আদালতে রেকি করে ৩ মাস পূর্বে জঙ্গি ছিনতাইয়ের প্রস্তুতি
এম আবুল কালাম আজাদ
২১ নভেম্বর ২০২২
পালানোর পরিকল্পনা ছিল বলে জঙ্গিদের সাতজন কারাগার থেকে কেডস পরে আদালতে হাজিরা দিতে আসে৷ সতীর্থদের সাথে মোবাইলে যোগাযোগের মাধ্যমে পালানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়৷
বিজ্ঞাপন
পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, নিজ সংগঠনের কর্মীদের ছিনিয়ে নিতে আনসার আল ইসলামের নেতারা রেকি করে আদালত প্রাঙ্গনে৷ কয়েকটি হাজিরার দিন তারা আদালতে যায়, সার্বিক অবস্থা ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করে৷ তিন থেকে চার মাস রেকি করার পর সিদ্ধান্ত নেয়৷
আদালতে জঙ্গিদের আনা-নেয়ার সময় কতজন পুলিশ থাকে নিরাপত্তায়? তাদের হাতে কী ধরনের অস্ত্র থাকে? আদালতে আনার পর নিরাপত্তাব্যবস্থা কেমন হয়?-এসব বিষয় কয়েকটি হাজিরায় ভালোমতো খেয়াল করা হয়৷ এরপরই পুলিশকে হামলা করে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা আঁটে নিষিদ্ধ ঘোষিত এই জঙ্গি সংগঠন৷
‘‘তারা খেয়াল করে যে অন্য আসামীদের মতো জঙ্গিকে ‘ক্যাজুয়ালি’ আদালতে আনা হয়৷ তাছাড়া আদালতে আনার পর কড়া পাহারা থাকে না,’’ বলছিলেন কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)-এর এক কর্মকর্তা৷
গতকাল আদালত থেকে আনসার আল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়৷ তাদের সাথে থাকা অন্য জঙ্গিদেরও ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ছিল৷ তাদের প্রস্তুতিও ছিল সেরকম৷ এজন্য বেশ কয়েকজন সহযোগী আদালতের বিভিন্ন জায়গায় রেডি ছিল৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত অন্যদের নিতে ব্যর্থ হয়৷
‘‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আমদের ধারণা ৭/৮ জন জঙ্গি ছিনতাই কাজে জড়িত ছিল৷ স্প্রে করে জঙ্গি ছিনিয়ে নিলেও তাদের অন্য সকল প্রস্তুতি ছিল৷ তবে তা ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি,’’ জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার তদন্তে নিয়োজিত পুলিশের একজন কর্মকর্তা ডয়েচে ভেলেকে জানান৷
এদিকে আদালত প্রাঙ্গন থেকে পুলিশ একটি চাবি ও লোহা কাঁটার জন্য ব্লেড উদ্ধার করেছে৷ এ থেকেই প্রমান হয় যে জঙ্গিদের সকল ধরনের প্রস্তুতি ছিল৷
আলোচিত কয়েকটি জঙ্গি হামলা
১৯৯৯ সালে উদীচী দিয়ে শুরু৷ এরপর বেশ কয়েকটি আলোচিত হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা৷ ছবিঘরে থাকছে সেসব কথা৷
ছবি: bdnews24.com
উদীচীর সমাবেশে হামলা
১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ যশোরে সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১০৬ জন আহত হয়েছিলেন৷ পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার সূচনা হয় ১৯৯৯ সালে৷ হরকাতুল জিহাদ (হুজি) উদীচীর সমাবেশে হামলা করেছিল বলে পুলিশের ঐ ইউনিট জানিয়েছে৷ উপরের ছবিটি প্রতীকী৷
ছবি: bdnews24.com
বাংলা বর্ষবরণে হামলা
২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের সকালে ঢাকার রমনা বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছিলেন৷ এই ঘটনায় শতাধিক আহতের মধ্যে অনেকেই পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন৷ এই হামলার মধ্য দিয়ে হুজি তাদের শক্ত অবস্থানের জানান দিয়েছিল৷ হামলার দায়ে ২০১৪ সালে হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
ব্রিটিশ হাইকমিশনারের উপর গ্রেনেড হামলা
২০০৪ সালের ২৫ মে সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলা হয়েছিল৷ এতে পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত হয়েছিলেন৷ আনোয়ার চৌধুরীসহ অর্ধশত মানুষ আহত হন৷ হামলার দায়ে ২০০৮ সালে হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ (ছবি) তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড ও দুইজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ ২০১৭ সালের এপ্রিলে মুফতি হান্নানসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
ছবি: A.M. Ahad/AP/picture alliance
আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন প্রাণ হারান৷ ২০১৮ সালে মামলার রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়৷ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের জঙ্গিরা হামলায় অংশ নেয়৷ তবে ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিল তখনকার জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Munir
৬৩ জেলায় বোমা হামলা
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়েছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)৷ এই হামলায় দুজন নিহত ও অন্তত ১০৪ জন আহত হয়েছিলেন৷
ছবি: DW/H. U.R.Swapan
ব্লগার হত্যা
