসবেন৷ কিন্তু এক একটা মৃত্যু ভাবনায় বাঁধ দিয়েছে৷ একমাস কার্যত একবেলা খেয়ে সঞ্চয়ের সর্বস্ব উজাড় করে, স্ত্রীর গয়না বেচে প্লেনের টিকিট কেটেছেন ভদ্রলোক৷ কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে চুমু খেয়েছেন মাটিতে৷

সফটওয়্যার আপডেটের মতো আপডেটেড হয়েছে ভারতের লকডাউন৷ এখন চলছে লকডাউন ৫.০ এবং আনলক ১.০৷ ৩০ জুন পর্যন্ত চলবে এই প্রক্রিয়া৷ সরকার বিবৃতি প্রকাশ করে জানিয়েছে, এই সময় পর্বে কী কী খুলবে, কী ভাবে খুলবে, বন্ধই বা থাকবে কী কী৷ কিন্তু ক’জন খোঁজ রাখেন তার? ক’জনের খোঁজ রাখার পরিস্থিতি আছে?

আনলক পর্ব গোটা দেশে শুরু হয়েছে ৮ জুন৷ কলকাতায় তা শুরু করে দিয়েছে আমফান৷ লকডাউন কাজ কেড়েছিল, আমফান ঘর কেড়ে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের৷ পেটে কিল দিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে যাঁরা করোনা ভয়ে গৃহবন্দি ছিলেন, আমফান তাঁদের আশ্রয়হীন করেছে৷ তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, তাঁদের দেখার কেউ নেই৷ ফলে আর বাড়িতে বসে থাকা যাবে না৷ মে মাসের শেষ পর্ব থেকে জুনের শুরু, স্বচক্ষে দেখে এসেছি কাতারে কাতারে মানুষ মাঠে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছেন৷ নৌকো, জাল নিয়ে নেমে পড়েছেন নদীতে৷

গ্রামে, সদরে, মফস্বলে, শহরতলিতে লকডাউনের হুমকিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছোট ছোট দোকানদাররা ঝাঁপ তুলে দিয়েছেন৷ দেদার বিক্রি হচ্ছে চপ, রোল, হান্ডি বিরিয়ানি৷ লোকে কিনছেও৷ কলকাতায় প্যাডেল চালিয়ে দিয়েছেন রিক্সচালক৷ অটো চালকরা পাঁচজন সওয়ারি নিয়েই রুটের ভাড়া খাটছেন৷ বাড়ির পরিচারিকারা জোর করে কাজে ফিরতে চাইছেন৷ মধ্যবিত্ত এখনও সন্ত্রস্ত করোনা নিয়ে, তবে তাঁরাও বুঝে গিয়েছেন, এ ভাবে বাড়িতে বসে চাকরি আর বাঁচবে না৷

না, পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই৷ অধিকাংশের মাস্ক গলার কাছে৷ গরম আর আর্দ্রতায় মাস্ক মুখে রাখা যাচ্ছে না৷ দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় নদীবাঁধ ভেঙেছে৷ ঘরহারা হাজার হাজার মানুষ কোদাল, শাবল নিয়ে খালি গায়ে মাটি ঢালছেন বাঁধের মুখে৷ না, তাঁদেরও মাস্ক নেই৷ গায়ে দেওয়ার জামাও নেই৷ বিমানে যে শ্রমিক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তাঁর বাড়ি সুন্দরবনে৷ বলছিলেন, বাড়ি কার্যত ভেঙে পড়েছে৷ গ্রামের ভিতর জোয়ার ভাটা চলছে৷ পৌঁছেই কোদাল শাবল নিয়ে নেমে পড়বেন বাঁধ সারানোর কাজে৷ সরকারের উপর কোনো ভরসা নেই৷ জানি না হিঙ্গলগঞ্জে লঞ্চ থেকে দেখা বাঁধ সারাইয়ের কাজে তিনিও ছিলেন কি না৷

পাড়ার বাজারে দরদর করে ঘামতে ঘামতে মুরগি কাটছেন যে পরিচিত দোকানদার, তাঁর মাস্কও গলায়৷ মুখে লাগালে চশমা ঝাপসা হয়ে যায়৷ দুইবার অনুরোধ করেছিলাম, মাস্কটা মুখে লাগান৷ একরাশ ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমফানে ঘরের চাল উড়ে গিয়েছে৷ লকডাউনে সমস্ত টাকা শেষ৷ এ বার চশমা ঝাপসা হলে আঙুলটাও যাবে৷ ও সব করোনা টরোনা বড়লোকদের অসুখ৷ তাঁদের টেস্ট হয়৷ আমার হলে কেউ জানতেও পারবে না৷ না খেয়ে মরার চেয়ে করোনা তুলে নিলে তুলে নিক৷’’

