যশোরে মানবাধিকার বিষয়ক এক কর্মশালায় পুলিশকে আটক বাণিজ্য বন্ধ করতে বলেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান৷ তাঁর কথায়, সবাই আইন অনুযায়ী কাজ করলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কমে আসবে৷
বিজ্ঞাপন
মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার পর স্পষ্ট হয়েছে যে আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে৷ এখানে কোনো ধরনের অবৈধ বা অন্যায় প্রভাব খাটিয়ে আইনকে পাশ কাটিয়ে চলতে দেয়া যাবে না৷ সেই যুগের শেষ হয়েছে৷’’
বৃহস্পতিবার যশোরের ঐ কর্মশালায় উপস্থিত পুলিশের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘পুলিশের আটক বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত অন্তত ১২৮ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার জন্য সরকার দুর্নীতি দমন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে৷ আপনাদের অনুরোধ করব, আপনাদের অধীনে যাঁরা আছেন তাঁরা যেন কোনোভাবে আটক বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকেন৷’’
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
তিনি বলেন, ‘‘এদিকে সবাইকে সজাগ এবং সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে৷ কেননা, এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন৷ এর কারণেই দরিদ্র মানুষ আইনের অধিকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন৷’’ তাই পুলিশকে আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য অনুরোধ করেন অধ্যাপক রহমান৷ এক্ষেত্রে কোনো বাধার সম্মুখীন হলে তাঁকে জানানোর কথাও বলেন তিনি৷
বিচারকদের উদ্দেশ্যে ড. মিজান বলেন, ‘‘বিচার বিভাগকেও তাদের বিবেককে জাগ্রত করে বিচারকাজ পরিচালনা করতে হবে৷ আমাদের বিচারকেরা যদি দরিদ্রবান্ধব না হন, দরিদ্র মানুষের কান্না যদি আপনাদের হৃদয়কে স্পর্শ না করে, তাঁদের কান্না-দুঃখ-কষ্ট যদি আপনার দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে, তাহলে সেই আদালত, সেই বিচারক ও সেই বিচার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা দেশে ফুরিয়ে যাবে৷ এখন কিন্তু আপনাদের ওপর যতটুকু আস্থা রয়েছে, ধীরে ধীরে তা বৃদ্ধি করা সম্ভব৷’’ তাঁর কথায়, ‘‘এ দেশকে আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না৷ সবাই নতুন যাত্রা শুরু করেছে৷ সেখানে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকতে পারে না৷’’
কর্মশালা শেষে ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে টেলিফোন মারফত পুলিশের আটক বাণিজ্যের ব্যখ্যা দিয়ে বলেন, ‘‘মামলার এজাহারে কয়েকজনের নাম দিয়ে অজ্ঞাত পরিচয় আরো ব্যক্তিদের কথা বলা হয়েছে৷ এই সুযোগেই নিরীহ মানুষকে আটক করে ঘুস আদায়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে অনেকের বিরুদ্ধে৷ অর্থাৎ সাম্প্রতিক সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার পিছনে রয়েছে অবৈধ ঘুস বাণিজ্য৷ এছাড়া মামলার ভয় দেখিয়ে এবং অযথা আটক করেও বাণিজ্য করে চলেছে পুলিশের এক শ্রেণির সদস্যরা৷’’
ড. মিজান বলেন, ‘‘নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনাও প্রমাণ করে যে, আইনের বাইরে গিয়ে কতিপয় র্যাব সদস্য বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়েছেন৷ তাঁরা যদি আইন মানতেন এবং আইন মানার জন্য মনিটরিং ও চাপ থাকতো, তাহলে এই ঘটনা ঘটতো না৷’’
অধ্যাপক রহমানের কথায়, ‘‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আইনের ভিতরে থেকেই কাজ করতে হবে৷ আইনের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ সবাইকে আইনি সীমার মধ্যেই থাকতে হবে৷’’