জঙ্গি হামলায় বেশ কয়েকজন ব্লগার ও মুক্তমনা নিহত হয়েছেন৷ ২০১৩ সালে আহমেদ রাজিব হায়দার হত্যা দিয়ে শুরু৷ এরপর ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়সহ আরও কয়েকজন হত্যার শিকার হন৷ ২০২১ সালে অভিজিৎ হত্যার মামলার রায়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়৷ তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য৷
ছবি: Robert Richter
হোসেনি দালানে হামলা
২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর আশুরা উপলক্ষ্যে হোসেনি দালানের শোক মিছিলে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা৷ এ ঘটনায় একজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ চলতি বছরের মার্চে দেয়া রায়ে জেএমবির দুই সদস্যকে দশ ও সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
শিয়া মসজিদে হামলা
২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বর বগুড়ার এক শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ হামলার প্রায় ১৪ মাস পর আদালতে দাখিল করা মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল জেএমবি এবং ইসলামি ছাত্রশিবির হামলায় অংশ নেয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোলি আর্টিজানে হামলা
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় ১৭ জন বিদেশিসহ ২২ জন নিহত হন৷ পাঁচজন জঙ্গি অস্ত্র ও বিস্ফোরক নিয়ে বেকারিতে ঢোকার পর সবাইকে জিম্মি করেন৷ এরপর পুলিশ ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশের দুই কর্মকর্তা জঙ্গিদের গুলি ও বোমার আঘাতে মারা যান৷ কয়েকজনকে ছেড়ে দিলেও জঙ্গিরা অন্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করে৷ জঙ্গিরা সবাই সেনাবাহিনীর অভিযানে নিহত হয়৷ ইসলামিক স্টেট এই হামলার দায় স্বীকার করেছিল৷
ছবি: bdnews24.com
জাফর ইকবালের উপর হামলা
২০১৮ সালে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক তরুণ ছুরি নিয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালায়৷ এই ঘটনায় এ বছরের এপ্রিলে ফয়জুল হাসান নামের একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ফয়জুল কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য কিনা তা প্রমাণিত হয়নি৷ তবে তিনি বিভিন্ন ইন্টারনেট সাইট থেকে জিহাদি প্রবন্ধ ও বই ডাউনলোড করে পড়ে, উগ্রবাদী বক্তাদের বক্তব্য শুনে সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ হন৷
ছবি: bdnews24.com
10 ছবি1 | 10
জঙ্গি ছিনতাই এত সহজ!
২০১৪ সালে সতীর্থ জঙ্গিদের ছিনিয়ে নিতে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল আরেক জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবির সদস্যদের৷
সে বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যান আটকে বোমা ছুড়ে ও গুলি চালিয়ে জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন ও রাকিবুল হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ এবং বোমা বিশেষজ্ঞ জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজানকে ছিনিয়ে নেয়৷
ত্রিশালে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হলেও সেটা গতকালের মতো এত সহজ ছিল না৷ কোনোরূপ বোমা না ফাটিয়ে বা গুলি না করে পুলিশের মুখে স্প্রে করে ফাঁসির দুই আসামী নিয়ে চলে যায়৷
গতকাল আদালতে ১২ জঙ্গির নিরাপত্তায় ছিল চারজন পুলিশ৷ অথচ এমন জঙ্গিদের বেলায় আরো বেশি নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকার কথা, কিন্তু তা ছিল না৷ এছাড়া পালিয়ে যাওয়া দুজনের জন্য ছিল মাত্র একজন পুলিশ, যা একেবারেই কাম্য না৷ যথেষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকার কারণে আনসার আল ইসলাম তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যায়৷
শুধু পুলিশের দোষ?
ছিনতাইয়ের ঘটনা পূর্ব-পরিকল্পিত উল্লেখ করে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকভাবে এই দায় পুলিশের উপর বর্তায় সন্দেহ নাই৷ আগেও সবাই পুলিশকে দায়ী করেছে৷ কিন্তু এমন ঘটনার দায় কারা ও আদালত কর্তৃপক্ষএএড়াতে পারে না৷
‘‘আমাদের কাছে তথ্য আছে যে কারাগারে অবৈধভাবে মোবাইল ব্যবহার করা হয়৷ জঙ্গিরাও এই সুযোগ নেয়৷ অনেকে ল্যাপটপ ও টেলিভিশনও ব্যবহার করে থাকে৷ জেলে এমন সুযোগ পেয়েছে বলে জঙ্গিদের পক্ষে পরিকল্পনা করতে সুবিধা হয়,” অভিযোগ করে বলছিলেন এক কর্মকর্তা৷
অন্যদিকে আদালতে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা দরকার বলে মনে করেন পুলিশের কর্মকর্তারা৷ আদালত প্রাঙ্গন সাধারণত জনাকীর্ণ থাকে৷ বিভিন্ন ধরনের আসামীদের সেখানে বিচারের জন্য আনা হয়৷ তাই সেখানে পর্যাপ্ত পুলিশ নিয়োজিত করার পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন পরিকল্পনা ও তদারকি৷