দিল্লিতে হামেশাই আগুন লাগে৷ বাড়ি, হোটেল, গুদাম, সিনেমা হল, বাজার, বস্তিতে৷ হইচই হয়৷ তারপর আবার সবকিছু আগের মতোই চলতে থাকে৷
বিজ্ঞাপন
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়৷ ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর৷ ভোররাতে আগুন লাগল দিল্লির আনাজ মন্ডির একটি বাড়িতে৷ আবাসিক এলাকার মধ্যে থাকা ওই বাড়িতে আগুন লাগে ভোর পাঁচটা ২২ মিনিট নাগাদ৷ পাঁচ মিনিটের মধ্যে দমকল এসে যায়৷ কিন্তু বাড়িতে ঢোকার গলি খুব ছোট৷ একটা দমকল কোনোক্রমে ঢুকতে পারে৷ বাড়িতে ঢোকার গেট বন্ধ৷ প্রতিটি জানলায় লোহার গ্রিল৷ ছাদ থেকে নীচে নামার সিঁড়ি বন্ধ৷ গ্যাস কাটার এনে সেসব কাটতে হয়৷ পুরো সিঁড়িতে ভর্তি ছিল ব্যাগ বানাবার কাঁচামাল৷ ওই বাড়িটি আদতে ছিল ব্যাগ বানাবার কারখানা৷ কোনো ফায়ার লাইসেন্স নেই৷ আগুন লাগলে তার মোকাবিলার কোনো ব্যবস্থা নেই৷ আইনমাফিক আবাসিক এলাকায় এই ধরনের কারখানা করা যায় না৷ কিন্তু কে আর আইন মানছে৷ যথাস্থানে প্রতিমাসে ‘ভিটামিন এম' (ঘুসের টাকা) পৌঁছে দিলেই তো হলো!
ওই জতুগৃহে আগুন লেগে মারা গিয়েছিলেন ৪৩ জন৷ যারা একতলা, দোতলায় ছিলেন, তারা বেঁচে গিয়েছিলেন৷ উপরের তলায় যে সব শ্রমিক শুয়েছিলেন, তারা মারা যান৷ তারপর যথারীতি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার৷ দুই-চার দিন একটু হই হই হয়েছে৷ তারপর যে কে সেই৷ দিল্লির ঘিঞ্জি আবাসিক এলাকায় কারখানাগুলি আগের মতোই চলছে৷ ওই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগুন লাগলে তা নেভানোর কোনো ব্যবস্থা এরকম কোনো কারখানা নিয়েছে, এমন দুর্নাম কেউ করতে পারবেন না৷
দিল্লির আনাজ মন্ডির যে জায়গায় ওই ঘটনাটা ঘটেছিল, সেখানে গেলে এখনো দেখতে পাবেন, মাথার উপরে তারের জঙ্গল৷ কোনটা কার তার, কেউ বলতে পারবে বলে মনে হয় না৷ পুরনো দিল্লির যে কোনো এলাকায় গেলে ছবিটা একই৷ যোজনা কমিশনে দীর্ঘদিন কাজ করে কিছুদিন আগে অবসর নিয়েছেন অমিতাভ রায়৷ তিনি আইআইটি-র ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার৷ অমিতাভর অভিজ্ঞতা হলো, চাঁদনি চকের কাছে পুরনো দিল্লি স্টেশনে যাওয়ার একটা খুবই সরু রাস্তা আছে৷ তার দুই পাশে কেমিক্যালের আড়ত৷ ওই ছোট গলির দুইপাশের বাড়িতে সর্বক্ষণ গরমে এসি চলে৷ কবে সেই এসি সার্ভিসিং হয়েছে কেউ জানে কি না সন্দেহ৷ মাথার উপরে তারের জঙ্গল৷ ছোট শর্ট সার্কিটে দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে জায়গাটা৷ ওখানে গিয়ে মাঝেমাঝে দাঁড়িয়ে অমিতাভ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন৷ বুঝতে পারেন, সবটাই ঈশ্বরভরসায় চলছে৷ আগুন না লাগাটাই এখানে ঘটনা৷ দিল্লিতে আবার গরমের সময় হামেশাই বাড়িতে আগুন লাগে ওই এসি সার্ভিসিং না করে চালানোর জন্য৷ তারপরেও কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই৷
২০২১ সালে ভবন ধস ও অগ্নিকাণ্ডের যত ঘটনা
