আল-কায়েদা সমর্থিত জঙ্গিদের হাতে বাংলাদেশে দুই সমকামী অ্যাক্টিভিস্ট হত্যার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও দেশটির এলজিবিটি সম্প্রদায় এখনও আতঙ্কে আছে৷ এরইমধ্যে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এক নির্বাসিত সমকামী অ্যাকটিভিস্ট জানালেন, পুরো সম্প্রদায় পিছু হঠতে শুরু করেছে৷ নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ঐ মানুষটি নিজের নাম প্রকাশ করতেও ভীত ছিলেন৷ তিনি জানালেন, সমকামীরা এখন দেশে কোনো ধরনের কাজই করতে পারছেন না, নিজেদের অধিকার বা দাবি আদায়ের আন্দোলন তো দূরের কথা৷ বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহ বলে জানালেন তিনি৷ পরিস্থিতি যে এতটা ভয়াবহ হবে তা কখনো কল্পনা করেননি বলে জানালেন নির্বাসিত ঐ সমকামী অ্যাকটিভিস্ট৷
বাংলাদেশে এলজিবিটি সম্প্রদায় বর্তমানে কোণঠাসা, কেননা এখানে সমকামিতা অবৈধ, এমনকি শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷
২০১৪ সালে প্রথম এলজিবিটি সম্প্রদায় ‘রূপবান' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে৷ যা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে৷ তখনই এই সম্প্রদায়ের উপর বিভিন্ন ধরনের হুমকি আসতে থাকে৷ কিন্তু এ বছরের ২৫ এপ্রিল ‘‘রূপবানের'' সম্পাদক জুলহাস মান্নান এবং তাঁর বন্ধু মাহবুব তনয় খুন হলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে৷ জুলহাস মান্নান এবং মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল৷ আল-কায়দার আঞ্চলিক গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করে৷
ব্যাংককে গত সপ্তাহে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তিনি আরও বলেন, ‘‘গত দু'বছরে আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের পথে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছিলাম৷ অনেক তরুণরা আমাদের এ পথে সহযাত্রী হয়েছিল, আমরা অনেক স্বেচ্ছাসেবীও পেয়েছিলাম৷ কিন্তু ঐ হত্যার ঘটনার পর পুরো স্তম্ভটা যেন ভেঙে পড়ল৷'' এ পর্যন্ত অন্তত ১৫ জন সমকামী দেশ ছেড়েছেন বলে জানালেন তিনি৷ আরও ১০ জন দেশ ছাড়তে চাচ্ছেন৷ তিনি বললেন, ‘‘দেশের মানুষরা তাদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না৷ তাই পুরো সম্প্রদায় ভীষণ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে৷ এসব সম্মেলনে অনেক দেশের মানুষ আসেন, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে কেউ অংশ নেন না৷'' তাদের বিরুদ্ধে মানুষ যে নৃশংস আচরণ করছে এবং করেছে তার প্রতিবাদ হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি৷
ঐ অ্যাকটিভিস্ট মনে করেন, দেশ থেকে বাইরে বেরিয়ে নতুন জীবন পেয়েছেন৷ বলেন, তার কিছু দায়িত্ব আছে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য৷ তাই তিনি থামবেন না৷ তিনি আশা করেন এমন একদিন আসবে, যখন মানুষ তাদের স্বীকৃতি দেবে, সেটা পাঁচ বছর হতে পারে, ১০ বছর বা তারও বেশি৷ তবে তিনি অপেক্ষায় থাকবেন৷
সমকামী এক ইমামের কথা
দক্ষিণ আফ্রিকার এক মসজিদের ইমাম মুহসিন হেন্ড্রিকস গত ২০ বছর ধরে সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন৷ তাঁদের জন্য একটি মসজিদও নির্মাণ করেছেন তিনি৷
ছবি: The Inner Circle
সমকামীদের জন্য মসজিদ
