1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বিচার ব্যবস্থাবাংলাদেশ

আদালতে প্রশ্নবিদ্ধ নিরাপত্তা ও সুবিচারের অধিকার

২৫ অক্টোবর ২০২৪

অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বিচারাঙ্গনে কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না, সবাই ন্যায় বিচার পাবেন- এমনই আশা করা হয়েছিল৷ কিন্তু বাস্তবে কি তাই হচ্ছে? সবাই কি ন্যায় বিচার পাচ্ছেন?

ঢাকায় হাইকোর্ট চত্ত্বরে শিক্ষার্থীদের মিছিলের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে৷ বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষকে দেখা যাচ্ছে, কারো কারো হাতে বাংলাদেশের পতাকা৷
ঢাকায় হাইকোর্ট চত্ত্বরে শিক্ষার্থীদের মিছিল৷ছবি: Mortuza Rashed

এর আগেও আদালতের ভেতরে মিছিল হয়েছে, সমাবেশ হয়েছে৷ কিন্তু ঠিক আন্দোলনের কারণে আদালত থেকে সরাসরি কোনো সিদ্ধান্ত এসেছে এমনটি বলা যাবে না৷ কিন্তু এবার সর্বোচ্চ আদালতে মিছিল করে গিয়ে বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবি জানানো হয়েছে৷ ওইদিনই প্রধান বিচারপতি ১২ জন বিচারপতিকে চায়ের দাওয়াত দিলেন৷ ৬ জন সেই দাওয়াতে গেলেন৷ ওই ৬ জনসহ ১২ জনকে ছুটিতে পাঠানো হলো৷ 

এর আগেও বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার শুরুর দিকে আদালতে মিছিল নিয়ে গিয়ে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সব বিচারপতির অপসারণ চাওয়া হলো৷ পরবর্তীতে তাদের চাওয়া অনুযায়ী বিচারপতিদের সরে যেতে হলো৷ একজনকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেওয়ার কথা গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর তার ব্যাপারে আপত্তি তোলা হলো৷ এক পর্যায়ে তাকে সরিয়ে আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হলো৷

অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ ড. শাহজাহান সাজু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কোন বিচারককে বেঞ্চ দেবেন আর কোন বিচারককে বেঞ্চ দেবেন না সেটা প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার৷ ছাত্ররা যেভাবে উচ্চ আদালতের ভেতরে এসে মিছিল করলো, সেখানে পুলিশ তো বাধা দিলো না৷ এখন আদালতেরও তো নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই যে তারা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে৷ ফলে তাদের আন্দোলনের কারণেই ভয়ে পড়ে বা চাপে পড়ে প্রধান বিচারপতি এটা করেছেন, সে কথা তো আপনি বলতে পারবেন না৷ কারণ, এর তো কোনো প্রমান নেই৷ তবে ছাত্রদের এভাবে কোর্টের মধ্যে মিছিল করার দরকার ছিল না৷ আদালতের নিরাপত্তা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দেখা উচিত৷''

গত ১৬ অক্টোবর আওয়ামী লীগের 'ফ্যাসিস্ট বিচারক' আখ্যা দিয়ে তাদের পদত্যাগের দাবিতে হাইকোর্ট ঘেরাও করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন৷ দুপুরে তারা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থান নেন৷ তাদের স্লোগান, অবস্থান কর্মসূচিতে অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হয় হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে৷এক পর্যায়ে প্রধার বিচারপতি ১২ বিচারপতিকে চায়ের আমন্ত্রণ জানান৷ পরে ১২ জনকেই ছুটিতে পাঠানো হয়৷

সাবেক বিচারক, আইনজীবী এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য মাসদার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আন্দোলন বা দাবির মুখে বিচারপতিদের পদত্যাগে বাধ্য করা শতভাগ অন্যায় এবং বেআইনি৷ একজন বিচারপতি ওই আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত, তাই তাকে বাদ দিতে হবে- এটা তো হতে পারে না৷ তিনি যদি তার পেশাগত দক্ষতা ও সততা দেখান, তাহলে তাকে পদত্যাগ করতে হবে কেন? এটা ঠিক না৷''

