1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আগ্নেয়গিরির শিখরে পিকনিক করা আমাদের অভ্যাস

২ জুলাই ২০২১

দিল্লিতে হামেশাই আগুন লাগে৷ বাড়ি, হোটেল, গুদাম, সিনেমা হল, বাজার, বস্তিতে৷ হইচই হয়৷ তারপর আবার সবকিছু আগের মতোই চলতে থাকে৷

ছবি: Reuters/A. Abidi

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়৷ ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর৷ ভোররাতে আগুন লাগল দিল্লির আনাজ মন্ডির একটি বাড়িতে৷ আবাসিক এলাকার মধ্যে থাকা ওই বাড়িতে আগুন লাগে ভোর পাঁচটা ২২ মিনিট নাগাদ৷ পাঁচ মিনিটের মধ্যে দমকল এসে যায়৷ কিন্তু বাড়িতে ঢোকার গলি খুব ছোট৷ একটা দমকল কোনোক্রমে ঢুকতে পারে৷ বাড়িতে ঢোকার গেট বন্ধ৷ প্রতিটি জানলায় লোহার গ্রিল৷ ছাদ থেকে নীচে নামার সিঁড়ি বন্ধ৷ গ্যাস কাটার এনে সেসব কাটতে হয়৷ পুরো সিঁড়িতে ভর্তি ছিল ব্যাগ বানাবার কাঁচামাল৷ ওই বাড়িটি আদতে ছিল ব্যাগ বানাবার কারখানা৷ কোনো ফায়ার লাইসেন্স নেই৷ আগুন লাগলে তার মোকাবিলার কোনো ব্যবস্থা নেই৷ আইনমাফিক আবাসিক এলাকায় এই ধরনের কারখানা করা যায় না৷ কিন্তু কে আর আইন মানছে৷ যথাস্থানে প্রতিমাসে ‘ভিটামিন এম' (ঘুসের টাকা) পৌঁছে দিলেই তো হলো!  

ওই জতুগৃহে আগুন লেগে মারা গিয়েছিলেন ৪৩ জন৷ যারা একতলা, দোতলায় ছিলেন, তারা বেঁচে গিয়েছিলেন৷ উপরের তলায় যে সব শ্রমিক শুয়েছিলেন, তারা মারা যান৷ তারপর যথারীতি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার৷ দুই-চার দিন একটু হই হই হয়েছে৷ তারপর যে কে সেই৷ দিল্লির ঘিঞ্জি আবাসিক এলাকায় কারখানাগুলি আগের মতোই চলছে৷ ওই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগুন লাগলে তা নেভানোর কোনো ব্যবস্থা এরকম কোনো কারখানা নিয়েছে, এমন দুর্নাম কেউ করতে পারবেন না৷

দিল্লির আনাজ মন্ডির যে জায়গায় ওই ঘটনাটা ঘটেছিল, সেখানে গেলে এখনো দেখতে পাবেন, মাথার উপরে তারের জঙ্গল৷ কোনটা কার তার, কেউ বলতে পারবে বলে মনে হয় না৷ পুরনো দিল্লির যে কোনো এলাকায় গেলে ছবিটা একই৷ যোজনা কমিশনে দীর্ঘদিন কাজ করে কিছুদিন আগে অবসর নিয়েছেন অমিতাভ রায়৷ তিনি আইআইটি-র ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার৷ অমিতাভর অভিজ্ঞতা হলো, চাঁদনি চকের কাছে পুরনো দিল্লি স্টেশনে যাওয়ার একটা খুবই সরু রাস্তা আছে৷ তার দুই পাশে কেমিক্যালের আড়ত৷ ওই ছোট গলির দুইপাশের বাড়িতে সর্বক্ষণ গরমে এসি চলে৷ কবে সেই এসি সার্ভিসিং হয়েছে কেউ জানে কি না সন্দেহ৷ মাথার উপরে তারের জঙ্গল৷ ছোট শর্ট সার্কিটে দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে জায়গাটা৷ ওখানে গিয়ে মাঝেমাঝে দাঁড়িয়ে অমিতাভ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন৷ বুঝতে পারেন, সবটাই ঈশ্বরভরসায় চলছে৷ আগুন না লাগাটাই এখানে ঘটনা৷ দিল্লিতে আবার গরমের সময় হামেশাই বাড়িতে আগুন লাগে ওই এসি সার্ভিসিং না করে চালানোর জন্য৷ তারপরেও কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই৷

জামে মসজিদের কাছে চাওড়ি বাজার বলে একটা জায়গা আছে৷ মেট্রোর স্টেশন থেকে বেরিয়ে যেকোনো রাস্তায় গিয়ে উপরের দিকে তাকান৷ দেখবেন শুধু তারের জঙ্গল৷ ছোট-বড়, সরু-মোটা বিভিন্ন ধরনের তার৷ সেই তারের কোনো লে-আউট নেই৷ যে যেমন পেরেছে, তার লটকে দিয়েছে৷ কার দায় কে জানে৷