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরের ভিনবার্গ এলাকার একটি মসজিদের ইমাম মুহসিন হেন্ড্রিকস৷ বছর পাঁচেক আগে তিনি মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন৷ হেন্ড্রিকস একজন সমকামী৷ তাঁর মসজিদে ২৫ জন নিয়মিত নামাজ আদায়কারী আছেন৷ মাঝেমধ্যে সমকামীদের মধ্যে বিয়েও পড়ানো হয় ঐ মসজিদে৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Bosch
সমকামী মুসলিমদের সহায়তা
নিজে সমকামী হওয়ায় কেপটাউনের সমকামী মুসলিমদের অসহায়ত্বের কথা জানতেন হেন্ড্রিকস৷ তাই তাঁদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে ১৯৯৬ সালে ‘দ্য ইনার সার্কেল’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন তিনি৷ এই উদ্যোগেরই অংশ হিসেবে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়৷
ছবি: The Inner Circle
বিয়ে করেছিলেন হেন্ড্রিকস
অল্প বয়সেই নিজের সমকামিতার বিষয়টি অনুভব করেছিলেন হেন্ড্রিকস৷ কিন্তু তাঁর দাদা ইমাম ছিলেন৷ তিনি তাঁকে বলেছিলেন, সমকামীরা দোযখে যাবে৷ এছাড়া সেই সময় সমকামিতা বিষয়ে মুসলিম সমাজে মনে করা হত যে, বিয়ে হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ সে কারণে এক নারীকে বিয়েও করেছিলেন হেন্ড্রিকস৷ কিন্তু বছরখানেকের মধ্যেই বুঝতে পারেন, বিরাট ভুল করেছেন৷ তবুও সেভাবে ছয় বছর কেটে যায়৷ দুই সন্তানের জন্মও হয়৷ পরে বিবাহবিচ্ছেদ হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/R.Bosch
সমকামিতা প্রসঙ্গে কোরান
ডয়চে ভেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হেন্ড্রিকস বলেন, ‘‘কোরান সমকামিতার বিরুদ্ধে নয়৷ ইসলামি অনেক পন্ডিতও এখন সেটি বুঝতে শুরু করেছেন৷ এমনকি মহানবির (সা:) বাড়িতে এমন ব্যক্তিরা কাজ করতেন যাঁরা নারীদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতেন না৷ মহানবি (সা:) এর বাড়িতে সমকামী চাকর থাকার মানে সমকামীদের প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল৷’’
ছবি: Imago/B. Strenske
দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বে প্রথম
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে সে দেশের ১৯৯৬ সালের সংবিধানে সমকামীদের অধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে৷ এছাড়া আফ্রিকার একমাত্র দেশ হিসেবে সেখানে সমলিঙ্গ বিয়ের বৈধতা রয়েছে৷
ছবি: Johann Hattingh/AFP/Getty Images
আফ্রিকার ‘সমকামী রাজধানী’
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে সমকামীবান্ধব অনেক রেস্তোরাঁ, বার, হোটেল ও ক্লাব আছে৷ সেজন্য এই শহরটি আফ্রিকার ‘সমকামী রাজধানী’ বলেও পরিচিত৷
ছবি: dapd
আছে তিন লক্ষ মুসলিম
কেপটাউনে প্রায় তিন লক্ষ মুসলিমের বাস৷ সেখানকার অধিকাংশ মসজিদের ইমাম সমকামিতার বিরুদ্ধে৷ তাঁদের মধ্যে অনেকে সমকামীদের গৃহবন্দি করে রাখার পক্ষে৷ হেন্ড্রিকসের মসজিদ থেকে ১০ কিমি দূরের একটি মসজিদের ইমাম বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘‘সমকামিতা গ্রহণযোগ্য নয়৷ এটি নিষিদ্ধ৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Gupta
পরিবর্তন আনছেন হেন্ড্রিকস
সমকামীদের অধিকার নিয়ে কথা বলায় কয়েকবারই তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু থেমে যাননি তিনি৷ বরং তাঁর দৃঢ়তার কারণে সমাজে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসছে৷ তাইতো তাঁর মসজিদের দুই কিলোমিটারের এর মধ্যে আরেকটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে যেখানে সমকামীদেরও নামাজ পড়ার অধিকার রয়েছে৷