শহর দুটিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বড় আকারের জয়ের দাবি করেছে তুরস্কের বিরোধী দল৷ প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানের একে পার্টির এই পরাজয়কে তাঁর বিরুদ্ধে ‘গণভোট’ হিসেবে দেখছেন অনেকে৷
বিজ্ঞাপন
সোমবার প্রকাশিত ফলে দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ শহরে এরদোয়ানের জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি- একেপির প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছেন৷ কিন্তু আঙ্কারায় বড় জয় নিশ্চিত করেছে এবং ইস্তানবুলে জয়ের পথে প্রধান বিরোধী দলের প্রার্থী৷
শুরুতে দুই দলই তুরস্কের সবচেয়ে বড় ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহরটিতে জয়ের দাবি করেছিল৷ কিন্তু পরবর্তীতে দেশটির নির্বাচন কমিশন জানায় বিরোধী দল এখানে এগিয়ে আছে৷
তুরস্কে কেমন আছে উইগুর মুসলিমরা
বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত এক জাতি চীনের উইগুর মুসলিমরা৷ এই সম্প্রদায়ের অনেকেই বসবাস করছেন তুরস্কে৷ সেখানেও বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন তাঁরা৷
ছবি: Reuters/Murad Sezer
উইগুরদের পরিচয়
উইগুররা মূলত চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসরত একটি মুসলিম সম্প্রদায়৷ চীনের স্বিকৃত ৫৫টি সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর একটি তাঁরা৷ চীন ছাড়াও কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক ও সৌদি আরবেও এই জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/epa/H. H. Young
চীনা নিপীড়ন
চীনে উইগুরদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় বাধা-নিষেধ আরোপ রয়েছে৷ উইগুরসহ দেশটির ১০ লাখের বেশি মুসলমানদের আলাদা নজরদারিতে রেখেছে সরকার৷ জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এ পরিস্থিতিকে বন্দীদশার সাথে তুলনা করেছে৷ তবে ইসলামি জঙ্গীবাদ ঠেকাতে এমন উদ্যোগ বলে দাবি চীনের৷
ছবি: Getty Images/K. Frayer
উইগুরদের তুর্কি যোগাযোগ
তুর্কি ভাষাভাষি উইগুরদের তুরস্কের সংস্কৃতির সাথে নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে৷ চীনের জিনজিয়াংয়ে তাঁদের করুণ পরিস্থিতি নিয়ে একমাত্র এই দেশটিই নিয়মিত উদ্বেগ প্রকাশ করে৷ ১৯৬০-এর দশক থেকে উইগুরদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ও তুরস্ক৷ ‘ইস্ট তুর্কেস্থান ন্যাশনাল সেন্টার’ নামের একটি সংস্থার হিসাবে দেশটিতে বর্তমানে ৩৫,০০০ উইগুর বসবাস করছে৷
ছবি: Reuters/Murad Sezer
তুরস্কেও বিপাকে উইগুররা
তিন-চার বছর আগ পর্যন্ত তুরস্কে বসবাসে তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি উইগুরদের৷ কিন্তু বেইজিংয়ের সাথে আংকারার সুসম্পর্কের জের ধরে সেই ধারার পরিবর্তন হয়েছে৷ নির্বাসিত উইগুরদের সংগঠন ‘অ্যাসেম্বলি অফ ইস্ট তুর্কেস্তান’-র প্রধান সাইদ তুমতুর্ক জানান, তাদের কিছু সদস্য সিরিয়ার বাসার আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদি লড়াইয়ে অংশ নেয়ায় চীন তুরস্কের উপর চাপ দিয়েছে৷ এতে উইগুরদের বিরুদ্ধে তুরস্কের মনোভাবও পাল্টে গেছে৷
ছবি: Reuters/Murad Sezer
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কা
২০১৫ সালে স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে বাধ্য হয়ে তুরস্কে পাড়ি জমান নূরমুহাম্মদ৷ পরিবারের অন্যরা পেলেও বসবাস আর কাজ করার অনুমতি পাননি তিনি৷ এমন অবস্থায় তুরস্ক সরকার তাঁকে বের করে দেয়ার শঙ্কায় রয়েছে নূরমুহাম্মদ৷ জিনজিয়াংয়ে বসবাসরত স্বজনদের সাথেও যোগাযোগ করতে পারছেন না তিনি৷
ছবি: Reuters/M. Sezer
চীনে বন্দী সন্তান