২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: Giorgio Viera/AFP/Getty Images
মগবাজার বিস্ফোরণ
২৭শে জুন ঢাকার মগবাজারে একটি ভবনে বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ জনে৷ ওই ঘটনায় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে এবং গুরুতর আহত ৬৬ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন৷ ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, ভবনের কোথাও গ্যাস জমে এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: bdnews24.com
মায়ামি ভবন ধস
২৫শে জুন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মায়ামিতে একটি ১২ তলা অ্যাপার্টমেন্ট ভবন ধসে ১১ জন নিহত হয়েছে৷ এখনও নিখোঁজ অন্তত ১৫০ জন৷ ভবনটি ধসে পড়ায় ওই কমপ্লেক্সের ১৩০টি ইউনিটের অর্ধেক তছনছ হয়ে গেছে৷ তবে ভবন ধসের কারণ এখনও জানা যায়নি৷
ছবি: mpi04/MediaPunch/picture alliance
চীনে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ড, নিহত ১৮
২৫শে জুন চীনের হেনান প্রদেশে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আগুন লেগে মারা গেলেন ১৮ জন৷ নিহতদের সকলেই ছিলেন শিক্ষার্থী৷
ছবি: Andy Wong/AP Photo/picture alliance
দক্ষিণ কোরিয়ায় ভবন ধস, নিহত ৯
৯ জুন দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজুতে বহুতল ভবন ভাঙার সময় এক অংশ ধসে অন্তত নয় জন নিহত হয়েছেন৷ আহত হয়েছেন আরও আটজন৷ ভবনটি ভাঙার কাজ চলছিলো৷ হঠাৎ এর একটি অংশ ব্যস্ত রাস্তার মধ্যে ধসে পড়লে চাপা পড়ে একটি বাস৷ নিহতদের সবাই ওই বাসের যাত্রী৷ (ফাইল ছবি)
ছবি: Reuters
ভারতে স্যানিটাইজার কারখানায় অগ্নিকাণ্ড, নিহত ১৪
৭ই জুন ভারতের মহারাষ্ট্রের পুনের এসভিএস অ্যাকুয়া টেকনোলজিসের একটি প্ল্যান্টের স্যানিটাইজার প্রস্তুতকরণ ইউনিটে আগুন লেগে অন্তত ১৪ জন মারা যান৷
ছবি: Imago-Images/Pacific Press Agency
গুজরাটে হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে ১৮ করোনা রোগীর মৃত্যু
পহেলা মে ভারতের গুজরাটে এক হাসপাতালে আগুন লেগে করোনায় সংক্রমিত অন্তত ১৮ জন রোগীর মৃত্যু হয়৷ গুজরাটের ভরুচ এলাকার ওয়েলফেয়ার হাসপাতালে ৫০ জনের মতো রোগী ভর্তি ছিলো৷
ছবি: Naveen Sharma/Zuma/picture alliance
ইরাকে হাসপাতালে আগুন, মৃত ৮২ করোনা রোগী
২৬শে এপ্রিল অক্সিজেন কনটেনার ফেটে বাগদাদের হাসপাতালে আইসিইউ-তে আগুন লেগে মারা যায় অন্তত ৮২ জন করোনা রোগী৷ বাগদাদের হাসপাতাল ইবন আল-খাতিব-এ এই ভয়াবহ ঘটনায় ১১০ জন আহত হন৷
ছবি: Thaier Al-Sudani/REUTERS
মহারাষ্ট্রে হাসপাতালে আগুন, ১৩ করোনা রোগীর মৃত্যু
২৩শে এপ্রিল মহারাষ্ট্রের বিরারে বিজয় বল্লভ হাসপাতালে আগুন লেগে আইসিইউতে থাকা ১৩ জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়৷ শর্ট সার্কিট থেকে এই আগুন লাগে বলে জানা গেছে৷আগুন প্রথমে লাগে আইসিইউ-তে৷