অবাক লাগে শুনতে! অবাক লাগে যখন দেখি, শহরে একের পর এক সরকারি বেসরকারি অফিস খুলে যায়, কিন্তু লোকাল ট্রেন চলে না৷ রাজ্য সরকার নিয়ম করেছে বাসে ২০ জনের বেশি চড়তে পারবে না৷ কে শোনে কার কথা? বাদুড়ঝোলা ভিড় দিকে দিকে৷ লোকাল ট্রেন চলছে না বলে সমস্যায় পড়েছেন মফস্বল গ্রামের লোকেরা৷ প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ লোকালে চড়ে কলকাতায় কাজ করতে আসেন, বেলাশেষে ফিরে যান৷ 'মানছি না মানবো না'র শহরে এ নিয়ে এতদিনে হরতাল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল৷ হয়নি৷ দূর দূরান্ত থেকে সাইকেল নিয়ে কাজে চলে আসছেন সাধারণ মানুষ৷ কারও কোনও অভিযোগ নেই৷ সকলেই বুঝতে পারছেন, কাজ দরকার৷ রোজগার দরকার৷ শহরে যেনতেনপ্রকারেণ আসতে না পারলে চাকরি থাকবে না৷ সকলেই পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝে নিচ্ছেন নিজেদের মতো করে৷

স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

করোনা লকডাউন আসলে একটা বিষয় বুঝিয়ে দিয়েছে৷ পেটের ভয়ের চেয়ে বড় আর কিছু নেই৷ সুন্দরবনে আমফান বিধ্বস্ত যে মানুষগুলি এই গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাঁধে দাঁড়িয়ে থাকছেন শুধু একটু জল পাওয়ার জন্য, করোনা এবং তা ঘিরে তৈরি হওয়া নিয়ম সত্যিই তাঁদের কাছে বিলাসিতা৷ এখনও অচিন গ্রামের যে মা প্রসব যন্ত্রণা হলে তিন ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে হাসপাতাল যান, প্রসব হয়ে যায় নৌকোর ছাওয়ার তলায়, করোনার নিয়ম তাঁর কাছেও বিলাসিতা৷ সরকারি ত্রাণের টোকেন নিয়ে নদী বাঁধে দাঁড়িয়ে থাকে যে বালিকা, করোনা শুনলে তার চোখে বিস্ময় ধরা পড়ে৷ বাড়ির ইএমআই, সন্তানের টিউশন ফি, বাবা মায়ের ওষুধের খরচ গুণতে গুণতে যে মধ্যবিত্ত সপ্তাহান্তে একটু আয়েসের স্বপ্ন দেখতেন, লকডাউন তাঁর চাকরি খেয়েছে৷ হ্যাঁ, এই মুহূর্তে করোনার ভয় তাঁর কাছেও বিলাসিতা৷ হন্যে হয়ে চাকরি খোঁজার সময় বাসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা মাথায় থাকে না৷

সরকার জানে না এরপর কী হবে৷ কেন্দ্রও নয়, রাজ্যও নয়৷ লকডাউন থাকতে থাকতেই দেশে করোনা সংক্রমণ আকাশ ছুঁয়েছে৷ তবু বাধ্য হয়ে লকডাউন শিথিল করতে হচ্ছে৷ অর্থনীতির হাল বেহাল৷ কী হবে কেউ জানে না৷

একসময় বলা হতো, বাংলা আজ যা করে, বাকি ভারত তা করে আগামীকাল৷ কলকাতা থেকে দিল্লির ফিরতি বিমানে ওঠার সময় সত্যি সত্যিই সে কথাটা মনে হলো৷ একরাশ করোনা আতঙ্ক নিয়ে কলকাতা গিয়েছিলাম৷ একরাশ ভয়াবহতার দৃশ্য নিয়ে ফিরতি প্লেনে চড়লাম৷ না, করোনা নিয়ে আর ভাবছি না৷ মানুষ একটু খেতে পাক আগে৷ 

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