তবে সুপ্রDম কোর্ট বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম বদরুদ্দোজা বাদল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ছাত্রদের দাবির মুখে যে, কয়েকজন বিচারককে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়৷ আইনজীবীরাও তাদের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করেছে৷ আমাদের কাছে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রমানও আছে৷ মিডিয়াতেও অনেক কিছু এসেছে৷ সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রধান বিচারপতি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার প্রধান বিচারপতির আছে৷ ফলে আন্দোলনের মুখে এটা হয়েছে বলা ঠিক হবে না৷''

ছুটিতে পাঠানো হাইকোর্টের ১২ বিচারপতির ভাগ্য এখন নির্ধারণ করবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল৷ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর ওপর রিভিউ আবেদন নাকচ হওয়ায় ওই বিচারকদের বিষয়ে অভিযোগের তদন্ত হবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে৷ এর আগে গত সরকারের আমলে আরো তিন বিচারপতির বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল৷ আর তাই এই ১৫ বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে৷

২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার বিচারপতিদের অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদকে দিয়েছিল৷ দেশের সর্বোচ্চ আদালত তা বাতিল করে দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রেখেছে৷

আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি তারিক উল হাকিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ছাত্ররা যেভাবে আদালতের ভেতরে এসে মিছিল করে দাবি জানিয়েছে, সেটা না করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করলেই ভালো হতো৷ তারপর দাবি পূরণ না হলে আন্দোলন করতে পারতো৷ এভাবে আন্দোলনের প্রয়োজন ছিল না৷''

প্রথমদিকে গ্রেপ্তারকৃতদের পক্ষে কেউ আইনজীবী হিসেবে দাঁড়াচ্ছিলেন না৷ আসামীদের আদালতে তোলার সময় তারা নানা ধরনের নিপীড়নের শিকার হচ্ছিলেন৷ এমনকি নারীদেরও ছাড় দেওয়া হয়নি৷ সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনি বা সাংবাদিক ফারজানা রূপাও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন৷ সম্প্রতি অভিযুক্তদের পক্ষে কেউ আইনজীবী হিসেবে দাঁড়ালে তাদের উপরও হামলা করা হচ্ছে৷ মারধর করা হচ্ছে৷ ফলে আইনজীবীদের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করছে৷

‘পরিবর্তন আশা করেছিলাম, সেটা হয়নি৷ আশাটা পূরণ যে হবে সেটার লক্ষণ দেখছি না৷’

This browser does not support the audio element.

সর্বশেষ দুই দিন আগে গ্রেপ্তারকৃত সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনের পক্ষে আদালতে তার মামলা মোকাবেলা করেন আইনজীবী মোশারফ হোসেন শাহীন৷ এক পর্যায়ে তাকে লাঞ্ছিত করা হয়৷ মোশারফ হোসেন শাহীন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত আড়াই মাসে যাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে নেওয়া হয়েছে; তাদের সবাইকে অপদস্থ করা হয়েছে৷ যারা ডিফেন্স করতে যাচ্ছেন তাদের উপরও হামলা করা হচ্ছে৷ আক্রমণ করা হচ্ছে৷ আদালত হল শেষ আশ্রয়স্থল৷ এই কাজের মাধ্যমে বাইরে খারাপ বার্তা যাচ্ছে৷ আমি নিজেও ডিফেন্স করতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছি৷ আমি আশা করবো, সবাই যেন সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন৷''

