১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আডল্ফ হিটলারের চ্যান্সেলর হিসেবে উত্থান বিশ্ব ইতিহাস বদলে দিয়েছিল৷ বার্লিনে নতুন এক প্রদর্শনী জানাচ্ছে কীভাবে এই পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো৷
বিজ্ঞাপন
১৯৩০ সালের শুরুর দিকে মনে হচ্ছিল আডল্ফ হিটলার এবং তার নাৎসি দল সম্ভবত জার্মানির ক্ষমতা নিতে পারবে না৷
১৯৩২ সালের শরৎকাল নাগাদ নাৎসি দল সমর্থন হারাতে শুরু করে৷ তখন ইউরোপের দেশটি অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছিল৷ সে বছরের নভেম্বরের কেন্দ্রীয় নির্বাচনে, যেটিকে নাৎসিরা ক্ষমতায় যাওয়ার আগে সর্বশেষ অবাধ এবং মুক্ত নির্বাচন বিবেচনা করা হয়, হিটলারের ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি অধিকাংশ ভোট পেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়৷ অর্থাৎ রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে হিটলারের জোট গড়ার প্রয়োজন হয়৷
নাৎসি বিচারের সাক্ষী ‘কোর্টরুম ৬০০’
হলোকস্ট ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত ‘ন্যুরেমব্যার্গ ট্রায়াল’৷ আদালতের যে কক্ষে ঐ বিচারকাজ হয়েছিল সেটা এখন জাদুঘর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
নাৎসিদের বিচার
হলোকস্টসহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত ‘ন্যুরেমব্যার্গ ট্রায়াল’৷ ১৯৪৫ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ১৯৪৬ সালের ১ অক্টোবর পর্যন্ত চলা এই বিচার কার্যক্রমের মাধ্যমে উচ্চপদস্থ নাৎসি কর্মকর্তা ও তাদের সহযোগীদের বিচার করা হয়েছিল৷ জার্মানির বাভারিয়া রাজ্যের ন্যুরেমব্যার্গ শহরের ‘প্যালেস অফ জাস্টিস’এর কোর্টরুম ৬০০-তে এই বিচার হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
যে কারণে ন্যুরেমব্যার্গ
নাৎসিদের বিচারের জায়গা হিসেবে ন্যুরেমব্যার্গের প্যালেস অফ জাস্টিসকে বেছে নেয়ার কারণ, স্থানটি তখন মার্কিন বাহিনীর দখলে ছিল৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভবনটি তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি৷ এছাড়া বন্দিদের রাখার জন্য পাশেই একটি কারাগার ছিল৷ আরো একটি কারণ হচ্ছে, ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ন্যুরেমব্যার্গেই নিয়মিত সমাবেশ করতো নাৎসি পার্টি৷ এবং সেখান থেকেই ইহুদিদের বিচারের আইনের ঘোষণা এসেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নাৎসি শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিচার
ন্যুরেমব্যার্গ ট্রায়ালে বিমানবাহিনীর কমান্ডার হেয়ারমান গ্যোরিং, নাৎসি দলের উপনেতা রুডল্ফ হেস (সর্বডানে) ও তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইওয়াখিম ফন রিবেনট্রপসহ নাৎসি পার্টির অনেক শীর্ষ কর্মকর্তার বিচার করা হয়৷ এই তিনজনকেই তাদের অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়৷ পরে গ্যোরিং কারাগারে নিজের কক্ষে আত্মহত্যা করেন, রিবেনট্রপকে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়৷ আর হেসকে তার বাকি জীবনটা জেলেই কাটাতে হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
চিকিৎসকদের বিচার
নাৎসিদের বিচার শেষ হওয়ার পর কোর্টরুম ৬০০-তে অন্য যুদ্ধাপরাধেরও বিচার হয়েছে৷ যেমন ‘ডক্টরস ট্রায়াল’ বলে বিবেচিত বিচারে ২৩ জন ব্যক্তিকে (অধিকাংশই চিকিৎসক) কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দিদের উপর ভয়াবহ পরীক্ষা চালানো ও তাদের হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়৷ পরে ঝুলিয়ে সবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল৷
ছবি: Imago-Images/United Archives International
পুরনো কাজে ফিরে যাওয়া
নাৎসি ও যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ শেষে ১৯৬০ সালের জুন মাসে কোর্টরুম ৬০০-কে বাভারিয়া রাজ্যের বিচারকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল৷ এই কক্ষের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় ২০০০ সাল থেকে প্রতি সপ্তাহান্তে সেখানে গাইডেড টুরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ অনেক পর্যটক এতে উপস্থিত থাকতেন৷ পরে ‘মেমোরিয়াম ন্যুরেমব্যার্গ ট্রায়ালস’ স্থাপনের জন্য ২০০৮ সালে ঐ টুর আয়োজন বন্ধ করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/D. Kalker
