জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছে বাংলাদেশ৷ জঙ্গি সন্দেহে গত এক সপ্তাহে মোট পাঁচজন নারীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে৷ প্রশ্ন উঠেছে, গুলশান হামলার সঙ্গে এদের সম্পর্ক কী? জঙ্গি তৎপরতায় তারা কি সত্যিই জড়িত?
বিজ্ঞাপন
আটকদের মধ্যে রুমা আক্তারকে বুধবার নরসিংদী থেকে আটক করা হয়৷ বাকি চারজন – নাদিরা তাবাসুম রানী, হাবিবা আকতার মিশু, রুমানা আকতার ও রুনা বেগমকে আটক করা হয় শনিবার, সিরজগঞ্জ থেকে৷
পুলিশের কথায়, নরসিংদী থেকে আটক রুমা ১লা জুলাই গুলশান হামলার সময় ঘটনাস্থলে ছিল৷ সিসিটিভি-র ফুটেজে নাকি তাকে দেখা গেছে৷ তাই সেই ফুটেজের ভিত্তিতেই তাকে আটক করা হয়৷ পুলিশ জানায়, রুমা ইশারা দেয়ার পরই দুই জঙ্গি গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের ভিতরে প্রবেশ করে৷
রুমার বাবা শাহাবুদ্দিন শেখ অবশ্য রুমাকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে দাবি করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘বেশিরভাগ সময়ই আমার মেয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ থাকে৷ আর এ কথা পুরো গ্রামবাসীই জানে৷ তাই রুমা কোনোভাবেই জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত থাকতে পারে না৷’’
ধর্মের রাজনীতি ও তরুণ প্রজন্ম
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসার ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে উৎসাহ, উদ্বেগ দুই-ই আছে৷ আর সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দল ও ইসলামপন্থিদের উত্থানের বিষয়টিকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ৷ ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে কী ভাবছে আজকের প্রজন্ম?
ছবি: Reuters
পিয়ান মুগ্ধ নবীর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষার্থী পিয়ান মুগ্ধ নবীর কাছে ধর্ম বিষয়টা পুরোপুরি ব্যক্তিগত হলেও রাজনীতি ব্যক্তিগত বিষয় নয়৷ তবে ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে তিনি কখনোই সমর্থন করেন না৷
ছবি: DW
শিবরাজ চৌধুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী শিবরাজ চৌধুরী৷ তার মতে, ধর্ম এবং রাজনীতি কখনোই এক হতে পারে না৷ ধর্মের মূল বিষয় মনুষত্ব বা মানুষের মধ্যকার শুভবোধ৷ তবে ধর্মের নামে যদি কখনো মৌলবাদ কিংবা চরমপন্থা চলে আসে, সেটা কখনোই গ্রহনযোগ্য নয়৷
ছবি: DW
শিহাব সরকার
ঢাকার একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী শিহাব সরকার৷ তার মতে, ধর্ম ধর্মের জায়গায় আর রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়৷ বলা বাহুল্য, ধর্মের নামে রাজনীতি তিনিও সমর্থন করেন না৷
ছবি: DW
আসিফ হামিদী
আসিফ হামিদীও মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন৷ তিনিও মনে করেন ধর্ম এবং রাজনীতি কখনোই এক হতে পারে না৷ তাই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ঘোর বিরোধী তিনি৷
ছবি: DW
মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর
ঢাকার একটি মাদ্রাসা থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করেছেন মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর৷ তাঁর মতেও রাজনীতি ধর্মভিত্তিক হতে পারে না৷ তবে আল্লাহ এবং রাসুলের কিংবা ইসলামের উপর কোনোরকম আঘাত আসলে তার বিরোধীতা করা সব মুসলমানের নৈতিক দ্বায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: DW
সাদমান আহমেদ সুজাত
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদমান আহমেদ সুজাত৷ তাঁরও ঐ এক কথা৷ ‘‘ধর্ম এবং রাজনীতি কখনো এক হতে পারে না৷’’ তিনি জানান, ‘‘ধর্ম আমরা সাধারণত জন্মগতভাবে পাই, কিন্তু রাজনীতিকে আমরা অনুসরণ করি৷’’
ছবি: DW
সাজ্জাদ হোসেন শিশির
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন শিশির৷ তাঁর মতে, রাজনীতি সবসময়ই ধর্ম নিরপেক্ষ হওয়া উচিত৷ তাঁর বিশ্বাস, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেললে তার ফল কখনো ভালো হয় না৷
ছবি: DW
দাউদুজ্জামান তারেক
ঢাকার আরেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দাউদুজ্জামান তারেক মনে করেন, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কখনো মিল হতে পারে না৷ কারণ বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা একই রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসরণও করতে পারেন৷
ছবি: DW
8 ছবি1 | 8
এলাকাবাসীও জানায় যে, স্বামী পরিত্যক্ত হওয়ার পর থেকে গত ৯ বছর ধরে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন রুমা৷ তার বড় বোন সাবিনা আক্তার বলেন, ‘‘গুলশান হামলার সময় টিভিতে খবর দেখে আমি রুমাকে ফোন করেছিলাম৷ সে কোথায় জানতে চাইলে রুমা বলে যে, সে ঘটনাস্থলের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে কী হচ্ছে৷ আমি বলেছিলাম, ওখান থেকে চলে আয়৷ তখন সে বলে, ‘আমি তো অনেকক্ষণ ধরে দেখছি৷’’’
