আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের যুদ্ধে আক্রান্ত সাধারণ মানুষ। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দুই দেশের একের পর এক ঘনবসতিপূর্ণ শহর।
বিজ্ঞাপন
আরো তীব্র হয়েছে লড়াই। প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার লড়াইয়ে ধ্বংস হচ্ছে একের পর এক শহর। রেডক্রস থেকে জাতিসংঘ, সকলেই অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের আবেদন জানালেও, আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের সরকার কোনো ভাবেই তাতে রাজি নয়।
রোববার আজারবাইজানের প্রশাসন জানিয়েছে, ককেশাস পর্বতের দক্ষিণে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর গ্যাঞ্জা আর্মেনিয়ার শেলিংয়ে কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই নিয়ে আজারবাইজানের দ্বিতীয় শহর আর্মেনিয়ার বোমা ও গোলাবর্ষণে বিধ্বস্ত হলো।
আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের ছবি
আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে চলছে যুদ্ধ৷ মৃত্যু হয়েছে কয়েকশ মানুষের৷ অন্য কোন দেশ কারো পক্ষে সরাসরি অবস্থান না নিলেও, এই যুদ্ধে তুরস্ক আজারবাইজানকে ইন্ধন দিচ্ছে বলে অভিযোগ আর্মেনিয়ার।
ছবি: Vahram BaghdasaryanReuters
সংঘাতের কারণ
দুই দেশের সীমান্তে ককেশাস পর্বতে বিতর্কিত নাগর্নো-কারাবাখের দখল নিয়ে সংঘাত শুরু হয়েছে। আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান দুইটি দেশই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। সোভিয়েতের পতনের পর দু'টি দেশ আলাদা হয়ে যায়। তখন থেকেই নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে তাদের মধ্যে বিতর্ক।
ছবি: Defence Ministry of Armenia/Reuters
কারাবাখের অবস্থান
দুই দেশের সীমান্তে নাগর্নো-কারাবাখে আর্মেনিয়ার মানুষ থাকেন। তবে এলাকাটি স্বাধীন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে। তাদের নিজস্ব প্রশাসনও আছে। আর্মেনিয়ার যথেষ্ট প্রভাব আছে ওই অঞ্চলে। আজারবাইজানের দাবি, এলাকাটি তাদের ভূখণ্ডের অংশ।
আর্মেনিয়ার বক্তব্য আজারবাইজান জোর করে নাগর্নো-কারবাখের দখল নিতে চাইছে। ওই অঞ্চলে আর্মেনীয় মানুষ বাস করেন। ফলে কোনোভাবেই তা আজারবাইজানের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। তারাও যুদ্ধ থামাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
ছবি: Armenian Defense Ministry/AP/picture-alliance
তুরস্কের অবস্থান
আর্মেনিয়ার বক্তব্য, তুরস্ক যুদ্ধে আজারবাইজানকে সাহায্য করছে। তুরস্কের যুদ্ধবিমান আর্মেনিয়ার যুদ্ধবিমানকে ধ্বংস করেছে বলেও অভিযোগ। তুরস্ক এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে তারা যে আজারবাইজানের পক্ষে, তুরস্ক সে কথা জানিয়ে দিয়েছে।
ছবি: Armenian Defense Ministry
মৃত্যু হচ্ছে কাদের
দুই দেশের এই যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করছেন সামরিক-বেসামরিক নাগরিক। শুক্রবার পর্যন্ত প্রায় ২০০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে বার্তা সংস্থা এএফপি৷ এর মধ্যে ৩০ জনের বেশি বেসামরিক নাগরিক৷ অন্যদিকে কারাবাখের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সরকার’ তাদের ৫৪ জন সৈন্য নিহত হয়েছে বলে শুক্রবার দাবি করেছে৷
ছবি: Celestino Arce Lavin/Zuma/picture-alliance
বিশ্বের অবস্থান
যুদ্ধ বন্ধের আর্জি জানিয়েছে বিশ্বের বহু দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। রাশিয়া, অ্যামেরিকা, ফ্রান্স যৌথ বিবৃতি পেশ করেছে।
ছবি: Vahram BaghdasaryanReuters
7 ছবি1 | 7
বস্তুত, শনিবার থেকে দুই দেশই দূরপাল্লার কামান ব্যবহার করতে শুরু করেছে। বিভিন্ন শহর লক্ষ্য করে কামান দাগা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের কথা ভাবাও হচ্ছে না বলে অভিযেোগ। প্রাথমিক ভাবে গ্যাঞ্জা ধ্বংসের কথা অস্বীকার করেছিল আর্মেনিয়া। দেশের প্রশাসন জানিয়েছিল, কোনো ভাবেই সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো হচ্ছে না। কিন্তু পরে আর্মেনিয়ার সেনার সাহায্যপ্রাপ্ত নাগর্নো-কারাবাখের বিচ্ছিন্নতাবাদী সেনা জানায়, গ্যাঞ্জায় আজারবাইজানের সেনা ছাউনি লক্ষ্য করে কামান দাগা হয়েছিল।
আজারবাইজান জানিয়েছে, সেই শেলিংয়েই বহু সাধারণ মানুষের বাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। গ্যাঞ্জায় প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। তাঁদের এক বড় অংশ এখন গৃহহীন।
আজারবাইজান, আর্মেনিয়ার মধ্যে সংঘাতের কারণ কী?
