সাংবিধানিক আদালতের রায়ে দোষী প্রমাণিত হয়েছেন থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রা৷ ফলে আইনত তাঁর পক্ষে আর প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান থাকা সম্ভব নয়৷
বিজ্ঞাপন
বুধবার সকালে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত রায়ে থাইল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালত জানায়, ২০১১ সালে এক ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে বদলি করায় ইংলাক ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন এবং এর ফলে ক্ষমতাসীন ফিউ থাই পার্টির সুবিধা হয়েছিল৷ রায়ে বলা হয়, নয় সদস্যের আদালত অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পাওয়ায় সর্বসম্মতিক্রমে ইংলাককে দোষী সাব্যস্ত করেছে৷ এর ফলে, ফিউ থাই পার্টির বর্তমান প্রধান ইংলাক সিনাওয়াত্রা আইনগতভাবে ক্ষমতায় থাকার অধিকার হারালেন৷
এর আগে মঙ্গলবার মামলার শুনানিতে ইংলাক বলেন, ‘‘ওই বদলির ঘটনায় আমি কোনো সুবিধা ভোগ করিনি৷ আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, সবই আমি অস্বীকার করছি৷''
প্রায় ছয় মাস ধরে থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে৷ দুর্নীতি এবং দেশান্তরী সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার ‘পুতুল সরকার' হয়ে দেশ পরিচালনার অভিযোগে ইংলাকের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামে বিরোধীরা৷ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের সংঘর্ষে এ পর্যন্ত অন্তত ২৫ জন মারা গেছেন৷
ব্যাংকক: দুটি প্রতিবাদ আন্দোলনের গল্প
তিন বছর আগে রাজপথের আন্দোলনে জয় ছিনিয়ে নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইংলাক সিনাওয়াত্রা৷ ব্যাংককের রাজপথ আবার বিক্ষোভে উত্তাল৷ এবার ইংলাকের অপসারণের দাবিতেই চলছে উত্তুঙ্গ আন্দোলন৷ ছবিঘরে থাকছে দুটি আন্দোলনের মিল-অমিল৷
ছবি: DW/C. Johnson
‘দাস সেনা’ থেকে ‘সেলফি আর্মি’
শাসকের অত্যাচার ক্রীতদাসের মতো মেনে না নিয়ে থাইল্যান্ডের মানুষ আন্দোলনে নেমেছিল ২০১০ সালে৷ প্রতিবাদের ভাষা প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে দিতে ব্যবহার করেছিলেন মুঠোফোন৷ ২০১৪ সালে ব্যাংকক আবার উত্তাল৷ ‘টেক স্যাভি’ তরুণ সমাজ এবার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে রাজপথ থেকে তুলে দিচ্ছে ছবি৷এখানে ব্যাংককের এমবিকে শপিং সেন্টারের সামনে থেকে ছবি তুলে ফেসবুক-টুইটারে দেয়ায় ব্যস্ত ইংলাক-বিরোধী আন্দোলনকারীরা৷
ছবি: DW/C. Johnson
বাড়ি যখন দূরে, বাড়ি যখন কাছে
২০১০ সালের আন্দোলনে দূর দূরান্তের গ্রাম থেকেও ইংলাকের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মানুষ চলে এসেছিলেন ব্যাংককে৷ লাল জামা পরে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল এক ‘লাল জামা পরিবার’৷ ফুটপাতে রাত কাটাতে হয়েছে তাঁদের ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আগুনে গরমে৷ এবার একটু ভিন্ন৷ বেশিরভাগ আন্দোলনকারীই থাকেন ব্যাংকক বা ব্যাংককের আশেপাশে৷ রাতে তাঁরা ফিরে যেতে পারেন নিজের ঘরে, ২০১০ সালের মতো এমন দৃশ্য এখন তেমন একটা দেখা যায় না৷
ছবি: DW/C. Johnson
আরেকটি অন্ধকার দিন?
বোমা বিস্ফোরণ কিংবা গুলি বর্ষণের ঘটনা সত্ত্বেও সব দলের সব নেতাই এবার সামরিক অভিযান কিংবা দোকান, বিপণিবিতান, থিয়েটার বা এটিএম বুথ পোড়ানো এবং লুটপাট রুখতে সদা তৎপর৷ ২০১০ সালের মতো এমন কিছু এখনও হয়নি৷ প্রশ্ন হলো, জনতার এমন আপাত ধৈর্যশীলতা কতদিন বজায় থাকবে?