২১শে এপ্রিল মহারাষ্ট্রের নাসিকে হাসপাতালে ট্যাঙ্কার লিক হলে আধাঘন্টা অক্সিজেন বন্ধ থাকায় মৃত্যু হয় ২২ জন করোনা রোগীর৷ ১০ জন ভেন্টিলেটারে ছিলেন৷ তারা সকলেই মারা যান। অনেক রোগীকে সেসময় অক্সিজেন দেয়া হচ্ছিলো৷ তাদের মধ্যে ১২ জন মারা যান৷
ছবি: ANI/REUTERS
বহুতল ভবন ধসে মিশরে নিহত ১৮
২৭শে মার্চ মিশরের রাজধানী কায়রোতে বহুতল ভবন ধসে নিহত হয়েছে ১৮ জন৷ আহত হয়েছে অন্ততপক্ষে ২৪ জন৷ রাত ৩টার দিকে ১০ তলা ভবনটি ধসে পড়ে৷ এছাড়া ২৭ জুন আবাসিক ভবন ধসে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়াতে চার নারীর মৃত্যু হয়েছে৷
ছবি: Mohamed Asad/Xinhua/picture alliance
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন
২২শে মার্চ উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে৷ সরকারি হিসেবে সেই অগ্নিকাণ্ডে ১১ জনের মৃত্যু হয় এবং নয় হাজার ৩০০ পরিবারের আনুমানিক ৪৫ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে৷ ২রা এপ্রিল উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প সংলগ্ন কুতুপালং বাজারে অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের, আহত কয়েকজন৷
ছবি: ROHINGYA RIGHT TEAM/Md Arakani/REUTERS
কলকাতায় রেলভবনে আগুনে মৃত ৯
৯ মার্চ কলকাতায় রেলের একটি ভবনে আগুনের ঘটনা ঘটে৷ স্ট্র্যান্ডরোডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত নয় জনের মৃত্যুর হয়েছে৷ এদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে লিফটে৷
ছবি: DW/S. Bandyopadhyay
ঢামেকের আইসিইউতে আগুন, তিনজনের মৃত্যু
১৭ই মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনার আইসিইউ ইউনিটে আগুনের ঘটনায় রোগী সরানোর সময় তিন জন মারা গেছেন৷ এ সময় করোনা ইউনিটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় বলে জানান হাসপাতাল পরিচালক৷
ছবি: DW/H. Ur Radhid
সেরাম ইনস্টিটিউটে আগুন, নিহত ৫
পুনায় একশ একর জমির উপর সেরামের কারখানা৷ ২২শে জানুয়ারি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক এই ইনস্টিটিউটের নির্মীয়মান ভবনে আগুন লেগে মারা যায় পাঁচ জন৷
ছবি: Rafiq Maqbool/AP/picture alliance
14 ছবি1 | 14
জামে মসজিদের কাছে চাওড়ি বাজার বলে একটা জায়গা আছে৷ মেট্রোর স্টেশন থেকে বেরিয়ে যেকোনো রাস্তায় গিয়ে উপরের দিকে তাকান৷ দেখবেন শুধু তারের জঙ্গল৷ ছোট-বড়, সরু-মোটা বিভিন্ন ধরনের তার৷ সেই তারের কোনো লে-আউট নেই৷ যে যেমন পেরেছে, তার লটকে দিয়েছে৷ কার দায় কে জানে৷
সত্যি কথা বলতে কী, দায় কারো নেই৷ না পুরসভা, না সরকার, না দমকল, না সাধারণ মানুষের৷ যে যার মতো করে পরিস্থিতিটা খারাপ করে যাচ্ছেন৷ তারপর স্বখাত সলিলে ডুবে মরতে হবে, না না, পুড়ে মরতে হবে৷ তখন শুরু হবে, এটা কেন হয়নি, ওটা কেন হয়নি, কার দায়, এই সব নিয়ে কথা৷ ভারতে সবচেয়ে ভালো ঘটনা হলো, কোনো ঘটনারই দায় কারো নয়৷ ভয়ংকর কোনো দুর্ঘটনা, ঘটে গেলেই একবার তদন্তের নির্দেশ দিয়ে দাও৷ ব্যস, তদন্ত চলতেই থাকবে৷ তদন্ত