জার্মান চ্যান্সেলার ম্যার্কেলের ভারত সফরে এই ছবিটাই উঠে এলো৷ সই হলো দু'দেশের মধ্যে ১৮টি সমঝোতাপত্র, যার শীর্ষভাগে আছে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অপ্রচলিত বিদ্যুৎশক্তি, তথ্য-প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা আর সন্ত্রাসবাদ রোধ ইত্যাদি৷
বিজ্ঞাপন
ভারত-জার্মান সম্পর্ক সময়ের কষ্টিপাথরে যাচাই করা হয়ে গেছে গত ৬০ বছর ধরে৷ ইতিমধ্যে গঙ্গা ও রাইন নদীতে অনেক জল বয়ে গেছে৷ দু'দেশে সরকার বদল হয়েছে, শাসক দল বদল হয়েছে, কিন্তু বন্ধন রয়েছে অটুট৷ বরং উত্তোরত্তর সেই বন্ধন হয়েছে আরও মজবুত৷ ভারত ও জার্মানি একে হয়ে উঠেছে অপরের পরিপূরক৷ তাই ভারত-জার্মান তৃতীয় আন্তঃসরকার আলোচনা বৈঠকে যোগ দিতে জার্মান চ্যান্সেলার আঙ্গেলা ম্যার্কেলের তিন দিনের ভারত সফর নানা দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ৷ টুইটারেও উঠে এসেছে এর নানা দিক৷
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আঙ্গেলা ম্যার্কেল দু'দফায় দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হন, দিল্লিতে এবং ব্যাঙ্গালুরুতে৷ ব্যাঙ্গালুরুতে তথ্য-প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মোদী জার্মানির প্রতি ‘মেক-ইন-ইন্ডিয়া' এবং ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার হয়ে ওঠার ডাক দেন৷ বলেন, বর্তমান বিশ্বে যে মন্দাবস্থা চলেছে তার প্রেক্ষিতে ভারত বিদেশি লগ্নির উজ্জ্বল গন্তব্য৷ বিশেষ করে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে ভারতে৷ আর তার জন্য বিদেশি লগ্নির অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে নানা রকম সুবিধা দেবার কথাও বলেন তিনি৷ যেমন, মেধাস্বত্ত্ব সুরক্ষা, পণ্য ও পরিষেবা করের সুবিধা ইত্যাদি৷
ডিজিটাল ইন্ডিয়া প্রসঙ্গে মোদী বলেছেন, ভারতের সফটওয়্যার উদ্ভাবনী প্রতিভা বিশ্বের হার্ডওয়্যার শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে সন্দেহ নেই৷ বলা বাহুল্য, জার্মানির ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান এবং ভারতের তথ্য-প্রযুক্তির উদ্ভাবনী শক্তির সহযোগিতা ছিল ব্যাঙ্গালুরু সম্মেলনের প্রধান ‘থিম'৷ নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে ম্যার্কেলের সফর নিয়ে টুইটও করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী৷
এর আগে গত সোমবার দিল্লিতে একক এবং প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের পর, এক যৌথ বিবৃতিতে মোদী বলেন, জার্মানির শক্তি আর ভারতের অগ্রাধিকার একজোট হয়ে এক নতুন অর্থনৈতিক বিবর্তনের পথ প্রশস্ত করবে৷ শুধু তাই নয়, মেক-ইন-ইন্ডিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ শরিক দেশ জার্মানি৷ তাই সই হয়েছে ১৮টি সমঝোতা চুক্তিপত্র, যার অন্যতম হলো ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, গ্রিন এনার্জি, উচ্চশিক্ষা, তথ্য-প্রযুক্তি, রেলওয়ের আধুনিকীকরণ, নিরাপত্তা, সন্ত্রাস প্রতিরোধ, স্কিল-উন্নয়ন ইত্যাদি৷ আগামী দিনে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মঞ্চে, বিশেষ করে আগামী ডিসেম্বরে প্যারিসে জলবায়ু চুক্তির প্রেক্ষিতে, ভারত-জার্মান যাতে একই সুরে কথা বলে সেবষয়েও সহমত হয় এই দুই নেতা৷ পরিবেশ সুরক্ষায় সৌরশক্তির মতো গ্রিন তথা নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎশক্তি উত্পাদনে ভারতকে প্রায় ১০০ কোটি ইওরো আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সাহায্য দিতে চেয়েছে জার্মানি৷ কারণ পরমাণু বিদ্যুৎশক্তির ওপর আর আস্থা নেই জার্মানির৷ তারা মনে করে, পরমাণু বিদ্যুৎ উত্পাদন আর্থিক দিক থেকে আর লাভজনক নয়৷ তার সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র প্রসার সমস্যা এবং পরমাণু কেন্দ্রে দুর্ঘটনা ও বর্জ পদার্থ অপসারণের দুশ্চিন্তা তো আছেই৷
