হোলি আর্টিজান জঙ্গি হামলা মামলার আসামি রাকিবুল হাসান রিগান তথাকথিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর টুপি পরে আদালতে হাজির হলেন কীভাবে তা জানার চেষ্টা চলছে৷ রায়ে রিগানের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
রিগান এ টুপি কোথায় পেলেন তা দায়িত্বশীল কোনো কর্তৃপক্ষ সুনির্দিষ্টভাবে বলেননি৷ রায়ের পর আদালত থেকে বের করে নেয়ার সময় রিগান সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘টুপি আমি কারাগার থেকে নিয়ে এসেছি৷’’
ঘটনা তদন্তে কারা অধিদপ্তর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে৷ আইজি (প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা ডয়চে ভেলেকে জানান, সারা দেশের কারাগারে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে৷
আদালতে উপস্থিত সাংবাকিদের কয়েকজন জানান, রায়ের পর প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে ভ্যানে বসে আরো একজনকে আইএস-এর টুপি পরতে দেখা যায়৷
হোলি আর্টিজান হামলার টাইমলাইন
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় পাঁচ জঙ্গিসহ ২৯ জন নিহত হয়৷ হামলায় জড়িত থাকার দায়ে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
হামলা শুরু
২০১৬ সালের ১ জুলাই শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে ঢাকার গুলশান দুই-এর ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর বাড়ির হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা হয়৷
ছবি: bdnews24.com
হামলাকারী
সরাসরি হামলায় অংশ নেন পাঁচজন৷ তারা হলেন: রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ৷ শনিবার সকালে সেনা কমান্ডো অভিযানে তারা সবাই নিহত হন৷ ছবিতে হামলাকারী নিবরাস ইসলামকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/Courtesy SITE Intel Group
নিহত
মোট ২৯ জন প্রাণ হারান৷ এর মধ্যে পাঁচ জঙ্গিসহ এক রেস্তোরাঁ কর্মী ও একজন শেফ কমান্ডো অভিযানে নিহত হন৷ বাকি ২২ জনের মধ্যে অভিযান চালাতে গিয়ে প্রাণ হারান দুই পুলিশ৷ তাঁরা হলেন গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানীর ওসি মো. সালাহউদ্দিন খান৷ বাকি ২০ জনের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি, নয়জন ইটালীয়, সাতজন জাপানি ও একজন ভারতীয়৷ নিহত বাংলাদেশিরা হলেন ইশরাত আকন্দ, ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও অবিন্তা কবীর৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
কমান্ডো অভিযান
২ জুলাই শনিবার সকালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সাথে নিয়ে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা অভিযান চালান৷ এতে পাঁচ জঙ্গিসহ সাতজন নিহত হন৷ অভিযান শেষে নারী-শিশুসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
মামলা দায়ের
২০১৬ সালের ২ জুলাই সন্ত্রাস দমন আইনে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করেন গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার দাস৷
ছবি: Reuters/M. Hossain Opu
চার্জশিট
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই আটজনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয়৷ তদন্তে হামলায় ২১ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ এর মধ্যে ১৩ জন কমান্ডো অভিযান ও পরবর্তীতে জঙ্গিবিরোধী বিভিন্ন অভিযানে নিহত হন৷ সে কারণে ওই ১৩ জনকে বাদ দিয়ে আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/abaca
যাদের আসামি করা হয়নি
জিম্মি অবস্থা থেকে উদ্ধার করা হাসনাত রেজাউল করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে (ছবি) গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও পরে আসামি করা হয়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Asad
জঙ্গিবিরোধী অভিযান
বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত আটজন হলেন: তামিম চৌধুরী, সরোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান, তানভীর কাদেরী ওরফে জামসেদ, নুরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান চকোলেট, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ও রায়হান কবির ওরফে তারেক৷
ছবি: DW/ISPR
বিচারকাজ শুরু
চাজশিট দেয়ার প্রায় চার মাস পর ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করে৷ আদালত ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করে ২৭ নভেম্বর রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেন৷
ছবি: Getty Images/M. H. Opu
রায়
বিচার শুরুর এক বছরের মাথায় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর আট আসামির মধ্যে সাত জনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত৷ তারা হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগান, মামুনুর রশিদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদ৷ মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেয়া হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
স্বীকারোক্তি
ছয় আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন৷ মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মামুনুর রশিদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদ জবানবন্দি দেননি৷
ছবি: bdnews24.com
11 ছবি1 | 11
প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক আমানু রহমান বলেছেন, ‘‘আসামিদের সকাল ১০টার পরপরই কোর্ট হাজতে আনা হয়৷ তাদের সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তোলা হয় পৌনে ১২ টার দিকে৷ রায় পড়া শুরু হয় ১২টার দিকে৷ যখন আদালতে আনা হয়, তখন রিগানের মাথায় আমরা একটা কালো টুপি দেখেছি৷ কিন্তু রায় ঘোষণার পর তার মাথায় আমরা আইএস-এর টুপি দেখি৷ রায় ঘোষণার পরও সে আদালত থেকে ওই টুপি পরেই বের হয়৷’’
আরেক সাংবাদিক তোফায়েল আহমেদও জানান, ‘‘রায় ঘোষণার পরপরই আমরা তার মাথায় আইএস-এর টুপি দেখতে পাই৷ তার আগে মাথায় একটি কালো টুপি দেখেছি৷’’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ‘‘এই ঘটনায় আমি বিস্মিত হয়েছি৷ এটা কীভাবে সম্ভব হলো? আমি আদালতে সামনের দিকে থাকায় রায়ের সময় আসামির মাথায় ওই টুপি লক্ষ্য করিনি৷ তবে বের হওয়ার সময় আমি দেখেছি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এটা একটা বড় ধরনের গাফিলতি৷ এটা নিরাপত্তারও ত্রুটি৷ এর দায় কারা কর্তৃপক্ষ এবং দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশের৷ আমি বিষয়টি তন্তের জন্য বলেছি৷’’
কারা অধিদপ্তরের এআইজি (প্রশাসন) আব্দুল্লাহ আল মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কারাগার পর্যন্ত আমাদের দায়িত্ব৷ কারাগার থেকে বের হওয়ার পর দায়িত্ব পুলিশের৷ সেখানে কী ঘটেছে সেটা আমাদের জানার কথা নয়৷ আর সে যেহেতু আদালতের রায়ের আগে দন্ডপ্রাপ্ত ছিল না তাই সে কারাবিধি অনুযায়ী যে-কেনো পোশাক পরতে পারে৷’’
এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি সে আইএস-এর টুপি পরে কীভাবে আদালতে গেল: পুলিশের ডেপুটি কমিশনার
আর আইজি (প্রিজন) জানান, ‘‘অ্যাডিশনাল আইজি (প্রিজন)-এর নেতৃত্বে যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছি তারা পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবেন৷ কারাগারের কারুর কোনো গাফিলতি প্রমাণ হলে যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ এর সঙ্গে আরো অনেক চ্যানেল আছে৷’’
রিগান বলেছে যে, সে কারাগার থেকে টুপি নিয়ে এসেছে৷ এই প্রসঙ্গে আইজি (প্রিজন) বলেন, ‘‘জঙ্গিদের কথা বিশ্বাস করবেন না৷ তারা মানুষ হত্যা করে৷ তদন্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করুন৷’’
এদিকে আদালত এলাকায় আসামিদের দায়িত্বে থাকে প্রসিকিউশন পুলিশ৷ প্রসিকিউশন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার জাফর হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি সে আইএস-এর টুপি পরে কীভাবে আদালতে গেল৷ এবং টুপিটি কীভাবে আদালতে নিয়ে গেল৷ আমরা সবাই মিলে দেখছি৷ আলাদাভাবে কিছু দেখার নেই৷’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে একজনই আইএস-এর টুপি পরেছে৷’’