২০১৬ সালে দাদা-দাদির সাথে দেখা করতে চীনের জিনজিয়াংয়ে যান নূরমুহাম্মদের সন্তান পাকজাত৷ পৌছানোর পর বিমানবন্দর থেকেই চীন সরকার তাকে বন্দী করে বলে খবর পেয়েছেন তাঁরা৷ ‘‘আমার সন্তানকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন সে ১৬ বছরের এক শিশু৷ তার ছোট ভাই-বোনরা অনবরত প্রশ্ন করে, বড় ভাইয়ের সাথে তারা কবে একসাথ হবে?’’ রয়টার্সকে জানান পাকজাতের মা গুলজিন মাহমুত৷
ছবি: Reuters/M. Sezer
পাসপোর্ট জটিলতা
তুরস্কে চীনা দূতাবাস সেখানে বসবাসরতদের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হলে তা আর নবায়ন করছে না৷ একটি কাগজ দেয়া হয়, যার মাধ্যমে তাঁরা চীনে ফেরার সুযোগ পান৷ অন্যদিকে ২০১৭ সালে এক উজবেক নাগরিক ইস্তানবুলে নাইট ক্লাবে হামলা চালিয়ে ৩৯ জনকে হত্যার পর তুরস্ক সরকারও কিছুটা সতর্ক অবস্থান নিয়েছে৷ সেখানে কাজের অনুমতি না পাওয়ায় দেশটিতে বসবাসরত উইগুররা তাঁদের ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন৷
ছবি: Reuters/M. Sezer
আশার আলো
চীনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রায়ই তুরস্কে প্রতিবাদে অংশ নেন উইগুর জনগোষ্ঠী৷ তাঁদের অধিকার আদায়ে তুরস্কই এখনও একমাত্র ভরসা৷ গত মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোগলু উইগুরদের বিরুদ্ধে চীনের দুর্ব্যবহারের সমালোচনা করেন ও ধর্মপালনের স্বাধিনতা দেয়ার আহ্বান জানান, যা উইগুরদের নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/M. Sezer
8 ছবি1 | 8
৩০টি বড় শহর, ৫১টি প্রাদেশিক রাজধানী এবং ৯২২টি জেলায় প্রায় ৬ কোটি ভোটার ভোট দেন৷ নির্বাচনটিকে এরদোয়ানের জনপ্রিয়তার একটি পরীক্ষা হিসেবেই দেখা হচ্ছিলো৷
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, এরদোয়ানের ইসলামপন্থি দল দেশজুড়ে ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে, অন্যদিকে বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি- সিএইচপি পেয়েছে ৩১ শতাংশ ভোট৷
ইস্তানবুলে লড়াইটা বেশ হাড্ডাহাড্ডি ছিল৷ সোমবার সকালে তুরস্কের সুপ্রিম ইলেকশন বোর্ড জানায় বিরোধী প্রার্থী একরেম ইমামোগলু একেপির বিনালি ইলদিরিমের চেয়ে ২৮ হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছেন৷
তবে শহরটিতে কত শতাংশ ভোট গণনা করা হয়েছে, তা জানাননি নির্বাচন কর্মকর্তারা৷
এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ‘গণভোট'
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের অতীত নির্বাচনি সাফল্যের মূলে ছিল শক্তিশালী অর্থনীতি৷ কিন্তু তুর্কি লিরার ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া, মূল্যস্ফীতি, এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এখন এরদোয়ানের দলকে ফেলছে চ্যালেঞ্জের মুখে৷
রোববার রাতে সমর্থকদের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে এরদোয়ান এখনও তাঁর দলকে দেশের ‘এক নম্বর দল' হিসেবে তুলে ধরেন৷ কিন্তু একই সঙ্গে মেয়র নির্বাচনে কিছুটা পিছিয়ে থাকার কথাও স্বীকার করে নেন তিনি৷
তুরস্কে এখনও প্রভাবশালী কামাল আতাতুর্ক
প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ান ক্ষমতায় আসার পর দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের প্রভাব কমে গেছে বলে মনে করা হলেও আসলে তাঁর নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এখনো তুর্কিদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ৷
ছবি: DW/B. Secker
আতাতুর্ক প্রস্তরখণ্ড
ডয়চে ভেলের ব্র্যাডলি সেকের ২০১২ সাল থেকে তুরস্কে কাজ করছেন৷ পুরো তুরস্ক প্রায় চষে বেড়িয়েছেন তিনি৷ ইজমির থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের এই বিশাল প্রতিকৃতি কারো নজর এড়ায় না৷
ছবি: DW/B. Secker
মোম মূর্তি
ইস্তান্বুলে কামাল আতাতুর্কের বাড়িটি এখন একটি জাদুঘর৷ সেখানে তাঁর মোমের মূর্তি রয়েছে, সেনাবাহিনীর পোশাকে, বসে আছেন একটি ডেস্কে৷