জার্মান চ্যান্সেলারের সঙ্গে এসেছেন শীর্ষ পর্যায়ের এক প্রতিনিধি দল, যার মধ্যে আছেন চারজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী৷ তবে ভারতে জার্মান লগ্নি প্রসঙ্গে একটা অসন্তোষের কথা বারংবার উঠেছে৷ আর সেটা হলো অনুকূল বাণিজ্যিক পরিবেশের জন্য লালফিতার ফাঁস আলগা করতে হবে৷ ভারতের তরফে মোদী সরকার জামার্ন লগ্নির জন্য ‘ফাস্ট-ট্র্যাকের' সুবিধা দিতে রাজি হয়েছে৷ বলেছে আমলাতান্ত্রিক বিধিনিষেধ সহজ সরল করার কথাও৷ উল্লেখ্য, ভারতে বর্তমানে প্রায় ১৬০০টি জার্মান কোম্পানি কাজ করছে, যার মধ্যে ৬০০টি ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রে৷ দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ ২০১৪ সালে ছিল প্রায় ১৮০০ কোটি ইওরো৷ শুধু তাই নয়, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বাস্তবায়নের লক্ষে নতুন উদ্যোগের কথাও বলা হয়েছে৷ সেক্ষেত্রে ইউরোপের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে জার্মানির ভূমিকা অনস্বীকার্য৷
মোদী সরকার আসার পর ভারত ও জার্মানির মধ্যে ভারতীয় স্কুলগুলিতে জার্মান ভাষার পঠন-পাঠন নিয়ে একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল৷ এই সফরে তা দূর হয়েছে৷ স্থির হয় ভারতের কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়গুলিতে ত্রিভাষা সূত্রের অধীনে জার্মান ভাষা আগের মতোই থাকবে৷ পাশাপাশি জার্মানির স্কুলগলিতেও হিন্দি ভাষা চালু করা হবে৷ চ্যান্সেলার ম্যার্কেল মোদীর হাতে ভারত থেকে পাচার হওয়া প্রাচীন একটি দুর্গা মূর্তি তুলে দেন, যেটি এতদিন রাখা ছিল স্টুটগার্ট মিউজিয়ামে৷ আসন্ন দুর্গা পূজার মরশুমে এটাকে এক শুভচিহ্ণ বলে মনে করছে সবাই৷
জার্মান ভাষা জানার বিকল্প নেই
জার্মান ভাষা আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত৷ ভারত-বাংলাদেশের মতো বিশ্বের আরো অনেক দেশে এ ভাষা শেখার জন্য রয়েছে গ্যোটে ইন্সটিটিউট৷ তবে জার্মানিতে থেকে সে’ দেশের ভাষা না জানলে যে পদে পদে সমস্যা!
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
যদি ভাষা জানেন, সুবিধা পাবেন
যে কোনো দেশে থাকতে হলে সে দেশের ভাষা জানা খুবই জরুরি৷ তা না হলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার তেমন কোনো সুযোগই থাকেনা৷ ভাষা না শেখার কারণে খালিদ, আইচো, শিরিয়া, আরিয়ানা বা রাইসার মতো অনেকেই নিজের দেশে চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করলেও জার্মানিতে শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে৷
ছবি: Doc RaBe - Fotolia.com
সেবিকা থেকে ক্লিনার
শিরিয়া কসোভো থেকে বেশ কয়েকবছর আগে স্বামী, সন্তান নিয়ে জার্মানিতে এসেছে৷ নিজের দেশে একটি হাসপাতালে নার্স বা সেবিকা হিসেবে কাজ করতো৷ প্রথমে ভাষা শেখাটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি বলে আর শেখাও হয়নি৷ বেঁচে থাকার জন্য এখন তাকে অন্যের বাড়িতে ক্লিনারের কাজ করতে হচ্ছে৷ জার্মান ভাষা জানা থাকলে সহজেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে হয়তো আবারও সেবিকার কাজ পেতে পারতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খালিদের অনেক দুঃখ
খালিদ পোল্যান্ডের একটি কন্সট্রাকশন ফার্মে সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করতো৷ ভাষা শেখেনি, তাই এখন নিজেকেই এ সব কাজে হাত লাগাতে হচ্ছে৷ ভাষা না শেখার কারণ জানতে চাইলে কিছুই বলেনা৷ তবে এখন বুঝতে পারছে সে ভাষা না শিখে ভুল করেছে এবং মানসিকভাবে অনেক কষ্টও পাচ্ছে৷ যদিও জার্মানিতে কম আয়ের বিদেশিদের জন্য বিনে পয়সায় ভাষা শিক্ষার কোর্স রয়েছে৷
ছবি: Kzenon - Fotolia.com
আরিয়ানা