সারা দেশের কারাগারে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে: আইজি (প্রিজন)
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঘটনা তদন্তের কথা বলেছেন৷
প্রসঙ্গত, মামলার তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইএস-এর টুপি পরে আদালতে যাওয়া রিগান হোলি আর্টিজান হামলায় সরাসরি অংশ নেয়াদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করে৷ ২০১৫ সালে বগুড়া সরকারি শাহ সুলতান কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে৷ তার বাড়ি বগুড়ার জামিলনগর এলাকায়, বাবা মৃত রেজাউল করিম৷
২০১৬ সালের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের সময় পালাতে গেলে রিগানকে গ্রেপ্তার করা হয়৷
যা ঘটেছিল:
বিভীষিকার ১২ ঘণ্টা
ঢাকার গুলশানের আর্টিজান ক্যাফেতে দীর্ঘ ১২ ঘণ্টার জিম্মি ঘটনার অবসান হলেও মানুষের মন থেকে আতঙ্ক যাচ্ছে না৷ এ ঘটনায় শুক্রবার রাতেই নিহত হয়েছে ২০ জিম্মি৷ নিহত হয়েছেন দুই পুলিশ কর্মকর্তাও৷
ছবি: Getty Images/M. H. Opu
ঘটনার শুরু
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে একদল অস্ত্রধারী গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালালে অবস্থানরত অজ্ঞাত সংখ্যক অতিথি সেখানে আটকা পড়েন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
দুই পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু
পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে নিহত হন বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম৷
ছবি: Getty Images/M. H. Opu
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য
কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ১৩ জিম্মিকে জীবিত উদ্ধারের পাশাপাশি ছ'জন হামলাকারীকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ বলেছেন, বাকি কয়েকজনকে হয়তো বাঁচানো যায়নি৷ এই জঙ্গি হামলায় জড়িত একজন ধরা পড়েছে বলেও শনিবার সকালে এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন তিনি৷
ছবি: Reuters
এ যেন দুঃস্বপ্ন
কমান্ডো অভিযানে মুক্ত গুলশানের ক্যাফে থেকে উদ্ধার পাওয়া ব্যক্তিদের ১২ ঘণ্টার ‘দুঃস্বপ্ন’ কাটছে না৷ তাঁদের চোখে মুখে ক্লান্তি ও ভীতির ছাপ৷ তারা বলছিলেন, কয়েকজনের মৃতদেহ দেখেছেন, অনেক জায়গায় রক্তের ছাপ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য
তাঁরা বলছেন, জিম্মিকারীরা বাংলাদেশি মুসলমানদের সুরা পড়তে বলে৷ সুরা পড়তে পারার পর তাঁদেরকে রাতে খেতেও দেওয়া হয়৷ যাঁরা হিজাব পরা ছিল, তাঁদের বাড়তি খাতির করা হয়৷
ছবি: picture alliance/ZUMA Press/S. K. Das
আইএস-এর দায় স্বীকার
তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে বলে সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ জানিয়েছে৷ এই জঙ্গি দলের মুখপত্র আমাক নিউজ এজেন্সির বরাত দিয়ে এ সব খবরে দাবি করা হয় যে, ‘তাদের’ এই হামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৪০ জন৷
ছবি: picture-alliance/abaca
কমান্ডো অভিযান
সকাল ৭ টা ৩০ মিনিটে রাতভর গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন এলাকা ঘিরে রাখার পর যৌথ সেনা, নৌ, পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ কমান্ডো দল গুলশানে অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়৷ ৮ টা ১৫ মিনিটে প্রথম দফায় নারী ও শিশুসহ ৬ জনকে উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ভবনের নিয়ন্ত্রণ ও আতঙ্কের অবসান
৮ টা ৫৫ মিনিটে ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় অভিযানকারীরা৷ গোয়েন্দা দল ভবনের ভেতর বিস্ফোরকের জন্য তল্লাশি শুরু করে৷ ৯ টা ১৫ মিনিটে ১২ ঘণ্টার রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান হয়৷