আদালতে বিচারক ও আইনজীবীরা হিজাব পরতে পারবে না বলে রায় দিয়েছে জার্মানির বাভেরিয়া রাজ্যের একটি সাংবিধানিক আদালত৷ বাভেরিয়া রাজ্য কর্তৃপক্ষের হিজাব বিষয়ে নিষাধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টিকে বৈধতা দিয়ে এ রায় দেয় আদালত৷
বিজ্ঞাপন
বাভেরিয়া রাজ্য কর্তৃপক্ষের হিজাব বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিবাদে স্থানীয় একটি মুসলিম সংগঠনের করা আবেদনের প্রক্ষিতে এ রায় দিয়ে আদালত জানায়, ধর্মীয় বা অন্য যে কোনো মতাদর্শ বিষয়ে নিরেপক্ষ থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে বিচার বিভাগের৷
ক্রুশ বিতর্ক
রাজ্যের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করা মুসলিম সংগঠনটি দাবি করেছিল যে, বাভেরিয়া কর্তৃপক্ষের আরোপিত এ নিষেধাজ্ঞা দেশের ধর্ম বিষয়ক আইনের লঙ্ঘন, কেননা বাভেরিয়ার আদালতে খিষ্টানদের ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ ঝোলানো হয়৷ মুসলিম সংগঠনটির এ যুক্তি প্রত্যাখ্যান করে আদালত জানায় যে, ক্রুশ ঝোলানোর বিষয়টি তাঁদের যুক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়৷ বরং এটি আদালতের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত৷ আদালত আরো জানায় যে, হিজাব পরার বিষয়ে এ নিষেধাজ্ঞা কোনোভাবেই লিঙ্গবৈষম্য হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না৷ কারণ আদালত পুরুষদের বেলায়ও সব ধরনের ধর্মীয় পোশাক পরে আদালতের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে৷
মেয়েদের মাথা ঢাকা
খ্রিষ্টধর্ম, ইহুদি বা ইসলাম ধর্ম, সব ধর্মেই নারীদের মাথা ঢাকার প্রথা আছে – কোথাও বেশি, কোথাও কম৷ কিন্তু এই সব প্রথার মধ্যে সাদৃশ্যটা কোথায়? মাথা ঢাকার ব্যাপারে মহিলারাই বা কী ভাবেন?
ছবি: Jüdisches Museum Berlin/Yves Sucksdorff
হিজাব
যে সব মুসলিম মহিলারা মাথা ঢাকেন, তাঁরা সবাই যে শুধু ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলেন, এমন নয় – বলে ভিয়েনা নিবাসী তুর্কি শিল্পী নিলবর গ্যুরেজ-এর অভিমত৷ তাঁর একটি ভিডিও পার্ফর্মেন্সের নাম ‘সোয়ুনমা/আনড্রেসিং’ (২০০৬) – যার চারটি ছবি এখানে দেখতে পাচ্ছেন৷ ভিডিওতে শিল্পী একটির পর একটি ‘পর্দা’ সরাচ্ছেন ও সেই সঙ্গে তাঁর পরিবারের মহিলাদের নাম করছেন৷
ছবি: Nilbar Güres
পরচুলা
‘কভার্ড’ (আবৃত) শীর্ষক এই আত্মপ্রতিকৃতিতে আনা শ্টেনশ্লেগার দু’টি পরচুলা পরে রয়েছেন৷ ছবিটি তোলা হয় ২০০৯ সালে৷ আনা নিজে ধর্মনিষ্ঠ ইহুদি৷ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ইহুদি মহিলারা তাঁদের চুল ঢাকতেন একটি ‘টিকেল’ বা মাথা ঢাকার কাপড় দিয়ে৷ পরচুলাও তো মাথা ঢাকে – এই হলো আনার আত্মপ্রতিকৃতির বক্তব্য৷
ছবি: Anna Shteynshleyger
ধর্ম এক, কিন্তু মাথা ঢাকার পন্থা নানা
হিজাব, নিকাব, আল-আমিরা, শায়লা, এশার্প – মুসলিম মহিলাদের মাথা বা চুল ঢাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরিধান আছে৷ দেশ হিসেবেও ‘পর্দা’ আলাদা হতে পারে, যেমন ইরানের মহিলাদের ‘চাদর’ বা ইন্দোনেশিয়ার মহিলাদের ‘কেরুডুং’ ও ‘টুডুং’৷ ছবিতে যে প্রদর্শনীটি দেখা যাচ্ছে, সেখানে এই বৈচিত্র্যই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে৷
ছবি: Jüdisches Museum Berlin/Yves Sucksdorff
গির্জায় মাথা ঢাকা
বার্লিনের একটি রুশ সনাতনপন্থি গির্জার এই দৃশ্যটি তুলেছেন আলোকচিত্রী মারিয়া মিহাইলোভা৷ ‘মাস’ বা প্রার্থনাসভার জন্য চুল ঢাকার প্রথা খ্রিষ্টধর্মের অপেক্ষাকৃত ছোট সম্প্রদায়গুলির মধ্যে আজও বজায় থাকলেও, ক্যাথলিক বা প্রটেস্টান্ট গির্জাগুলিতে তা আর প্রায় দেখা যায় না৷
ছবি: Marija Mihailova
চুল দিয়ে লজ্জা ঢাকা?
