পাকিস্তানের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ১,৮০০-র বেশি ইসলাম ধর্মীয় নেতা আত্মঘাতী হামলা চালানোকে হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছেন৷ মঙ্গলবার সরকার কর্তৃক প্রকাশিত এক বইয়ে এই ফতোয়া অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
‘‘একটি আধুনিক ইসলামি সমাজের স্থিতিশীলতার শক্ত ভিত্তি তৈরি করে দিচ্ছে এই ফতোয়া,’’ বইতে লিখেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মামনুন হুসেইন৷ ‘‘ইসলামের সোনালি নীতি অনুযায়ী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়তে একটি জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলতে এই ফতোয়া থেকে নির্দেশনা পাওয়া যেতে পারে,’’ বলে মনে করেন তিনি৷
সরকার পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি বইটি প্রকাশের দায়িত্বে ছিল৷ মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বইটি প্রকাশ করা হয়৷
আলোচিত কয়েকটি আত্মঘাতী হামলা
ব্রিটিশ সংস্থা ‘অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স’ গত নভেম্বরে জানায়, গত ৩০ বছরে বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে আত্মঘাতী বোমা হামলায় কমপক্ষে ৫০ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছেন৷
ছবি: DW/ISPR
প্রথম আত্মঘাতী হামলা
১৮৮১ সালের ১৩ মার্চ এই হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন রুশ সম্রাট দ্বিতীয় আলেকজান্ডার৷ তাঁকে বহনকারী ঘোড়ার গাড়ির সামনে বোমা হামলা চালিয়েছিল ২৫ বছরের তরুণ ইগনাটি গ্রিনেভিৎস্কি৷ তিনি ‘দ্য পিপলস উইল’ নামে বামপন্থি একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/Fine Art Images/Heritage Images
ফিলিস্তিনের প্রথম নারী আত্মঘাতী হামলাকারী
ওয়াফা ইদ্রিস নামে ২৮ বছরের এক নারী ২০০২ সালের ২৭ জানুয়ারি জেরুসালেমে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে এক বয়স্ক ইসরায়েলিকে হত্যা করেন৷ আহত হয়েছিলেন প্রায় ১০০ জন৷ ইদ্রিসের পিঠে ঝোলানো ব্যাগে ১০ কেজি ওজনের বোমা ছিল৷ ছবিতে তাঁকে গ্রাজুয়েশন পোশাক পরা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে৷ ‘আল-আকসা মার্টায়ার্স ব্রিগ্রেড’ হামলার দায় স্বীকার করেছিল৷ পরবর্তীতে নারী আত্মঘাতী হামলাকারীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল তারা৷
ছবি: Getty Images
সবচেয়ে প্রাণঘাতী আত্মঘাতী হামলা
২০০১ সালে আল-কায়েদার আত্মঘাতী হামলাকারীরা বিমান ছিনতাই করে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে হামলা চালিয়েছিল৷ এতে প্রায় তিন হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন৷
ছবি: AP
বিদেশি বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা
১৯৮৩ সালের অক্টোবরে লেবাননে গৃহযুদ্ধ চলার সময় শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত ৩০০-র বেশি মার্কিন ও ফরাসি সামরিক বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল৷ দু’টি ট্রাক নিয়ে হামলাকারীরা ব্যারাকে ঢুকে পড়েছিল৷ প্রতিটি ট্রাকে প্রায় ১ দশমিক ৪ টন বিস্ফোরক ছিল৷ ৯/১১ হামলার আগে ওটিই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলা৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Bouchon
শরীরের ভেতর বোমা স্থাপন