সত্যি কথা বলতে কী, দায় কারো নেই৷ না পুরসভা, না সরকার, না দমকল, না সাধারণ মানুষের৷ যে যার মতো করে পরিস্থিতিটা খারাপ করে যাচ্ছেন৷ তারপর স্বখাত সলিলে ডুবে মরতে হবে, না না, পুড়ে মরতে হবে৷ তখন শুরু হবে, এটা কেন হয়নি, ওটা কেন হয়নি, কার দায়, এই সব নিয়ে কথা৷ ভারতে সবচেয়ে ভালো ঘটনা হলো, কোনো ঘটনারই দায় কারো নয়৷ ভয়ংকর কোনো দুর্ঘটনা, ঘটে গেলেই একবার তদন্তের নির্দেশ দিয়ে দাও৷ ব্যস, তদন্ত চলতেই থাকবে৷ তদন্ত কবে শেষ হলো, সেখানে কী রিপোর্ট দেয়া হলো, তাদের সুপারিশ কেউ মানল কি না, তা দেখার কেউ নেই৷ কারণ, পাবলিক তখন সব ভুলে গেছে৷ তারা নতুন কোনো ঘটনার পিছনে ছুটছে৷ তাছাড়া পাবলিক বা জনগণই বা কী বলবে৷ তারা তো আদ্যন্ত সুবিধাবাদীর দলে৷ পারলে নিজেরাই আরো কয়েকটা তার জড়িয়ে দেয়৷ নিজের বাড়ির তার নিয়ে কি তারা বিন্দুমাত্র চিন্তিত? দিল্লিতে একটা চালু কথা আছে, জুগাড়৷ মানে কোনো সমস্যা হলে যা হোক করে কোনোমতে কিছুদিনের জন্য সমাধান করে দাও৷ পয়সা যেন বেশি খরচ না হয়৷ তা ওই জুগাড় করতে করতে পুরো দেশটাই যে জতুগৃহ হয়ে গেল, তা আর কে দেখবে৷

​​​​গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

শুধু দিল্লির কথা নয়, কলকাতার দিকে তাকান৷ বড়বাজার, পোস্তায় মাঝে মাঝেই আগুন লাগে৷ হইচই হয়৷ তারপর সব শেষ৷ তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ ওঠে৷ কলকাতায় কোথায় না আগুন লাগে! হাসপাতালে, বাজারে, দোকানে, বাড়িতে, বস্তিতে৷ সম্ভবত ২০০৫ সাল নাগাদ রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কলকাতায় সব তার মাটির তলা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে৷ সব তার একটা ডাক্টে করে নেয়া হবে৷ বিদ্যুৎ, টেলিফোন, কেবল সব৷ তারপর সেই সিদ্ধান্তের রূপায়ণ খুব একটা বেশি জায়গায় হয়েছে, এমন দুর্নামও কেউ দিতে পারবেন না৷

করোনাকালে তো কত হাসপাতালে আগুন ধরল৷ রোগী মারা গেলেন৷ দিল্লির সফদরজঙ্গ হাসপাতালের মতো বড় হাসপাতালেই গত মার্চে আগুন লেগেছিল, আইসিইউতে৷ সেখানে অবশ্য কেউ মারা যাননি৷ কিন্তু মহারাষ্ট্রে, গুজরাটে হাসপাতালে আগুন লেগে অনেক রোগী মারা গেছেন৷

দিল্লিতে আগুন লাগার ইতিহাস তো আরো লম্বা৷ ২০১৯ সালে করোল বাগে হোটেলে আগুন লেগে ১৭ জন মারা যান৷ ২০১৮ সালে দিল্লিতে চারটি বড় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে৷ কারখানা, গুদাম, বাড়ি, বাজির গুদামে৷ তার আগে দুইটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯৭ ও ১৯৯৯ সালে৷ ১৯৯৭ সালে উপহার সিনেমা হলে ‘বর্ডার' ছবি দেখানো হচ্ছিল৷ তখন সেখানে আগুন লাগে৷ মোট ৫৯ জন মারা গেছিলেন৷ আর ১৯৯৯ সালে লাল কুঁয়ায় একটি কেমিক্যাল গুদামে আগুন লেগে ৫৭ জন মারা যান৷

সেই ১৯৯৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সময়ে দিল্লি কি বদলেছে? এককথায় জবাব, না৷ সেই ফায়ার লাইসেন্স ছাড়া কারখানা চলছে, আগুন নেভানোর ব্যবস্থা ছাড়া বড় বড় জায়গা দিব্যি চলছে৷ হোটেল, গুদাম, বাসস্থান, কমিউনিটি সেন্টার, বহুতলগুলির সবাই কি আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করেছে? পুরসভা, সরকার, সাধারণ মানুষের হুঁশ ফিরেছে? এই প্রশ্নের জবাবও হলো, না৷ ভারতে ট্র্যাডিশন সমানে চলে৷ সেই গয়ংগচ্ছ ভাব, সেই জুগাড়ের চেষ্টা, সেই যথাস্থানে ঘুস দিয়ে বেআইনি কাজকারবার চালানো, সবই আগের মতো চলছে৷ মাঝে মধ্যে সামান্য ফুলকিতে বড় আগুন লাগছে৷ যখন তা লাগে, তখন হইচই হয়, তারপর আবার যে কে সেই৷ আগ্নেয়গিরির শিখরে পিকনিক করাটা আমরা অভ্যাস করে ফেলেছি৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