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে বিচার কার্যক্রম একটা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে চলে৷ ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে বাদী ও আসামি দুই পক্ষেই আইনজীবী থাকতে হয়৷ কিন্তু বর্তমান সরকারের সময় আসামি পক্ষকে আইনজীবী রাখার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না৷ প্রত্যেক আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে৷ সেই সুযোগও পাচ্ছেন না তারা৷ আমি নিজেও কোনো মক্কেলের পক্ষে দাঁড়াতে পারছি না৷ শুধু আমি না, আসামী পক্ষের কোনো আইনজীবীই আদালতে যেতে পারছেন না৷ এভাবে কি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব? এখন যেটা হচ্ছে সেটা কোনো আইন নয়, এটাকে কাজীর বিচারও বলা যাবে না৷''

বিগত সরকারের মন্ত্রী-এমপি মিলিয়ে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ব্যক্তির গ্রেপ্তারের খবর জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে মনযোগ আকর্ষণ করেছে৷ তাদের অধিকাংশকে আদালতে নেওয়ার সময় তারা নানা ধরনের হেনস্থার শিকার হয়েছেন৷ পরিস্থিতিরউন্নতির উপায় জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদে ন্যায় বিচারের কথা বলা হয়েছে৷ ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে আইনজীবী নিযুক্ত করার কথাও বলা হয়েছে৷ এখন যারা ডিফেন্স করতে যাবেন, তারা তো ভয়ের মধ্যে আছেন৷ প্রধান বিচারপতি বারবার বলছেন, অভিযুক্তকে আইনজীবীর প্রাপ্তির সুযোগ দেওয়ার জন্য৷ কিন্তু আইনজীবীরা দাঁড়ালেই মারধরের শিকার হচ্ছেন৷ এমনকি অভিযুক্ত নিজের আদালতে কোনো কথা বলতে পারছেন না৷ এমন পরিস্থিতিতে কোর্টও ভয়ের শিকার হন৷ এভাবে চললে অভিযুক্তরা ন্যায় বিচার বঞ্চিত হবেন৷''

তবে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা সত্যি যে, প্রত্যেকটা আসামীর আইনি কাঠামোতে নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে৷ একই সঙ্গে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, চেতনা বোধ৷ জুলাই হত্যাকাণ্ডের আদর্শিক মূলমন্ত্র কি ছিল? ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক যুদ্ধ৷ রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি৷ আপনাকে মনে রাখতে হবে, আদালতে যেটা হচ্ছে, সেটা ‘সিভিলাইজ প্রোটেস্ট'৷ এটা তো থাকতে পারে৷ আমি তো লন্ডনে থাকা অবস্থায় দেখেছি, টনি ব্লেয়ারকে ডিম নিক্ষেপ করা হয়েছে৷ ফলে, এটা সারা বিশ্বেই আছে৷ কাদের বিরুদ্ধে এটা হচ্ছে, যারা গণধিকৃত, যদিও যেটা হচ্ছে সেটা কাম্য না৷''

‘এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার প্রধান বিচারপতির আছে’

This browser does not support the audio element.

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আসামীর পক্ষে আইনজীবীর দাঁড়াতে পারাটা অধিকার৷ সেটাই নিশ্চিত করা হচ্ছে না৷ সবাই নাগরিক কি না সেটাই এখন প্রশ্ন৷ একটা পক্ষ বলতে চাচ্ছে, আরেক পক্ষ এদেশের নাগরিকই না৷ আমরা আগের পথেই চলে গেছি কিনা সেটাও ভাববার বিষয়৷ একটাই পার্থক্য শুধু পুলিশ গুলি করছে না৷ দেশে সরকার দুইটা কিনা সেটাও প্রশ্ন! ছাত্ররাও সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, আবার যারা শপথ নিয়েছেন তারাও চালাচ্ছেন৷ ছাত্রদের চাওয়াতেও পরিবর্তন হচ্ছে৷ প্রত্যাশা করেছিলাম, পরিবর্তন আশা করেছিলাম, সেটা হয়নি৷ আশাটা পূরণ যে হবে সেটার লক্ষন দেখছি না৷ এই বিষয়গুলো খুবই হতাশাজনক৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