২০০৯ সালে সৌদি আরবের তৎকালীন উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নাইফকে (ছবি) হত্যার উদ্দেশ্যে নিজের শরীরের ভেতর বোমা স্থাপন করিয়েছিলেন ২৩ বছরের সৌদি তরুণ আল-আসিরি৷ পরে মোবাইল ফোনের সাহায্যে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটনা হলেও তাতে শুধু আসিরিই মারা যান৷ প্রিন্স নাইফ সামান্য আহত হয়েছিলেন৷ উল্লেখ্য, শরীরের ভেতরে বোমা স্থাপন করলে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সেটি সহজে ধরা পড়ে না৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/H. Ammar
রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড
১৯৯১ সালের ২১ মে ভারতের তামিলনাড়ুতে আত্মঘাতী এক বোমা হামলায় নিহত হন দেশটির সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী৷ তাঁকে হত্যা করেন শ্রীলঙ্কার তৎকালীন জঙ্গি সংগঠন ‘লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলম’ বা এলটিটিই-র এক নারী সদস্য৷ ছবিটি হামলার কয়েক সেকেন্ড আগের মুহূর্তে তোলা৷ শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ বন্ধ করতে সে দেশে শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠিয়েছিল ভারত৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশে প্রথম আত্মঘাতী হামলা
বাংলাদেশে নব্য জেএমবি-র সদস্যদের মধ্যে সম্প্রতি আত্মঘাতী প্রবণতা বেশি দেখা গেলেও, আগেও এর নজির ছিল৷ ২০০৫ সালের ২৯শে নভেম্বর গাজীপুরে বাংলাদেশের প্রথম আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে৷ ঐ হামলায় আত্মঘাতী হামলাকারী জেএমবি-র সদস্য আসাদসহ আটজন নিহত হয়েছিলেন৷ উপরের ছবিটি সম্প্রতি সিলেটে এক অভিযানের সময় তোলা৷
ছবি: DW/ISPR
7 ছবি1 | 7
দেশে ও দেশের বাইরে থাকা পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনীর সমালোচকদের অভিযোগ, তারা রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যে মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখে৷ মসজিদকে ব্যবহার করে ঘৃণা ছড়ানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকার অনেকদিন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলেও সমালোচকদের অভিযোগ৷
পশ্চিমা বিশ্ব ও উদারনীতি ব্যবস্থার সমালোচক প্রখ্যাত কয়েকজন ধর্মীয় নেতা এই ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেছেন৷ এছাড়া বিচ্ছিন্নতাবাদ ও আফগান তালিবানের সমর্থকরাও আছেন স্বাক্ষরদাতাদের তালিকায়৷
যেমন নিষিদ্ধ ঘোষিত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’ বা এএসডাব্লিউজে-র শীর্ষ নেতা মুহাম্মদ আহমেদ লুধিয়ানভি এই ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেছেন৷ ‘সন্ত্রাসবাদের’ সঙ্গে সম্ভাব্য জড়িতদের তালিকায়ও তার নাম আছে৷
এছাড়া হামিদ-উল-হক নামক এক স্বাক্ষরদাতা আফগান তালিবানের জনক বলে পরিচিত এক নেতার ছেলে৷
মধ্যপ্রাচ্যে আত্মঘাতী হামলার বিরুদ্ধে আগে ফতোয়া দেয়া হয়েছে৷ তবে তা খুব বেশি কার্যকর হয়নি৷ কারণ, সেখানে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস-সহ অন্যান্য গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই এ ধরনের হামলা করে থাকে৷
ইসলামের ব্রেলভি মতবাদে (তারা তালেবান বিরোধী) বিশ্বাসী কয়েকজন ধর্মীয় নেতা এর আগে আত্মঘাতী হামলার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন৷ তবে পাকিস্তানে এবার যে ফতোয়া দেয়া হলো তাতে দেশটির প্রায় সব গোষ্ঠীর নেতারা স্বাক্ষর করেছেন৷
জেডএইচ/এসিবি (রয়টার্স, ডিপিএ)
২০১৬ সালের আগস্টের এই ছবিঘরটি দেখুন...