আরব দেশগুলিতে লম্বা কালো চুল নারীর সৌন্দর্যের একটি অপরিহার্য উপাদান বলে গণ্য হয়৷ ইরানি শিল্পী মন্দানা মোঘাদ্দাম তাঁর ‘প্রথম চেলগিস’ শীর্ষক ২০০২ সালের ‘মূর্তি’-টিকে শুধুমাত্র চুল দিয়ে সাজিয়েছেন – কিন্তু এমনভাবে যে, মেয়েটিকে দেখবার উপায় নেই৷ এর পিছনে রয়েছে এক অপহৃত কিশোরী সম্পর্কে একটি ইরানি রূপকথা: রূপকথার কিশোরীর নাকি ৪০টি বিনুনি ছিল৷
ছবি: Mandana Moghaddam
শুধু স্বামীর জন্য চুল?
ইদিশ ভাষায় ‘টিকেল’ হলো ধর্মনিষ্ঠ ইহুদি মহিলাদের মস্তকের পরিধান৷ ২০০১ সালে তোলা এই আলোকচিত্রে লিওরা লাওর জেরুসালেমের উগ্র সনাতনপন্থি মেয়া শেয়ারিম এলাকার মহিলাদের দেখিয়েছেন৷ প্রথা অনুযায়ী বিবাহের পর শুধুমাত্র মহিলার স্বামীই তাঁর চুল দেখতে পাবেন৷ কাজেই বিয়ের পর মহিলারা কাপড়, নানা ধরনের টুপি বা পরচুলা দিয়ে মাথা ঢাকেন৷
ছবি: Leora Laor
মাথা ঢাকা, চুল ঢাকা?
নিউ ইয়র্কের কোনি আইল্যান্ডের সৈকতের একটি দৃশ্য৷ ছবিটি তোলেন ফেডেরিকা ভালাব্রেগা, ২০১১ সালে৷ ছবিতে যে ইহুদি মহিলাদের দেখা যাচ্ছে, তারা সবাই মাথা ঢেকে রেখেছেন, যদিও তার তলা থেকে মাথার চুল বেরিয়ে রয়েছে৷ এভাবেই মাথা ঢাকার প্রথার নানান ব্যাখ্যা ও নানা সংস্করণ চালু আছে...৷
ছবি: Federica Valabrega
‘বুর্কিনি’
বোরকা আর বিকিনি, এই দু’টি শব্দ মিলিয়ে যে বস্তুটির সৃষ্টি, তা যে বিতর্ক সৃষ্টি করবে, তা তো জানাই৷ মুসলিম মহিলাদের সমুদ্রস্নানের জন্য সৃষ্ট এই পরিধেয়টি আবার পশ্চিমের অনেক নারীবাদীর কাছে অগ্রহণযোগ্য৷
ছবি: Jüdisches Museum Berlin/Yves Sucksdorff
8 ছবি1 | 8
গত কয়েক বছর ধরেই জার্মানিতে নারীদের, বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত নারীদের হিজাব পরার বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক চলছে৷ সর্বশেষ জার্মান সংসদের সিডিইউ-সিএসইউ-এর ডেপুটি চেয়ারম্যান কার্স্টেন লিনেমান দেশটিতে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েদের হিজাব পরার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার কথা বলেন৷ কার্স্টেন লিনেমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ছেলেদের মতো মেয়েদেরও মুক্তভাবে বেড়ে উঠার স্বাধীনতা থাকা উচিত৷
বিতর্কিত পরিকল্পনা
গত বছর জার্মানির সবচাইতে জনবহুল রাজ্য নর্থ রাইন-ওয়েস্টফেলিয়া কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েদের স্কুলে হিজাব পরার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনা করে৷ সমালোচনাকারীরা বলছেন, নারী নির্যাতনের একটি প্রতীক হলো হিজাব৷ এর বিপরীতে আরেক পক্ষ যুক্তি দেখাচ্ছে যে, হিজাব পরিধানের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ৷ আবার কেউ কেউ বলছেন, পোশাক নিয়ে এ ধরনের সমালোচনা ইসলামবিরোধী মনোভাবের প্রকাশ৷