বিচার কার্যক্রমের সমাপ্তি
২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি শেষবারের মতো কোর্টরুম ৬০০-তে বিচারকাজ চলে৷ স্ত্রীকে গলা টিপে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে এক ব্যক্তিকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ ঐ ঘরটি এখন মেমোরিয়াম ন্যুরেমব্যার্গ ট্রায়ালসের অংশ৷ অর্থাৎ, দর্শনার্থীরা সেটি দেখার সুযোগ পাচ্ছেন৷ মেমোরিয়াম ন্যুরেমব্যার্গ ট্রায়ালস হচ্ছে একটি তথ্য ও নথিকেন্দ্র, যেখানে ঐ বিচার সংক্রান্ত কাগজপত্র সংরক্ষিত আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Karmann
6 ছবি1 | 6
সেসময় খুব অল্প মানুষই ধারনা করেছিলেন যে হিটলার ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি জার্মানির চ্যান্সেলর হবেন, মনে করেন জেরুসালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবং লেখক ডান ডিনেইর৷
হিটলারের একনায়কতন্ত্রের পরিনতি কী হয়েছে তাতো সবাই ভালোই জানেন৷ ১৯৪৫ সালে তার মৃত্যু অবধি সময়ের মধ্যে হিটলারের যুদ্ধে গোটা বিশ্বের ছয়কোটির বেশি মানুষ প্রাণ হারান৷ হলোকস্টে ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল৷ তাদের সঙ্গে আরো অনেক সিন্টি, রোমা, বিশেষভাবে সক্ষম এবং সমকামীদের হত্যা করা হয়৷
হিটলারের কি চ্যান্সেলর হওয়ার দরকার ছিল?
১৯৩২ সালের শরতে নাৎসিদের জনপ্রিয়তা কমছিল আর দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো হচ্ছিল, জানান ডিনেইর৷
‘‘আর মূলত সেসময়ে হিটলারকে রাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়৷ এটা আসলে হওয়া উচিত ছিল না,'' বলেন তিনি৷
জার্মান ভাষায় ৩০ জানুয়ারিকে ‘ক্ষমতা দখলের দিন' হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়৷ কিন্তু হিটলার আসলে ক্ষমতা দখল করেননি৷ তৎকালীন রাইস প্রেসিডেন্ট পল ফন হিন্ডেনবুর্গ নাৎসি এই নেতাকে রাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন৷
বর্ষীয়ান সেই রাজনীতিবিদ একটা লম্বা সময় হিটলারকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন৷ এমনকি ১৯৩২ সালের নির্বাচনে হিটলারের জয়ের পরও তাকে চ্যান্সেলরশীপ দিতে চাননি৷
হিটলারকে চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগের পেছনে অনেক নেপথ্যের রাজনীতি এবং চক্রান্ত ভূমিকা রেখেছিল৷ অনেক মানুষ সেসময় অশুভ ভূমিকা পালন করেছিলেন৷ তাদের মধ্যে একজন জার্মান জাতীয়তাবাদী-রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ ফ্রানৎস ফন পাপেন৷ তিনি ১৯৩২ সালের নভেম্বরে রাইস চ্যান্সেলর পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা করেন৷
পাপেন তখন হিটলারকে চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দিতে হিন্ডেনবুর্গের উপর চাপ দেন যাতে তিনি ভাইস চ্যান্সেলর হতে পারেন৷ জাতীয়তাবাদী-রক্ষণশীল নেতারা বিশ্বাস করেছিলেন যে হিটলারকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং একটি ‘টুল' হিসেবে ব্যবহার করা যাবে৷ কিন্তু সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়৷
হিটলারের আরেক কলঙ্কিত উদ্যোগ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে ফ্রান্সের মোতায়েন করা কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যদের বিয়ে করার কারণে জার্মান নারীদের ঘরে যে সন্তানেরা জন্ম নিয়েছিল, হিটলার সেই সন্তানদের নির্বীজ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷
ছবি: akg-images/picture-alliance
ভার্সেই চুক্তির কারণে
এই চুক্তির আওতায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে প্রায় এক লাখ সেনা পাঠিয়েছিল ফ্রান্স৷ এদের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার জন এসেছিলেন ফ্রান্সের সেই সময়কার উপনিবেশ সেনেগাল, মরক্কো, ফ্রেঞ্চ ইন্দোচীন ও টিউনিশিয়া থেকে৷ এই কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যদের মেনে নিতে পারেনি জার্মানির সেই সময়কার সরকার ও সুশীল সমাজ৷