কবে শেষ হলো, সেখানে কী রিপোর্ট দেয়া হলো, তাদের সুপারিশ কেউ মানল কি না, তা দেখার কেউ নেই৷ কারণ, পাবলিক তখন সব ভুলে গেছে৷ তারা নতুন কোনো ঘটনার পিছনে ছুটছে৷ তাছাড়া পাবলিক বা জনগণই বা কী বলবে৷ তারা তো আদ্যন্ত সুবিধাবাদীর দলে৷ পারলে নিজেরাই আরো কয়েকটা তার জড়িয়ে দেয়৷ নিজের বাড়ির তার নিয়ে কি তারা বিন্দুমাত্র চিন্তিত? দিল্লিতে একটা চালু কথা আছে, জুগাড়৷ মানে কোনো সমস্যা হলে যা হোক করে কোনোমতে কিছুদিনের জন্য সমাধান করে দাও৷ পয়সা যেন বেশি খরচ না হয়৷ তা ওই জুগাড় করতে করতে পুরো দেশটাই যে জতুগৃহ হয়ে গেল, তা আর কে দেখবে৷
শুধু দিল্লির কথা নয়, কলকাতার দিকে তাকান৷ বড়বাজার, পোস্তায় মাঝে মাঝেই আগুন লাগে৷ হইচই হয়৷ তারপর সব শেষ৷ তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ ওঠে৷ কলকাতায় কোথায় না আগুন লাগে! হাসপাতালে, বাজারে, দোকানে, বাড়িতে, বস্তিতে৷ সম্ভবত ২০০৫ সাল নাগাদ রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কলকাতায় সব তার মাটির তলা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে৷ সব তার একটা ডাক্টে করে নেয়া হবে৷ বিদ্যুৎ, টেলিফোন, কেবল সব৷ তারপর সেই সিদ্ধান্তের রূপায়ণ খুব একটা বেশি জায়গায় হয়েছে, এমন দুর্নামও কেউ দিতে পারবেন না৷
করোনাকালে তো কত হাসপাতালে আগুন ধরল৷ রোগী মারা গেলেন৷ দিল্লির সফদরজঙ্গ হাসপাতালের মতো বড় হাসপাতালেই গত মার্চে আগুন লেগেছিল, আইসিইউতে৷ সেখানে অবশ্য কেউ মারা যাননি৷ কিন্তু মহারাষ্ট্রে, গুজরাটে হাসপাতালে আগুন লেগে অনেক রোগী মারা গেছেন৷
দিল্লিতে আগুন লাগার ইতিহাস তো আরো লম্বা৷ ২০১৯ সালে করোল বাগে হোটেলে আগুন লেগে ১৭ জন মারা যান৷ ২০১৮ সালে দিল্লিতে চারটি বড় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে৷ কারখানা, গুদাম, বাড়ি, বাজির গুদামে৷ তার আগে দুইটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯৭ ও ১৯৯৯ সালে৷ ১৯৯৭ সালে উপহার সিনেমা হলে ‘বর্ডার' ছবি দেখানো হচ্ছিল৷ তখন সেখানে আগুন লাগে৷ মোট ৫৯ জন মারা গেছিলেন৷ আর ১৯৯৯ সালে লাল কুঁয়ায় একটি কেমিক্যাল গুদামে আগুন লেগে ৫৭ জন মারা যান৷
সেই ১৯৯৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সময়ে দিল্লি কি বদলেছে? এককথায় জবাব, না৷ সেই ফায়ার লাইসেন্স ছাড়া কারখানা চলছে, আগুন নেভানোর ব্যবস্থা ছাড়া বড় বড় জায়গা দিব্যি চলছে৷ হোটেল, গুদাম, বাসস্থান, কমিউনিটি সেন্টার, বহুতলগুলির সবাই কি আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করেছে? পুরসভা, সরকার, সাধারণ মানুষের হুঁশ ফিরেছে? এই প্রশ্নের জবাবও হলো, না৷ ভারতে ট্র্যাডিশন সমানে চলে৷ সেই গয়ংগচ্ছ ভাব, সেই জুগাড়ের চেষ্টা, সেই যথাস্থানে ঘুস দিয়ে বেআইনি কাজকারবার চালানো, সবই আগের মতো চলছে৷ মাঝে মধ্যে সামান্য ফুলকিতে বড় আগুন লাগছে৷ যখন তা লাগে, তখন হইচই হয়, তারপর আবার যে কে সেই৷ আগ্নেয়গিরির শিখরে পিকনিক করাটা আমরা অভ্যাস করে ফেলেছি৷
