1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আদিবাসীদের সামাজিক ভূমি অধিকার এবং বর্তমান চিত্র

২৬ জুন ২০১৭

বাংলাদেশে ভূমি মালিকানার প্রচলিত আইনের চেয়ে আদিবাসীদের ভূমি মালিকানার ধরণ আলাদা৷ তাঁরা বংশপরম্পরায় ভূমির মালিকানা লাভ করেন৷ সেই মালিকানা সামাজিক ও মৌখিক৷

Bangladesch   Jhum Kultur
ছবি: DW/M. Mamun

সরকারি হিসেবে মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ২৭টি আদিবাসী গোষ্ঠীর৷ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তাঁর গবেষণায় বলেছেন, ‘‘২৭ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী মানুষের অনুপাত ছিল ৭৫ শতাংশ৷ আর এখন তা ৪৭ শতাংশ৷ গত তিন দশক ধরে ঐ অঞ্চলে আদিবাসী কমছে আর বাঙালিদের সংখ্যা বাড়ছে৷ পাহাড়িরা হারিয়েছে ভূমি-বনাঞ্চল আর আমদানি করা সেটলার বাঙালিরা দুর্বৃত্ত আমলা প্রশাসনের যোগসাজশে তা দখল করেছে৷''

তিনি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, গত ৬৪ বছরে সমতলের ১০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দুই লাখ দুই হাজার ১৬৪ একর জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে, যার দাম প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা৷ 

Sangib Drong - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

সমতলের আদিবাসীদের ভূমির মালিকানা দেশের প্রচলিত আইনে নির্ধারণ করা হলেও তিন পার্বত্য জেলায় আদিবাসীদের ভূমি মালিকানা সামাজিক৷ ‘সার্বজনীন সম্পদ-সম্পত্তি মালিকানা অধিকার' নীতিই হলো তাদের ভূমি মালিকানার ভিত্তি৷ ফলে এই মালিকানা বংশ পরম্পরায় মৌখিক৷ তিনটি সার্কেলের আওতায় পার্বত্য পাড়ার হেডম্যান এবং কারবারিরা এর ব্যবস্থাপনা করে থাকেন৷ কিন্তু গত ৩০ বছরে এই পার্বত্য পাড়ার নিয়ন্ত্রণাধীন ভূমির পরিমাণ শতকরা ৫১ ভাগ কমে গেছে৷ আরেক কথায় বলা যায়, পাহাড়িদের সামাজিক মালিকানার অর্ধেকেরও বেশি ভূমি ও ভূসম্পদ হাতছাড়া হয়ে গেছে৷

অধ্যাপক আবুল বারাকাত তাঁর গবেষণায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে জমিজমা এবং বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদের ১৬টি কৌশলের কথা বলেছেন৷ এইসব কৌশলের মধ্যে রয়েছে সরকারি বনায়ন, খাস সম্পত্তি রক্ষা, ন্যাশনাল পার্ক বা জাতীয় উদ্যান, টুরিস্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা, ইকো পার্ক স্থাপন, ভূমি জরিপ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, শত্রু সম্পত্তি আইন, ভুয়া দলিল, গুজব ছড়িয়ে সংঘাত, দাঙ্গা, জোর-জবরদস্তি, ভীতি সৃষ্টি প্রভৃতি৷ তাঁদের রক্ষার নামেই রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও ভূমি দস্যুরা তাঁদের উচ্ছেদ করে৷ কয়েকমাস আগে গাইবান্ধার চিনিকল এলাকায় সাঁওতালদের উচ্ছেদে সেইসব রাজনৈতিক নেতারাই নেতৃত্ব দিয়েছেন, যাঁরা কয়েক বছর আগে তাঁদের রক্ষার আন্দোলন শুরু করেছিলেন৷

১৯৫০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাপ্তাইয়ে বাঁধ দেওয়ার নামে যেমন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করা হয়৷ তেমনি মধুপুরে ন্যাশনাল পার্ক করার নামেও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করা হয়৷ মৌলভীবাজারের মাগুরছড়ায়ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন তাঁরা৷ ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা এবং ভূমি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষা করার কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না৷

Rabindra nath saren - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

যুগ যুগ ধরে আদিবাসীরা পাহাড়ে তাদের নিজস্ব সামাজিক পদ্ধতিতে ভূমি ব্যবহার করত৷ ব্রিটিশ শাসনামলেই পার্বত্য অঞ্চলের জন্য আলাদা ভূমি আইন করা হয়, যা চিটাগাং হিলট্র্যাকটস রেগুলেশন অ্যাক্ট নামে পরিচিত৷ সেই আইনে একই ধরনের স্বীকৃতি দেয়া হয়৷ কিন্তু পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে আদিবাসীরা উচ্ছেদের শিকার হন৷ ভূমির অধিকার বঞ্চিত হতে শুরু করেন৷ পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের তিনটি সার্কেল আছে – চাকমা, মং এবং বোমাং৷ চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১৯৭১ এবং ১৯৮৯ সালে আইনের পরিবর্তন করে বন্দোবস্ত ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়৷ আদিবাসীদের ভূমি বন্দোবস্তের সুযোগ করে দেয়া হয়, যা হিলট্র্যাক্টস রেগুলেশনের বিরোধী৷ জিয়াউর রহমানের সময় দেশের অন্যান্য জেলার মানুষকে পাহাড়ে জমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়৷ ওই সময় অন্য জেলা থেকে সাড়ে চার লাখ মানুষ পাহাড়ে আসে৷'' 

আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘‘পাহাড়ে এরইমধ্যে আদিবাসীরা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে৷ যেখানে মাত্র শতকরা তিনভাগ বাঙালি ছিল এখন তারা হয়ে গেছে ৫০ ভাগেরও বেশি৷ আমাদের লক্ষ লক্ষ একর জমি বেদখল হয়ে গেছে৷ এখন সেখানে জুম চাষের জমি নিয়ে নেয়া হচ্ছে৷ কাপ্তাই বাধের মাধ্যমে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হয় ষাটের দশকে৷ এখন সাজেক, নীল গিরি-নীলাচল দখল হয়ে গেছে৷ এখানে পিকনিক স্পট করা হয়েছে এটা করতে পারে না৷''

দেবাশীষ রায় বলেন, ‘‘পাহাড়িদের নিজস্ব হেডম্যান ও কারবারি প্রথার মাধমে মৌখিক ভূমি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জেলা পরিষদ এবং বিভাগীয় কমিশনারও পার্বত্য ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত৷ কিন্তু আইন হলো হেডম্যান ও কারবারিদের অনুমোদন ছাড়া পার্বত্য জেলার ভূমি বন্দোবস্ত দেয়া যাবে না৷ তবে এই আইন মানা হয় না৷ বাণিজ্যিকভাবে এবং প্রভাবশলীরা বন্দোবস্তের নামে পাহাড়ের জমি দখল করছে৷''

সঞ্জীব দ্রং আরো বলেন, ‘‘বংশ পরম্পরায় ভূমির মালিকানা আন্তর্জাতিভাবে স্বীকৃত৷ আদিবাসীদের সামাজিক মালিকানা জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত৷ আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য শান্তি চুক্তিতেও এর স্বীকৃতি রয়েছে৷ কিন্তু মানা হচ্ছে না৷''

তিনি বলেন, ‘‘ভারতের মেঘালয়ের শিলংয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী চাইলেও এক কাঠা জমি কিনতে পারবেন না৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট চাইলেও নিউ মেক্সিকো বা সিয়াটলে জমি কিনতে পারবেন না৷ এটা আইন৷'' 

Raza Debasis Roy - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

তিনি আরো জানান, ‘‘কাপ্তাই বাঁধের মাধ্যমে ১১ লাখ আদিবাসীকে উচ্ছেদ করা হয়৷ তাদের ৬০ ভাগ ভূমি পানির নীচে চলে যায়৷ এখন ইকোপার্ক, রিজার্ভ ফরেস্টের নামে আদিবাসীদের বন ও ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে৷''

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পাহাড়ে আদিবাসীরা যার যতটুকু ভূমি প্রয়োজন ততটুকু নেয়৷ পরিবারের সদস্য, চাষবাসের ক্ষমতা সব মিলিয়ে হেডম্যানরা তাঁদের জমি দেয়৷ এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো সমস্যা হয়নি কখনোই৷ তাঁর বিনিময়ে বছরে সামান্য খাজনা দেয় রাজাকে৷ তাঁরা মনে করে, তাঁদের পূর্বপুরুষরা বসবাস করে আসছে৷ এই জমি এই বন এই জলার অধিকার তাঁদের৷''

সমতলের আদিবাসীদের জমির মালিকানা প্রচলিত ভূমি রেজিস্ট্রেশন নীতিমালার আওতায় নির্ধারণ করা হয়৷ দলিল, পর্চা, নাম জারি সবই প্রযোজ্য৷ কিন্তু তাঁদেরও কৌশলে উৎখাত করা হচ্ছে৷ জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, ‘‘জমির জাল কাগজ-পত্র, গায়ের জোর, ভয় আর প্রতারণার মাধ্যমে তাঁদের উৎখাত করা হচ্ছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘সমতলের আদিবসীদের ভূমি যাতে কেউ তাঁদের ঠকিয়ে না নিতে পারে, সেজন্য আইন আছে৷ কিন্তু সেই আইনে তাঁদের জমি রক্ষা পাচ্ছে না৷'' তিনি উদাহরণ দিয়ে আরো বলেন, ‘‘আমার নাম রবীন্দ্রনাথ সরেন৷ আমি সাঁওতাল৷ আমার নাম করা হলো রবীন্দ্রনাথ সরকার৷ ধর্ম হিন্দু৷ এভাবে জাল দলির করে জমি নিয়ে নেয়৷ আদিবাসীরা শিক্ষিত নয়, গরিব৷ ফলে তাঁরা কিছু করতে পারে না৷ আমরা আদালতেও যেতে পারি না৷''

বাংলাদেশে নিরঙ্কুশ দারিদ্র্যের হার ৪৪ ভাগ৷ কিন্তু আদিবাসীদের নিরঙ্কুশ দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ৷ ভূমি ও বন থেকে উচ্ছেদের কারণেই তাঁদের এই পরিস্থিতি৷ রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, ‘‘গত বছর পার্বত্য ভূমি কমিশনের একটি পূর্ণাঙ্গ বৈঠক হয়েছে৷ এই কমিশন কাজ করতে পারলে পাহাড়ি আদিবাসীদের ভূমির মালিকানা নিয়ে জটিলতা কমবে৷ দেবাশীষ রায় পার্বত্য ভূমি কমিশনের একজন সদস্য৷ 

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