আরআর/ডিজি (ডিপিএ, ইপিডি)
মুসলিম মেয়েদের সাঁতার শেখা সহজ করছে জার্মানি
সাঁতার জানা প্রতিটি মানুষের জন্যই জরুরি৷ তাই ধর্ম বিশ্বাসের কারণে সাঁতার শেখা থেকে মুসলিম মেয়েরা যাতে বিরত না থাকে, সেজন্য জার্মানির একটি স্কুলে তাদের ‘বুর্কিনি’ পরে সাঁতার শেখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/Rolf Haid
কোনো কারণেই শিশুরা যেন পিছিয়ে না পড়ে
কোনো শিশুর মাতৃভূমি অন্য দেশ কিংবা সে ভিন্ন ধর্মের হলেও সে যেন সাঁতার শেখার সুযোগ পায়, তা নিশ্চিত করতে মুসলিম মেয়েদের শরীর ঢাকা সাঁতারের পোশাক ‘বুর্কিনি’ পরেই সাঁতার শেখার সুযোগ দেয়া হয়েছে জার্মানির একটি স্কুলে৷ জানান জার্মনির পরিবারমন্ত্রী ফ্রান্সিসকা গিফে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শিশুর মা-বাবাকেই বুঝতে হবে
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, জার্মানিতে শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ শিশুই ঠিকমতো সাঁতার জানে না, যা আসলে বিপজ্জনক৷ মুসলিম মেয়েরা যাতে এ দেশের শিক্ষার নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়, সাঁতারের ক্লাসেও যাতে তারা অংশ নেয়, তা নিশ্চিত করারই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/M. Skolimowska
কিন্তু বাবাদের আপত্তি...
কিন্তু অনেক মুসলিম মেয়ের বাবা কোনোভাবেই মেয়েকে সাঁতার শিখতে দিতে রাজি নন৷ ফলে মুসলিম মেয়েদের সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷ শিক্ষকরাই ডয়চে ভেলেকে এ কথা জানিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/ZB
জার্মান মেয়েদের লাইফস্টাইল তাদের অপছন্দ
জার্মানিতে বসবাসরত মুসলিমদের অনেকের কাছে জার্মান মেয়েদের জীবনযাত্রা বা পোশাক-আশাক এখনো গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি৷ এ কারণেও মুসলিম পরিবারের অভিবাবকরা তাঁদের মেয়েদের ব্যাপারে একটু বেশি রক্ষণশীল থেকে যাচ্ছেন বলে অনেকের ধারণা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Kalaene
যেখানে অনুমতি মিলেছে
জার্মানির নর্থরাইন ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্যের হ্যার্নে শহরের একটি স্কুলে মুসলিম মেয়েরা বুর্কিনি পরে সাঁতার শেখার অনুমতি পেয়েছে৷ ভাড়া দেওয়ার জন্য ২০টি বুর্কিনিও রাখা হয়েছে সেখানে৷
ছবি: DW
আর কোনো বাধা নেই...
২০১৩ সালে ফেডারেল সাংবিধানিক আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল, বুর্কিনি অনুমোদন পেলে সাঁতার শেখার ক্লাসে মুসলিম মেয়েদের অংশ নেয়াও ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করবে৷ হ্যার্নে শহরের স্কুলটিতে বুর্কিনি পরে সাঁতার শেখার অনুমতি দিয়ে দেয়ায় এবার হয়ত মুসলিম মেয়েদের সাঁতার শেখার পথে কোনো বাধা থাকবে না৷