আগুন নেভানোর চমকপ্রদ সব আবিষ্কার
প্রাকৃতিক অগ্নিকাণ্ড সভ্যতার শুরু থেকেই বিপদজনক ঘটনা হলেও শিল্পায়নের এই যুগে মানবসৃষ্ট কারণে এর সংখ্যা বেড়েছে৷ তাই নিত্য গবেষণাও চলে একে মোকাবেলার৷ ছবিঘরে জানুন আগুন নেভানোর কয়েকটি চমকপ্রদ আবিষ্কারের কথা৷
ছবি: Reuters/A. Konstantinidis
ফায়ারফাইটিং ড্রোন
ড্রোনের সুবিধা হলো এটি নীচে দাঁড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ কয়েকটি কোম্পানি এরই মধ্যে ফায়ারফাইটিং ড্রোন বাজারে ছেড়েছে৷ যেখানে এখন পর্যন্ত ক্রেন দিয়ে সর্বোচ্চ ১০০ মিটারের কিছু বেশি উচ্চতায় পৌঁছানো যায়, সেখানে অ্যারোনেস কোম্পানির ড্রোনগুলো ৩শ’ থেকে ৪শ’ মিটার উচ্চতায় যেতে পারে এবং এগুলো মিনিটে ১০০ লিটার গতিতে পানি ছিটাতে পারে৷ শুধু তাই নয় ১৪৫ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজনের কোনো ব্যক্তিকেও এটি তুলে আনতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/R. Tivony
সাউন্ডওয়েভ ফায়ার এক্সটিনগুইশার
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মেসন ইউনিভার্সিটির দুই প্রকৌশল ছাত্র ট্র্যান ও রবার্টসন ২০১৭ সালে এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন৷ যদিও আগুন নেভানোর জন্য শব্দের ব্যবহারের আইডিয়া আগে আলোচিত বা পরীক্ষা করা হয়েছে, একে বাস্তব যন্ত্রে রূপান্তর করেছেন এই দু’জন৷ যন্ত্রটি দিয়ে ১০০ হার্টজ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তৈরি করে আগুনে অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়৷ আর ম্যাজিকের মতো মুহূর্তেই আগুন নিভে যায়৷
ছবি: Youtube
বম্বার্ডিয়ার সিএল ৪১৫
এয়ারক্রাফট ফায়ারফাইটার হলো বিরাট আগুন (যেমন, ওয়াইল্ড ফায়ার) নেভানোর কাজে ব্যবহারযোগ্য বিমান৷ এর মধ্যে বম্বার্ডিয়ার সিএল ৪১৫ ক্যানাডায় তৈরি একটি বোমারু বিমান, যেটি আগুনের মধ্যে বোমার মতো পানি ফেলে অল্প সময়েই নিভিয়ে ফেলে৷ মাত্র ১২ সেকেন্ডে এটি ৬ হাজার ১শ’ ৪০ লিটার পানি ছড়াতে পারে৷ এটি উভচর৷
ছবি: picture-alliance/CTK/J. Sulc
স্কাইক্রেন
স্কাইক্রেনও এয়ারক্রাফট ফায়ারফাইটার৷ এটি একটি মার্কিন হেলিকপ্টার৷ এটিও অনেক দ্রুতগতিতে আগুনে পানি ছিটাতে পারে৷ মাত্র ৪৫ সেকেন্ডে ১০ হাজার লিটার পানি ছিটাতে পারে এই স্কাইক্রেনটি৷ এটি একটি মিলিটারি মডেলের হেলিকপ্টার৷ বিখ্যাত অ্যানিমেশন মুভি ‘দি ইনক্রেডিবল হাল্ক’-এ এই মডেলটি ব্যবহার করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ফায়ারফাইটিং রোবট
ছোট ট্যাঙ্কের মতো এই ফায়ারফাইটিং রোবটগুলো অস্ট্রেলিয়ায় তৈরি৷ এগুলো আগুনের খুব কাছে পৌঁছে যেতে পারে৷ এগুলো ৮৫ মিটার বা একটি ফুটবল মাঠের দূরত্বে পানি ছেটাতে পারে৷ এগুলো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারে, বাধা অতিক্রম করতে পারে৷ ছোট হলেও সামনে ভারী বস্তু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারে৷ দুইজনকে বহন করতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/Zuma/Kalashnikov