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষিকা আরিয়ানা প্রায় দশ বছর আগে ইউক্রেন থেকে এসেছে৷ নিজের দেশে টুকটাক জার্মান ভাষা শিখেছিলো, তবে জার্মানিতে এসে আর শেখা হয়নি কোলে বাচ্চা থাকায়৷ তবে ওর স্বামীর জার্মান ভাষা মোটামুটি শেখাতে একটি চাকরি এবং জার্মানিতে থাকার অনুমতি পেয়েছে৷ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে আরিয়ানাকেও কাজ করতে হয়৷ স্বামীর সহায়তায় অগত্যা একটি সরকারি অফিসে মেঝে মোছার কাজই করছে সে এখন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বসনিয়ার মেয়ে মারিয়ম
১৫ বছর বয়সে বাবা মায়ের হাত ধরে জার্মানিতে এসেছে মারিয়ম৷ প্রথমদিকে কিছুটা অসুবিধা হলেও বাবা মায়ের উৎসাহে এবং নিজের মনোবলের কারণে ভালোভাবেই জার্মান ভাষা রপ্ত করতে পেরেছে৷ এখন সে নিজেই চাকরির জন্য অফিসে দরখাস্ত করছে৷ ওর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে৷
ছবি: Bilderbox
জব সেন্টারে ঘোরাঘুরি
অনেকে প্রতি সপ্তাহেই চাকরির খোঁজে জব সেন্টারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ ভাষা না জানার কারণে ওদের জন্য তেমন কোনো চাকরির সুখবরও থাকেনা৷ তবে এরা সরকার থেকে বেকার ভাতা বা সামাজিক ভাতা পায় নিয়মিত৷
ছবি: dpa
ভাষা শিখে স্বপ্ন পূরণ
লায়লা ছোটবেলা থেকেই বাচ্চা ভালোবাসে তার ইচ্ছে বাচ্চাদের সাথে কাজ করবে৷ লায়লার জন্য ভাষা শেখা কোনো সমস্যাই ছিলোনা৷ সাধারণ স্কুলের পাশাপাশি আলাদাভাবে জার্মান ভাষা শেখার ক্লাস সে করেছে৷ যার ব্যয়ভার জার্মান সরকার বহন করেছে৷ কিন্ডারগার্টেনের ট্রেনিং শেষে পছন্দের চাকরিও সে পেয়ে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বখাটে তরুণ
যারা জার্মান ভাষা শেখেনা, তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়৷ কোনো প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র এলেও সেগুলো তারা পড়তে বা বুঝতে পারেনা৷ ফলে সবসময়ই অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়৷ ভাষা না জানা এই প্রজন্মের অনেক ছেলে মেয়েকে পয়সার জন্য অন্যায় পথে পা বাড়াতেও দেখা যায়৷ কেউ কেউ আবার অন্য বাড়ির দরজায় গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে৷
ছবি: fotolia/imageteam
জন্ম থেকে জার্মানিতে, জার্মান ভাষার প্রতি আগ্রহ নেই
জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি রয়েছে৷ যাদের জন্ম জার্মানিতে, জার্মান স্কুলে পড়ে – তারপরও অনেকেই তেমন ভালো জার্মান ভাষা জানেনা৷ কারণ হিসেবে অনেক সময় বলা হয় জার্মান স্কুলের বাইরে অর্থাৎ নিজেদের মধ্য এরা সবসময়ই তুর্কি ভাষায় কথা বলে৷
ছবি: picture-alliance/ZB
নারীদের ভাষা শেখার আগ্রহ খুব কম
নিজ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেকেই জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছেন৷ তাদের মধ্যে পুরুষরা কিছুটা জার্মান ভাষা শিখে বিভিন্ন দোকান, কারখানা, রেস্তোরাঁতে কাজ করছেন৷ এদেশে স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক বলে বাচ্চারাও স্কুলে যায়৷ তবে এসব পরিবারের খুব কম নারী জার্মান ভাষা শেখে৷ অনেক বছর থাকার পরও কথা বলতে পারেন না৷ যদিও এদেশে তুর্কি নারী সংখ্যা বেশি থাকায় তাদের জন্য আলাদাভাবে ভাষা শেখার ব্যবস্থা রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তিন বোন
পোল্যান্ড থেকে আসা এক পরিবারের তিনজন৷ ছোটবোন ভালো জার্মান ভাষা শিখেছে বলে মোটামুটি ভালো বেতনে দোকানে সেলস গার্লের চাকরি করছে৷ দ্বিতীয়জনের জার্মান ভাষার জ্ঞান আরো কম বলে সে একটি ফ্যাক্টরিতে জিনিসপত্র গোছানোর কাজ করে, যেখানে তাকে বেশি কথা বলতে হয়না৷ এবং স্বাভাবিকভাবেই বেতন বেশ কম৷ আর সবচেয়ে বড় বোন একদমই ভাষা জানেনা৷ তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোন বাড়িতে ক্লিনারের কাজও কেউ দিতে চায়না৷