পাকিস্তান: অগুনতি সন্ত্রাসী হামলার একটি দশক
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সঙ্গীদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে যোগ দেয়ার পর, চড়া মূল্য দিতে হয়েছে পাকিস্তানকে৷ উগ্রপন্থিদের হাতে দেশটির কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে ইতিমধ্যেই৷ ছবিঘরে দেখুন সেই মর্মান্তিক কাহিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/A Majeed
২০০৭ – সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাবর্তনের দিন করাচিতে হামলা
২০০৭ সালের ১৮ অক্টোবর করাচিতে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর গাড়িবহরে জোড়া বোমা হামলার ঘটনা ঘটে৷ সে সময় দীর্ঘ আট বছর পর দেশে ফিরছিলেন তিনি৷ হামলায় বেনজির বেঁচে গেলেও, প্রাণ হারায় ১৩৯ ব্যক্তি৷ কিন্তু এর মাত্র দু’মাস পর, ২৭ ডিসেম্বর, রাওয়ালপিন্ডিতে অপর এক হামলায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন পাকিস্তানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/N. Khawer
২০০৮ – ওয়াহ বোমা হামলা
ওয়াহ-তে অবস্থিত ‘পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিস’-এ জোড়া আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ হারায় ৬৪ ব্যক্তি৷ ২০০৮ সালের ২১ আগস্টের সেই হামলাই এখনও পর্যন্ত পাকিস্তানে কোনো সামরিক স্থাপনায় সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘তাহরিক-ই-তালেবান’ (টিটিপি) সে সময় ঐ হামলার দায় স্বীকার করেছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Khan
২০০৮ – রাজধানীর হোটেলে সন্ত্রাসী হামলা
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত মারিয়ট হোটেলে বিস্ফোরকভর্তি ট্রাক দিয়ে হামলা চালানো হয়৷ ২০০৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের সেই হামলায় প্রাণ হারায় কমপক্ষে ৬০ ব্যক্তি, আহত ২০০৷ হতাহতদের মধ্যে ২০ জন বিদেশিও ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Matthys
২০০৯ – পেশোয়ারে হামলা
পাকিস্তানের পেশোয়ারে নারী ও শিশুদের বাজার হিসেবে পরিচিত ‘মিনা বাজারে’ একটি গাড়ি বোমা হামলায় ১২৫ ব্যক্তি নিহত ও ২০০ ব্যক্তি আহত হয়৷ পাকিস্তান সরকার এই হামলার পেছনে তালেবান জড়িত বলে দাবি করলেও, জঙ্গি গোষ্ঠী তালেবান এবং আল-কায়দা – উভয়েই সেই হামলার দায় অস্বীকার করে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A Majeed
২০১০ – ভলিবল ম্যাচে আত্মঘাতী হানা
পাকিস্তানের বানুর একটি গ্রামে ভলিবল খেলা চলাকালে আত্মঘাতী হামলায় প্রাণ হারায় ১০১ ব্যক্তি৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Azam
২০১১ – চারসাদার পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে হামলা
পাকিস্তানের খাইবার পাকতুনখার চারসাদা জেয়া একটি পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে জোড়া বোমা হামলায় ৯৮ ব্যক্তি নিহত ও ১৪০ জন আহত হয়৷ ২০১১ সালে ১৩ মে ক্যাডেটরা যখন প্রশক্ষিণ শেষে দশদিনের ছুটিতে নিজ নিজ বাড়ি যাওয়ার পথে বাসে উঠছিল, তখন হামলার ঘটনাটি ঘটে৷ বলা হয়ে থাকে, ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেই নাকি ঐ হামলা চালায় তালেবান৷
ছবি: Getty Images/AFP/H. Ahmed
২০১৩ – পেশোয়ারে চার্চে বোমা হামলা
২০১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পেশোয়ারের ‘অল সেইন্ট চার্চে’ জোড়া আত্মঘাতী হামলায় ৮২ ব্যক্তি প্রাণ হারায়৷ ‘তাহরিক-ই-তালেবান’ বা টিটিপি সংশ্লিষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠী জুনদাল্লাহ সেই হামলার দায় স্বীকর করে৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Khan
২০১৪ – পেশোয়ারে স্কুলে হত্যাযজ্ঞ
২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর টিটিপি-র সাতজন বন্দুকধারী পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে হামলা চালায়৷ তারা ১৫৪ ব্যক্তিকে হত্যা করে, যাদের মধ্যে ১৩২টি শিশু ছিল৷ পাকিস্তানের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা৷
ছবি: AFP/Getty Images/A Majeed
২০১৫ – করাচিতে বাসে হামলা
২০১৫ সালের ১৩ মে আটজন বন্দুকধারী করাচিতে একটি বাসে হামলা চালিয়ে ৪৬ ব্যক্তিকে হত্যা করে৷ নিহতদের সবাই শিয়া মুসলমান ছিল৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করে জুনদাল্লাহ বা ‘আল্লাহ-র সেনা’ নামের জঙ্গি গোষ্ঠী৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
২০১৬ – হাসপাতালে বোমা হামলা
চলতি বছরের ৮ আগস্ট পাকিস্তানের কোয়েটায় সরকারি হাসপাতালে আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং গুলিতে ৭০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়৷ নিহতদের অধিকাংশই আইনজীবী, যাঁরা অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত বেলুচিস্তান বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিলাল আনওয়ার কাসির মরদেহ নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন৷