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷ বিস্তারিত ছবিঘরে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
সংঘাতের কারণ
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷
ছবি: Defence Ministry of Azerbaijan/Reuters
নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল কোথায়?
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অঞ্চলটি আজারবাইজানের অংশ৷ পাহাড় ও বন ঘেরা দুর্গম এই অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাস করেন৷ তাদের বেশিরভাগই আজারবাইজানের শাসনের বিরোধী আর্মেনীয়৷ অঞ্চলটির আয়তন প্রায় চার হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার৷
প্রথম সংঘাত
গত শতকের আশির দশকের শেষদিকে যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়া চলছে, তখন থেকেই নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাতের শুরু৷ ১৯৯৪ সালে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এই সংঘাত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রাণ হারান প্রায় ৩০ হাজার মানুষ৷ সংঘাতের কারণে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আর্মেনীয়দের হাতে৷
ছবি: Reuters/Photolure/V. Baghdasaryan
আর্মেনিয়ার সহায়তা
১৯৯৪ সালের পর থেকে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে আর্মেনিয়া৷ এছাড়া সারা বিশ্বে থাকা আর্মেনীয়রাও ঐ অঞ্চলের জন্য দান করে থাকেন৷ ছবিতে কারাবাখের সবচেয়ে বড় শহর স্টেপানাকিয়ার্ট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Zuma/imago images
মাঝেমধ্যেই সংঘাত
যুদ্ধবিরতি চললেও নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের সৈন্যদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ ২০১৬ সালে এক সংঘাতে (ছবি) প্রায় ২০০ জন প্রাণ হারান৷ এছাড়া গত জুলাইতেও মোটামুটি বড় আকারের সংঘাত হয়েছিল৷ রবিবার শুরু হওয়া সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন৷ নিহতদের অন্তত ১১ জন বেসামরিক নাগরিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Baghdasaryan
আবার কেন সংঘাত?
জুলাইয়ের সংঘাতের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার সমাধানে ততটা আগ্রহ দেখায়নি৷ অতীতে রাশিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র ঐ অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে মধ্যস্থতা করলেও বর্তমানে করোনা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, বেলারুশ, লেবানন পরিস্থিতি ইত্যাদির কারণে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের দিকে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেয়া যায়নি৷ তাই রবিবার থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
এবারের সংঘাত কতটা বড়?
‘জর্জিয়ান স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিসিস সেন্টার’-এর সিনিয়র ফেলো গেলা ভাসাদজে বলছেন, ১৯৯০ দশকের পর এই ‘প্রথম’ আর্মেনিয়া ও কারাবাখ ঐ অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক যান জড়ো করছে৷ আজারবাইজানও সামরিক আইন জারি করেছে৷ এছাড়া আকাশ থেকে হামলা চালানোর সিস্টেম, ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি সবকিছুর ব্যবস্থা করছে দেশটি৷
খ্রিস্টানপ্রধান আর্মেনিয়ার সবচেয়ে বড় বন্ধু রাশিয়া৷ তাদের সঙ্গে সামরিক চুক্তিও আছে দেশটির৷ আর মুসলমানপ্রধান দেশ আজারবাইজানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি আছে তুরস্কের৷ তবে বিশ্লেষক গেলা ভাসাদজে বলছেন, রাশিয়া ও তুরস্ক হয়ত সরাসরি এই সংঘাতে যুক্ত হবে না, কারণ, এতে যুক্ত হয়ে খুব বেশি লাভ নেই৷ বরং এর ফলে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/AP/picture alliance
রাশিয়ার সুযোগ
বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোকে সমর্থন জানিয়ে এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিনের বিরোধী নাভালনিকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ সমালোচনার মুখে আছে রাশিয়া৷ এই অবস্থায় রাশিয়া যদি আলোচনার মাধ্যমে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলে বিশ্বমঞ্চে রাশিয়া প্রশংসিত হতে পারে৷ পুটিন ইতিমধ্যে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে৷
ছবি: picture-alliance/Russian Look/Belarus 24 TV
9 ছবি1 | 9
রোববারে ঘটনার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছে আজারবাইজানের প্রধানমন্ত্রী। আর্মেনিয়া কী ভাবে সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করছে, সে কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন, বিতর্কিত নাগর্নো-কারাবাখের দখল না নেওয়া পর্যন্ত লড়াই বন্ধ হবে না। সাধারণ মানুষকেও নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
আজারবাইজানের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করেছে আর্মেনিয়া। তাদের বক্তব্য, নাগর্নো-কারাবাখের দুইটি শহর কামান দেগে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে আজারবাইজানের সেনা। সেখানেও বহু সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আজারবাইজান অবশ্য জানিয়েছে, কেবলমাত্র আর্মেনিয়ার সেনা ঘাঁটি লক্ষ্য করেই আক্রমণ চালানো হচ্ছে।
যে ভাবে দুই দেশের লড়াইয়ে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে রেডক্রস। তারা জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধের নিয়মও মানছে না দুই দেশ। ফলে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক মঞ্চ প্রায় প্রতিদিনই দুই দেশকে লড়াই থামিয়ে আলোচনার টেবিলে বসার অনুরোধ করছে। কিন্তু আপাতত আলোচনায় বসার কোনও ইঙ্গিত দেয়নি দুই দেশের সরকার।