ছবি: DW/C. Johnson
দৃশ্যমান পরিবর্তন
২০১০ সালের আন্দোলনে ব্যাংককের রাজপথ যেন হয়ে উঠেছিল পল্লীমেলার উৎসব৷ এবার দেখা যাচ্ছে আধুনিক শহুরে জীবনের সংস্কৃতি, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার৷ ঝলমলে আলোকসজ্জা, রক সংগীতে থাইল্যান্ডের কিংবদন্তি ব়্যাং রকেস্ট্রা, কিংবা জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘ফ্লাই’-এর নেড়ে-মাথা ভোকালের গান – কী নেই সেখানে! রাজপথের আন্দোলন, আন্দোলনকে ঘিরে জমে ওঠা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান – সবই সরাসরি দেখানো হচ্ছে টেলিভিশনে৷
ছবি: DW/C. Johnson
ধ্বংসের চিত্র
২০১০ সালের ছবি৷ তখন সামরিক অভিযান চলছে৷ অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন অনেক আন্দোলনকারী৷ এদিক-ওদিক থেকে আসছে স্নাইপারের গুলি, জেন শপিং সেন্টার পুড়ছে, ধোঁয়ায় ঢাকা চারপাশ – ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতেও অকুতোভয় এক আন্দোলনকারী হেঁটে চলেছেন৷ চার বছর পর তাঁর প্রতিপক্ষরাই নিয়েছেন রাজপথের দখল৷ লাল জামা সরকারের পতন চান তাঁরা৷
ছবি: DW/C. Johnson
কৃষক বনাম সেলিব্রিটি
২০১০ সালের আন্দোলনে ব্যাংককের রাজপথ ছিল মূলত গ্রামাঞ্চল থেকে আসা কৃষকদের দখলে৷ ইংলাকবিরোধী আন্দোলনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী, ডিজে-রা৷ দেশ বরেণ্য অনেক সেলিব্রিটিই রাজপথে সময় কাটাচ্ছেন জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে, কিংবা নানাভাবে রাজা ভূমিপলের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ এবং ইংলাক সরকারের বিদায় কামনা করে৷
ছবি: DW/C. Johnson
সরকার থেকে বিরোধী
ইংলাক সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রধান নেতা সুথেপ থাউংসুবান৷ চার বছর আগে তিনি ছিলেন ইংলাকের পাশে৷ ইংলাক সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন তিনি৷
ছবি: DW/C. Johnson
যানচলাচল বন্ধ
একটি বিষয়ে দুটি আন্দোলনেই খুব মিল৷ ২০১০ সালের মতো এবারের আন্দোলনকারীরাও বিক্ষোভ জানাতে নেমে এসেছেন রাজপথে৷ ফলে ব্যাংককের বড় একটা অংশে যানচলাচল প্রায় বন্ধ৷ তবে এরই মাঝে ফুটপাতে দেখা যাচ্ছে জীবনের নানা রং৷ আন্দোলনকারীদের জন্য টি-শার্ট, টুপি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্রের পশরা নিয়ে বসেছেন খুদে ব্যবসায়ীরা৷ আশোপাশের দোকানপাটও খোলা৷
ছবি: DW/C. Johnson
8 ছবি1 | 8
বিরোধীদের আরেকটি দাবি ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন৷ কিন্তু ইংলাক সেই দাবি অগ্রাহ্য করে নির্বাচন দেন৷ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে তাঁর দলই জয়ী হয়৷ কিন্তু থাইল্যান্ডের আদালত বিরোধীদের আন্দোলনের কারণে বিঘ্নিত এ নির্বাচনের ফলাফলকে অকার্যকর ঘোষণা করে৷ নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও গঠন করা হয়৷ বিরোধীরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের পদে ইংলাককে মেনে না নেয়ায় তারপরও অচলাবস্থা কাটেনি৷
আদালতের রায়ে ইংলাক দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও দেশটিতে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরুর আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা৷ ইংলাকের আগে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত থাইল্যান্ডের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী তাঁর বড় ভাই থাকসিন সিনাওয়াত্রা৷ ২০০৬ সালে দুর্নীতির অভিযোগে সরকারবিরোধী আন্দোলনের মুখে সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যূত হয়ে তিনি দেশ ছাড়েন৷ ২০১১ সালে দেশটির ২৮তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ইংলাক সিনাওয়াত্রা৷ মাত্র তিন বছরের মধ্যে আদালতের রায়ে তিনিও ক্ষমতায় থাকার অধিকার হারালেন৷