প্রতি বছর সারা বিশ্বে এই দিনে পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস৷ আজও হবে৷ তবে এবারের ‘নারী দিবস’ অন্যরকম৷ এ বছর এই দিনেই মুক্তি পাবে তথ্যচিত্র ‘ইন্ডিয়া’জ ডটার’৷ তাই শুধু আন্তর্জাতিক নারী দিবসই নয়, ‘ভারত-কন্যা দিবস’-ও আজ৷
বিজ্ঞাপন
প্রতিবছরের মতো এবারও আন্তর্জাতিক নারী দিবসে জানা যাবে, বিশ্বের কোন প্রান্তে কত নারী কতভাবে নির্যাতিত হলো, ধর্ষণের শিকার হয়ে কিংবা যুদ্ধের বলি হয়ে পৃথিবী ছেড়ে গেল কত নারী৷ নারীর দুর্ভোগের নানান চিত্রের মাঝেই মুক্তি পাবে ব্রিটেনের লেসলি উডউইন পরিচালিত তথ্যচিত্র ‘ইন্ডিয়া'জ ডটার'৷
ভারত সরকার তথ্যচিত্রটির প্রদর্শন এবং প্রচার দেশের মাটিতে ‘ব্যান’ বা নিষিদ্ধ করলেও, ব্রিটেনে ডকুমেন্ট্রিটি ইতিমধ্যেই দেখানো হয়েছে৷ ৪ঠা মার্চ বিবিসি ফোর-এ দেখানো হয়েছে এটি৷ এছাড়াও আজ ডেনমার্ক, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে এবং ক্যানাডার টেলিভিশন চ্যানেলে একযোগে দেখানো হবে ‘ইন্ডিয়াজ ডটার’, যাতে এক ধর্ষককে দেখা যাবে৷ ছয়শ' কোটি মানুষের এ বিশ্বের অনেকেই আজ শুনবে তার ‘বাণী'৷
মুকেশ সিং নামের এই ধর্ষকই ২০১২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর চলন্ত বাসে চার সঙ্গীকে নিয়ে তরুণী ‘নির্ভয়া'-কে ধর্ষণ করে৷ তাদের উপর্যুপরি ধর্ষণ এবং প্রহারে তরুণীটি পরে মারাও যান৷ শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়া এই ধর্ষণকাণ্ডে জড়িতদের মধ্যে চারজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বয়স কম হওয়ায় একজনকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয় ভারতের দ্রুত বিচার আদালত৷ মুকেশ সিংহকেও দেয়া হয় মৃত্যুদণ্ড৷
কেন এত ধর্ষণ? কী করলে কমবে এ জঘন্য অপরাধ?
নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, নারী অধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা, বক্তৃতা, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা৷ কিন্তু কেন? এর জন্য কারা দায়ী, কী করে ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব? বা ধর্ষিতা নারীদের কী-ই বা করা উচিত?