এদিকে সিরাজগঞ্জের একটি টিনশেডের ভাড়া বাসা থেকে শনিবার গভীর রাতে আটক করা হয় অন্য চারজন নারীকে৷ বাসায় তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ ১৩টি জেহাদি বই, ছ’টি তাজা ককটেল ও গ্রেনেড তৈরির চারটি খোল ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উদ্ধার করে৷ পুলিশের দাবি, এই চারজন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবি-র সদস্য৷
জানা যায়, এরা সকলেই বিবাহিত৷ তাই পুলিশ এখন তাদের স্বামী এবং আত্মীয়স্বজনকে খুঁজছে৷ এর আগে জেএমবি-র আরো ন’জন সন্দেহভাজনকে সিরাজগঞ্জ থেকে আটক করেছিল পুলিশ৷
পুলিশের দাবি, জেএমবি-র এ সব সক্রিয় নারী সদস্য গত তিন মাস ধরে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল৷ তারা সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে জেএমবি-র সদস্য সংগ্রহ, সাংগঠনিক এবং নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছিল৷
এ নিয়ে সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মিরাজ উদ্দিন আহমদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আটক নারীরা সরাসরি জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত ছিল৷ এরা বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছিল৷ তাই তাদের রিমান্ডের আবেদন জানিয়েছি৷ জিজ্ঞাসাবাদে আরো তথ্য জানা যাবে৷’’
[No title]
এই নারীদের সঙ্গে গুলশান হামলার কোনো সংযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে এসপি বলেন, ‘‘সেটা এখনো নিশ্চিত নয়৷ জিজ্ঞাসাবাদ ও আরো তদন্তের পরই সেটা বলা যাবে৷’’
প্রিয় বাংলাদেশ, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস রুখে দাঁড়াও
ওদিকে সোমবার জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলা এই মানবন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও অংশ নেন৷
মানববন্ধনে স্লোগান ছিল ‘প্রিয় বাংলাদেশ, ....জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস রুখে দাঁড়াও৷’ মানববন্ধন চলার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক সকল কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল৷ মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, প্রো-ভিসি ড. মো. আখতারুজ্জামান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান, অধ্যাপক ড. মো. ইব্রাহীম, অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী, অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির, অধ্যাপক আতাউর রহমান বিশ্বাস, অধ্যাপক আতাউর রহমান মিয়াজী, সহকারী অধ্যাপক এমডি রহিম, এটিএম শামসুজ্জোহা, ইফতেখারুল ইসলাম, ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ প্রমুখ৷
প্রিয় পাঠক, এ ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন নীচে মন্তব্যের ঘরে...
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ব্লগারদের উপর বিভিন্ন হামলায় মাদ্রাসা এবং সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জড়িত থাকার কথা বলছে গোয়েন্দারা৷ এই নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মহলে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
অভিযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে
২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি বা এনএসইউ-এর পাঁচ ছাত্র৷ তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়৷ এরা সকলেই ছিল আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের মগজ ধোলাই
ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের ভুলিয়েভালিয়ে দলে নিচ্ছে জঙ্গিরা, এমন ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতরা তাই জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের জন্য আগামীতে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করার কথাও ভাবছেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
আছে বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট-এর ছাত্র মোহাম্মদ নুরউদ্দনি এবং আবু বারাকাত মোহাম্মদ রফকিুল হাসান হাসানকে বুয়েট থেকে বহিষ্কার করে পুলিশে দেয়া হয় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
হিযবুত তাহরীরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীরের প্রধান মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববদ্যিালয়ের আইবিএ-র শিক্ষক ছিলেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও রয়েছে
কওমি মাদ্রাসাগুলোকে জঙ্গিবাদের কারখানা বলা হতে একসময়৷ সেই বাস্তবতা মুছে যায়নি৷ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আটক দু’জন নিজেদের মাদ্রাসার শিক্ষার্থী দাবি করেছেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
সতর্ক পুলিশ
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এবং জঙ্গি বিষয়ক বিশেষ সেলের সদস্য সানোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের একাংশ এখন জঙ্গি তৎপরতার দিকে ঝুঁকছে৷ আর যারা অপারেশনে অংশ নিচ্ছে, তারাও বয়সে তরুণ এবং ছাত্র৷''