ছবি: Sueddeutsche Zeitung Photo/Alamy Stock Photo
'অসভ্য জানোয়ার'
ফ্রান্সের উপনিবেশ থেকে আসা সৈন্যদের ‘অসভ্য় জানোয়ার’ হিসেবে তুলে ধরতে জার্মানির সেই সময়কার সরকার ও সুশীল সমাজের উদ্যোগে একটি বর্ণবাদী প্রোপাগাণ্ডা কর্মসূচি শুরু হয়েছিল, যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘দ্য ব্ল্যাক শেম’৷
ছবি: picture-alliance/dpa/akg-images
‘আধ্যাত্মিক অপরাধ’
জার্মান রাইশের প্রথম প্রেসিডেন্ট (১৯১৯-১৯২৫) ছিলেন এসপিডি দলের নেতা ফ্রিডরিশ এবার্ট৷ তিনি কিংবা তার দলের আরেক নেতা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আডল্ফ ক্যোস্টার উপনিবেশ থেকে সেনা মোতায়েনকে জার্মান নাগরিকদের বিরুদ্ধে করা ‘আধ্যাত্মিক অপরাধ’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন৷ কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যদের তারা ‘সবচেয়ে নীচু সাংস্কৃতিক স্তরের’ বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘সাদা কলংক’
প্রোপাগাণ্ডা চালানোর পরও ফ্রান্সের মোতায়েন করা অনেক কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যের সঙ্গে জার্মান শ্বেতাঙ্গ নারীদের বিয়ে হয়েছিল৷ এই নারীদের ‘হোয়াইট ডিসগ্রেস’ নাম দিয়েছিল সেই সময়কার জার্মান প্রোপাগাণ্ডা মেশিন৷ আর তাদের কোলজুড়ে যে সন্তানেরা জন্ম নিয়েছিল তাদের ডাকা হতো ‘রাইনলান্ড বাস্টার্ড’ হিসেবে৷ উল্লেখ্য়, ঐ সৈন্যরা জার্মানির রাইনলান্ড এলাকায় মোতায়েন ছিল৷
ছবি: DW
ম্যাগাজিনে প্রোপাগাণ্ডা
ছবিতে এক জার্মান ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ দেখা যাচ্ছে৷ এতে বলা হয় ‘অসভ্য কৃষ্ণাঙ্গ’ ফরাসি সৈন্যের সঙ্গে স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ নারী৷
ছবি: Universitätsbibliothek Heidelberg
হিটলারের নির্দেশে বীজাণুমুক্তকরণ
১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসার আগে সরকারিভাবে ঐ সন্তানদের ঘরে যেন আর কোনো সন্তান জন্ম নিতে না পারে সেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল৷ কিন্তু বিষয়টি অবৈধ মনে করে তাতে সায় দেননি ঐ সময়কার সরকারপ্রধানরা৷ তবে হিটলার এসে সেই কাজ শুরু করেছিলেন৷
ছবি: DOCDAYS Productions GmbH
গেস্টাপোর সহায়তায়
হিটলারের নির্দেশে গেস্টাপো গোয়েন্দা পুলিশ আফ্রো-জার্মান শিশুদের নির্বীজ করার উদ্যোগ নেয়৷ কাগজে-কলমে এমন মোট ৪৩৬টি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া গেলেও অপ্রকাশিত ঘটনা আরও অনেক বেশি বলে জানা গেছে৷
ছবি: DOCDAYS Productions GmbH
7 ছবি1 | 7
জার্মানির অভিজাততন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে পৌঁছানোর বিশৃঙ্খল ধাপের অনিবার্য ফলাফল ছিল না হিটলার, দাবি করেন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ইয়েন কারশ্৷
অর্থনৈতিক মহামন্দার সময় জার্মানির জাতীয়তাবাদী-রক্ষণশীল রাজনীতিবিদরা নিজেদের অজান্তেই হিটলারের উত্থানের স্থপতি হয়ে উঠেছিলেন৷ তারা নিজেদের আর্থিক স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে গণতন্ত্র, এবং সমাজতন্ত্রের হুমকিকে উপেক্ষা করেছিলেন৷
কিন্তু জার্মান প্রতিক্রিয়াশীলরা যখন আনন্দের সাথেই হিটলারের কর্তৃত্ববাদী শাসনকে সমর্থন করে যাচ্ছিলেন তখনও তারা তার উদ্দেশ্যকে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের জাতীয় অপমানকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করেছিলেন, মনে করেন কারশ্৷
জার্মান ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো আলাদা হতে পারতো
‘‘রোডস নট টেকেন৷ অর: ইট কুড হেভ টার্নড আউট ডিফারেন্টলি,'' শিরোনামে জার্মানির রাজধানী বার্লিনের জার্মান হিস্ট্রি মিউজিয়ামে একটি প্রদর্শনী চলছে যেখানে ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারিসহ আরো কয়েকটি তারিখের পুর্নমূল্যায়ন করা হয়েছে৷ এসব দিনে কার্যত জার্মানি এবং গোটা বিশ্বের ইতিহাস বদলে দিয়েছিল৷
ডান ডিনেইরের ধারনা থেকে তৈরি এই প্রদর্শনীতে ১৯৮৯ থেকে ১৮৪৮ সালের দিকে ফিরে যাওয়া হয়েছে এবং এই সময়ের মধ্যকার ১৪টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে যা একটু অন্যরকম হলে পুরো ইতিহাসই অন্যরকম হতে পারতো৷