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ তার ওপর পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়৷ এছাড়া বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ নাকি জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Fotolia/DW
উন্নত বিশ্বের নারীরাও রেহাই পান না
ধর্ষণ শব্দটি শুনলেই মনে হয় এ ধরণের অপরাধ হয়ে থাকে শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে৷ আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়৷ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৩ জন মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷ এমনকি জার্মানির মতো উন্নত দেশের নারীরাও যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷
ছবি: Fotolia/detailblick
ধর্ষিতা নারীরা জানাতে ভয় পান
জার্মানিতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত নারীদের সঠিক পদ্ধতিতে ‘মেডিকেল টেস্ট’-এর ব্যবস্থা করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. সোনিয়া পিলস বলেন, ‘‘ধর্ষণের শিকার নারী লজ্জায় এবং আতঙ্কে থাকেন৷ তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা বা ধর্ষক সম্পর্কে তথ্য জানাতে ভয় পান, কুণ্ঠা বোধ করেন৷ অনেকদিন লেগে যায় ধর্ষণের কথা কাউকে বলতে৷
ছবি: detailblick/Fotolia
ধর্ষককে ধরার জন্য দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা
ধর্ষণের পর নারীদের কী করণীয় – এ বিষয়ে জার্মানির ধর্ষণ বিষয়ক নির্দেশিকায় কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন ধর্ষণের পর একা না থেকে কারো সাথে কথা বলা৷ গোসল, খাওয়া, ধূমপান, বাথরুমে যাওয়ার আগে, অর্থাৎ ধর্ষণের চিহ্ন মুঝে না যাবার আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো৷ এ পরীক্ষা করালে ধর্ষক কোনো অসুখ বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত ছিল কিনা, তা জানা সম্ভব৷ নারীর শরীরে নখের আচড় বা খামচি থাকলে ধর্ষকের চিহ্ন সহজেই পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/M. Ruettinger
যাঁরা ধর্ষণের শিকার, তাঁদের জন্য জরুরি বিভাগ
ধর্ষক যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে, অর্থাৎ অন্তর্বাস, প্যাড এ সব তুলে রাখুন৷ ছবিও তুলে রাখতে পারেন৷ নিজেকে দোষী ভাববেন না, কারণ যে ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি করেছে – সেই অপরাধী, আপনি নন৷ জার্মানির বেশ কয়েকটি শহরের হাসপাতালে যৌন নির্যাতন বিষয়ক আলাদা জরুরি বিভাগ রয়েছে৷ তাছাড়া ধর্ষণ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে রয়েছে ‘গেভাল্ট গেগেন ফ্রাউয়েন’, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই টেলিফোন করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গ্রুপ থেরাপি
যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার নারীদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্য জার্মানিতে রয়েছে গ্রুপ থেরাপি, যার সাহায্যে নারীরা আবার সমাজে সহজভাবে মিশতে পারেন এবং তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি সহজে ভুলে যেতে পারেন৷
ছবি: dpa
সবচেয়ে বেশি যৌন অপরাধ হয় বাড়িতেই
ভারতের কোথাও না কোথাও প্রতি ২২ মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে৷ তাই আদালতের নির্দেশে ভারতের পুলিশ বিভাগ এক সমীক্ষা চালিয়েছিল দিল্লির ৪৪টি এলাকায়৷ চলতি বছরের গত আট মাসে ২,২৭৮টি ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং যৌন অপরাধের তদন্তের ফলাফলে দেখে গেছে: ১,৩৮০টি ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হলেন পরিবারের লোকজন এবং পরিচিতজনেরা৷ অর্থাৎ নিজের বাড়িতেও মেয়েরা নিরাপদ নয়!
ছবি: Fotolia/Miriam Dörr
সঠিক বিচার চাই
২০১৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিল্লিতে গণধর্ষণ ঘটনার পর, ভারতে ঘটা করে বিচার বিভাগীয় কমিশন বসিয়ে ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ দমনে আইন-কানুন ঢেলে সাজানো হয়৷ শাস্তির বিধান আরো কঠোর করা হয়৷ কিন্তু তাতে যৌন অপরাধের সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে৷
ছবি: picture alliance/abaca
বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার
বাংলাদেশে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ সালে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ছ’মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ করে ধর্ষণ এবং পরে হত্যার ঘটনাও অনেক বেড়েছে৷
ছবি: DW
নারীর পোশাকই কি ধর্ষণের জন্য দায়ী?
বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশের নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়াভাবে, বেপর্দায় চলাফেলার কারণে ধর্ষণের শিকার হন৷’’ পুলিশের কর্মকর্তার দাবি, ধর্ষণের দায় প্রধানত নারীদের৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বখাটে ছেলেরা তো ঘোরাফেরা করবেই৷’’ এ কথা শুধু পুলিশ কর্মকর্তার নয়, ভারত-বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাই এরকম৷ ধর্ষণ বন্ধ করতে এই মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
ছোট বেলা থেকে সচেতন করতে হবে
ধর্ষণ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে সঠিক ধারণা দিলে স্বাভাবিকভাবে ধর্ষণের সংখ্যা কমবে৷ তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷ ধর্ষিতা নারীকে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়, সে সম্পর্কেও সচেতনতা দরকার৷ অনেকে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ গোটা সমাজও নারীকেই দোষ দিয়ে থাকে৷ ডাক্তারি বা মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য ছাড়াও প্রয়োজন পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের বন্ধুবৎসল আচরণ৷
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
11 ছবি1 | 11
গ্রেপ্তারের পর ধর্ষণের অভিযোগ স্বীকার করে মুকেশ৷ তবে তার দাবি, পুলিশ নির্যাতন চালিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করেছে, আসলে সে ধর্ষণ করেনি৷ অবশ্য ‘ইন্ডিয়া'জ ডটার' তথ্যচিত্রে ধর্ষণের পক্ষে কথা বলতেই শোনা যাবে তাকে৷ তথ্যচিত্রটির নির্মাতা জানান, তিহার জেলে গিয়ে মুকেশের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তিনি৷ সেই সাক্ষাৎকার থেকেই তৈরি হয়েছে ‘ইন্ডিয়া'জ ডটার'৷ সাক্ষাৎকারে কৃতকর্মের জন্য মুকেশকে একটুও অনুতপ্ত মনে হয়নি৷ বরং ঘটনার জন্য ধর্ষিতাকে দায়ী করে মুকেশ বলেছে, ‘‘ধর্ষণের ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি দায়ী৷''
অভিশপ্ত ২০১২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর রাতে বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার জন্য বাসে উঠেছিলেন এক তরুণী৷ বন্ধুকে পিটিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দিয়ে তরুণীকে ধর্ষণ করে মুকেশ এবং তার সঙ্গীরা৷ ধর্ষণে বাধা দেয়ায় তরুণীকে বেদম পেটানো হয়৷ প্রায় দু'সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়ার পর হার মানেন ২৩ বছরের ফুটফুটে মেয়েটি৷
লেসলি উডউইনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মুকেশ বলে, ধর্ষণে সাধারণত মেয়েরাই দায়ী৷ এর কারণ হিসেবে সে বলে, ‘‘ভদ্রঘরের মেয়েরা রাত ন'টার পরে বাড়ির বাইরে থাকে না৷'' মুকেশ মনে করে, রাত-বিরেতে ঘরের বাইরে গেলে মেয়েরা ধর্ষণের স্বীকার হবে – এটাই স্বাভাবিক৷ মৃত্যুর জন্য মেয়েটিকে দায়ী করে ধর্ষণের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মুকেশ বলেছে, ‘‘মেয়েটির ধর্ষণে বাধা দেয়া ঠিক হয়নি৷ ওর উচিত ছিল চুপ করে থেকে ধর্ষণে সহায়তা করা৷''
মুকেশ মনে করে, একটা ধর্ষণ নিয়ে সংবাদমাধ্যম যা করছে, তা খুব বাড়াবাড়ি৷ সবাইকে বিস্মিত করে সে আরো বলে,‘‘ওরা (মিডিয়া) এত বাড়াবাড়ি করছে কেন, সকলেই তো এ সব (ধর্ষণ) করছে৷'' ধর্ষণের অপরাধে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া কি ঠিক? মুকেশের জবাব, ‘‘না, তাহলে কেউ ধর্ষণ করলে আমরা যেভাবে মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়েছিলাম, সেভাবে ছেড়ে দেবে না৷ সঙ্গে সঙ্গেই মেরে ফেলবে৷'’
ধর্ষণ নিয়ে কথা বলার সময় এক মুহূর্তের জন্যও বিচলিত, লজ্জিত বা ভীত দেখায়নি মুকেশ সিংকে৷ তথ্যচিত্র নির্মাতা লেসলি উডউইন জানান, ১৬ ঘণ্টার সাক্ষাৎকার চলার সময় মুকেশকে অনেকভাবে কাঁদানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি৷ মুকেশকে জীবন্ত এক রোবট মনে হয়েছে তাঁর৷
আজ এক ধর্ষকের কথায় নারী জাতিকে অপমানিত হতে দেখবে সারা বিশ্ব৷ আজ ‘ভারত-কন্যা' দিবস৷ আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসও বটে!