ছবি: DW/B. Secker
অতীতকে ভাস্কর্যে ধরে রাখা
ইস্তান্বুলের উত্তরাঞ্চলে লেভেন্ত এলাকায় এক ভাস্কর কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য তৈরির কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছেন৷ এটিকে রাখা হবে একটি স্কুলের খেলার মাঠে৷
ছবি: DW/B. Secker
জীবন ফিরে পাওয়া
একেবারে কামাল আতাতুর্কের মতো চেহারার এই ব্যক্তির নাম গোকসাল কায়া৷ তিনি টেলিভিশন, চলচ্চিত্র এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন৷ কেবল তুরস্ক নয়, আতাতুর্ক সেজে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি৷
ছবি: DW/B. Secker
বার্তা দেয়া
প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি সিএইচপি’র সমাবেশে এক ব্যক্তিকে দেখা গেল কামাল আতাতুর্কের হয়ে সমর্থন জানাতে৷ তাঁর পরনে ছিল আতাতুর্কের ছবি সম্বলিত টাই৷
ছবি: DW/B. Secker
সুবিধাজনক অবস্থান
ইস্তান্বুলের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা, যেটি পর্যটকদের আকর্ষণ কেন্দ্র, সেখানে আতাতুর্কের একটি ভাস্কর্য রয়েছে৷ ভাস্কর্যটি দেখলে মনে হয় তিনি বসফরাস প্রণালীর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন৷
ছবি: DW/B. Secker
ছায়ার খেলা
তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে তুরস্ক-জর্জিয়ার যে সীমান্ত রয়েছে, সেখান থেকে গাড়িতে অল্প দূরত্বে আতাতুর্ক গ্রাম৷ প্রতিবছর একটি মাসে এখানকার একটি উপত্যকায় সূর্যাস্তের সময় আতাতুর্কের ছায়া ফুটিয়ে তোলা হয়৷ এতে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগে৷
ছবি: DW/B. Secker
পাশাপাশি
এর্দোয়ানের সাবেক ফুটবল ক্লাব কাসিমপাশায় তুরস্কের পতাকার নীচে কামাল আতাতুর্ক ও এর্দোয়ানের প্রতিকৃতি পাশাপাশি৷
ছবি: DW/B. Secker
8 ছবি1 | 8
কিছু শহরে হারের আশঙ্কা প্রকাশ করেন এরদোয়ান৷ এর কারণ হিসেবে কিছু ভোটারের কাছে দলের অবস্থান তুলে ধরতে না পারার কথাও বলেন তিনি৷ আঙ্কারায় এরদোয়ান বলেন, ‘‘যদি আমাদের কোনো ব্যর্থতা থেকে থাকে, আমাদের দায়িত্ব হলো তা সমাধান করা৷''
অভিযোগ, সহিংসতা
দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনি সহিংসতায় নিহত হয়েছেন দুই জন, আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত৷ মৃত্যুর ঘটনায় শোক প্রকাশ করলেও এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি যাতে না হয়, সে আশাও প্রকাশ করেছেন তিনি৷
নির্বাচনি প্রচারণায় বিরোধী দলকে দেশের শত্রু বলে উল্লেখ করেছেন এরদোয়ান৷ দেশটির অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্যও দেশের ভেতরে ও বাইরে শত্রুদের দায়ী করেন তিনি৷
কুর্দিপন্থি বিরোধী দল পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি- এইচডিপি বিভিন্ন শহরে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে নির্বাচন বয়কট করেছে৷ দলটির বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদের অভিযোগ এনে নির্বাচনের আগেই কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷ এর ফলে নির্বাচনের মাঠ ‘সবার জন্য সমান' ছিল না বলে দাবি করেন দলটির নেতারা৷
নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রচারণার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পায়নি বিরোধী দলগুলো৷ বেশিরভাগ গণমাধ্যমই সরকারপন্থি অথবা এরদোয়ানের সমর্থক৷ ফলে গণমাধ্যমে বরাবরই বেশি সময় পেয়েছে এরদোয়ানের প্রচার-প্রচারণার সংবাদ৷
২০১৫ সালে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর নিজের হাতে ক্ষমতা আরো কেন্দ্রীভূত করেন এরদোয়ান৷ মানবাধিকার সংস্থা, সুশীল সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বেশ কঠোর ব্যবস্থাও নেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট৷