ফায়ার এক্সটিনগুইশার বল
এটা বেশ মজার একটি যন্ত্র৷ বলটিতে থাকে আগুন নেভানোর রাসায়নিক পদার্থ ও দাহ্য পদার্থ৷ তাই আগুনের সংস্পর্শে আসলে মাত্র তিন সেকেন্ডের মধ্যে এটি বিস্ফোরিত হয় এবং সেই পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে৷ আগুন নিভে যায়৷ এগুলো বাসাবাড়ি ও অফিস আদালতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷
ছবি: Youtube
স্কাই সেভার
ফারুক রূপায়ন টাওয়ার থেকে বাঁচতে অনেকেই অনেক ওপর থেকে লাফ দিয়েছিলেন৷ স্কাই সেভার থাকলে তাঁরা একে একে নিরাপদে নামতে পারতেন৷ এটি শুধু জ্যাকেটের মতো পরে কোনো একটি হুক বা কিছু সঙ্গে ওপরের নবটি আটকে লাফিয়ে পড়তে হয়৷ স্কাই সেভার বডির ওজন অনুযায়ী ব্যক্তিকে অল্পসময়ে আস্তে আস্তে নীচে নামিয়ে নিয়ে আসে৷
ছবি: Youtube
এলইউএফ ৬০
এলইউএফ ৬০ একটি চলনশীল ওয়্যারলেস রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্র৷ এটি ১ হাজার ফুট পর্যন্ত সামনের আগুন নিভিয়ে পথ পরিষ্কার করে দেয়৷ এছাড়া মিনিটে ১ হাজার ৮শ’ লিটার পানি ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ছুড়তে পারে৷ বিদ্যুৎ চলে গেলে এতে ম্যানুয়েল কন্ট্রোলও আছে৷ বিশেষ করে ওয়্যারহাউস বা আন্ডারগ্রাউন্ডে আগুন নেভানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সহজেই এর মাধ্যমে করা যায়৷
ছবি: Imago Images/imagebroker/strussfoto
হাই ফগ
কোনো অফিস ঘর বা হোটেল রুমে যেসব সাধারণ স্প্রিঙ্কলারগুলো রয়েছে, তাতে আগুন নেভাতে নেভাতে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়৷ হাই ফগ এর চেয়ে দশগুণ বেশি গতিতে কাজ করে৷ এর বিশেষত্ব হলো এটি প্রচণ্ড বেগে কুয়াশার মতো পানি ছোড়ে, যা শুধু আগুনই নেভায় না, পরিবেশের তাপমাত্রা কমায় ও আগুনে অক্সিজেনের সরবরাহে বাধা দেয়৷ তাতে আগুন খুব দ্রুত নিভে যায়৷
ছবি: Youtube
অটো ফায়ারম্যান
গাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা সচরাচর না ঘটলেও এটি খুব বিপদজনক৷ এই বিপদ এড়াবার জন্য রয়েছে অটো ফায়ারম্যান৷ গাড়ির ইঞ্জিনে একজোড়া অটো ফায়ারম্যান লাগিয়ে রাখলে তা তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বা আগুন লেগে গেলে গ্যাসের মতো করে কেমিক্যাল রেজিন ছড়াতে থাকে৷ তাতে আগুন নিভে যায়৷
ছবি: Youtube
স্মার্ট ডিটেকটরস
কোথাও আগুনের সূত্রপাত ঘটলে তা ছড়িয়ে পড়ার আগে জানা গেলে তা নেভানো সহজ৷ স্মার্ট ডিটেকটর বিভিন্ন ধরনের ধোঁয়াকে আলাদা করতে পারে৷ যেমন, কোনটা চুলার রান্নার ধোঁয়া, কোনটা সত্যি আগুনের ধোঁয়া ইত্যাদি৷ এটি আপনার ফোনে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের ধোঁয়ার রিডিং দিতে থাকে৷ যদি কোনো আগুন বা ধোঁয়া বিপদজনক মাত্রায় পৌঁছাতে শুরু করে তখনই এটি আপনাকে এবং ফায়ার সার্ভিস বিভাগকে জানিয়ে দেবে৷