বান্দরবানে একই পরিবারের চারজনকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে৷ এলাকাটি আদিবাসী অধ্যুষিত হলেও নিহতরা সবাই রোহিঙ্গা৷ বান্দরবানের পুলিশ সুপার ভেলেকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে, পারিবারিক বিরোধের জেরেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে৷
বিজ্ঞাপন
বান্দরবান শহর থেকে অন্তত ৫ কিলোমিটার দূরে ক্যামলং এলাকায় নির্জন একটি খামারে যারা খুন হয়েছেন, তাদের মধ্যে দু'জন আপন ভাইবোন ও অপর দু'জন তাঁদের সন্তান৷ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশের একজন কর্মকর্তা টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে বলেন, এই রোহিঙ্গা পরিবারটি কয়েক বছর আগে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসে৷ কুহালং ইউনিয়নের বান্দরবান-চন্দ্রঘোনা সড়কের নির্জন ওই খামার বাড়িতে গিয়ে তিনি দেখেছেন, পাহাড়ের ঢালুতে ধাপ কেটে নির্মিত ছোট বাড়ির ভেতরে দুই শিশুসহ তিনজনকে ও বাইরে একজনকে হত্যা করা হয়েছে৷ নিহতরা হলেন – মোহাম্মদ আমিন (৪০) ও তাঁর ছেলে জুনায়েদ (১২), আমিনের বোন সামিরা বেগম (৪৫) ও সামিরার মেয়ে সৈয়দ নূর (৬)৷ আমিনের স্ত্রীর স্বজনরা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত৷
বাংলাদেশে শরণার্থী, বাংলাদেশের শরণার্থী
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা, ইউএনএইচসিআর-এর এক প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশের তালিকায় নবম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ৷ তেমনি বাংলাদেশ থেকেও অনেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশে শরণার্থী হয়ে যাচ্ছেন৷
ছবি: Reuters
বাংলাদেশ নবম
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর ‘গ্লোবাল ট্রেন্ডস-২০১৩’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলছে, বিশ্বের শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান নবম৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অর্থনীতির তুলনায় ধারণক্ষমতার দিকে থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর নবম শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশ৷
ছবি: Shaikh Azizur Rahman
কতজন শরণার্থী?
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশে দুটি সরকারি শরণার্থী শিবিরে ৩০ হাজারের মতো মিয়ানমারের (রোহিঙ্গা) শরণার্থী বসবাস করছে বলে জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিবেদন৷ শিবিরের বাইরে আছে আরও দুই থেকে পাঁচ লাখ অনিবন্ধিত ব্যক্তি৷
ছবি: AP
আশ্রয়প্রার্থী
হ্যাঁ৷ বাংলাদেশেও কেউ কেউ আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন৷ ইউএনএইচসিআর ওয়েবসাইটের বাংলাদেশ পাতায় এমন আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা নয়জন বলে জানানো হয়েছে৷ ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সংখ্যাটা এমন ছিল বলে উল্লেখ করা হয়৷
ছবি: DW/Shaikh Azizur Rahman
বাংলাদেশের শরণার্থী
উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশ থেকে অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন৷ অনেকক্ষেত্রে তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পথে রওনা দেন৷ কেউ গন্তব্যে পৌঁছে গ্রেপ্তার হয়ে ফিরে আসেন৷ কেউ বা শরণার্থী পরিচয় পান৷ বাংলাদেশের এমন শরণার্থীর সংখ্যা ৯,৮৩৯ জন৷
ছবি: Reuters
বাংলাদেশের আশ্রয়প্রার্থী
উন্নত বিশ্বে কোনোভাবে ঢুকে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার চল অনেকদিন ধরেই চলছে৷ জাতিসংঘের হিসেবে বাংলাদেশের এমন আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ২২,১২৮ জন৷ সংখ্যাটা ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রযোজ্য৷
ছবি: Reuters
স্বপ্নের শুরু টেকনাফে
বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো দেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন অনেক বাংলাদেশি৷ এ জন্য তাঁরা দালালদের অনেক অর্থও দিয়ে থাকেন৷ তাঁদের এই যাত্রা শুরু হয় টেকনাফ থেকে৷
ছবি: DW/Shaikh Azizur Rahman
ছোট নৌকা থেকে বড় নৌকায়
টেকনাফ থেকে প্রথমে ছোট নৌকায় যাত্রা শুরু হয়৷ তারপর একসময় মাছ ধরার বড় নৌকা বা কার্গোতে যাত্রীদের তুলে দেয়া হয়৷ সাধারণত অক্টোবর থেকে পরবর্তী পাঁচ মাসকে সমুদ্র যাত্রার জন্য সঠিক সময় বলে বিবেচনা করা হয়৷
ছবি: Asiapics
খাবার, পানির অভাব
ইউএনএইচসিআর-এর একটি প্রতিবেদন বলছে, যাঁরা সাগর পথে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেন তাঁদের অনেকে খাবার ও পানির অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ এছাড়া দালালরা অনেক সময় তাঁদের সঙ্গে খারাপ আচরণও করে৷
ছবি: Reuters
8 ছবি1 | 8
কুহালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সানু প্রু মারমা উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আবু বক্কর নামে চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী ওই খামারের মালিক৷ এই খামার দেখাশোনা করতেন আবদুল করিম ও তার স্ত্রী সামিরা বেগম৷ কয়েক বছর আগে স্ত্রীকে নির্যাতন করে করিম পালিয়ে গেলে সামিরা তার ভাই মোহাম্মদ আমিনের পরিবারকে এখানে নিয়ে আসে৷ সেই থেকে মোহাম্মদ আমিন, তাঁর তৃতীয় স্ত্রী হাসিনা আক্তার ও বোন সামিরা বেগম এখানে থাকতেন৷ দিনে পাশের খামারের লোকজনের আনাগোনা থাকলেও রাতে তাঁরা ছাড়া কেউ ওই নির্জন এলাকায় থাকতেন না৷ তাই কারা কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি৷
স্থানীয় সাংবাদিক মিলন চক্রবর্তী টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে জানান, ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় ওই খামারের পার্শ্ববর্তী খামারের তত্ত্বাবধায়ক গোপাল দাশ ও হ্লাথুই মারমা তাকে জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন ধরে আমিনের সঙ্গে তার স্ত্রী হাসিনা আক্তারের দাম্পত্য কলহ চলছিল৷ গত ১৫ দিন আগে হাসিনা পারিবারিক কলহের জের ধরে চট্টগ্রামের দোহাজারী বার্মা কলোনিতে ভাইদের ওখানে চলে যায়৷ বৃহস্পতিবার বিকেলে মোহাম্মদ আমিনের শ্যালক এসেছিলেন৷ সঙ্গে আরো দু'একজন অপরিচিত লোক ছিলেন৷ শুক্রবার সকালে কারও কোনো সাড়া-শব্দ না পাওয়ায় খামারে গিয়ে চারজনকে মৃত পড়ে থাকতে দেখা যায়৷ এরপর তাঁরা পুলিশকে খবর দেন৷ কিন্তু আমিনের স্ত্রী বা শ্যালককে কোথাও দেখা যায়নি৷ গোপালের ধারণা, তারাই (আমিনের স্ত্রী ও শ্যালক) এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন৷ তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭ থেকে ৮টার মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে৷ কারণ রাতে খাওয়ার জন্য তারা যা রান্না করেছিল তা ঘরের মধ্যে পড়ে ছিল৷
রোহিঙ্গাদের ‘যুদ্ধের’ যেন শেষ নেই
ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাদের প্রবেশের ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ অনেক বাংলাদেশিও আছেন তাঁদের মাঝে৷ থাইল্যান্ডে গিয়ে কবরেও ঠাঁই হয়েছে অনেকের! আজকের ছবিঘরটি তাঁদের নিয়েই৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
আটকে পড়া
গত ১০ মে চারটি নৌযানে করে ইন্দোনেশিয়ার আচে প্রদেশে প্রবেশ করে ৬০০ রোহিঙ্গা৷ একই সময়ে লাংকাওইতে প্রবেশ করে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা৷ সমুদ্র থেকে স্থলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাঁদের ঘিরে ফেলে৷ ভাগ্যান্বেষণে দেশ ছাড়া মানুষগুলো এখনো মুক্ত নয়৷
ছবি: Reuters/R. Bintang
ক্লান্ত
মানবপাচারকারীরা তাঁদের ছেড়ে যাওয়াতে সমুদ্রবক্ষে বিপদেই পড়েছিলেন রোহিঙ্গারা৷ আনুমানিক সপ্তাহ খানেক সমুদ্রপথে ঘুরে অবশেষে ভীষণ ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত অবস্থায় তাঁরা ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছান৷ দীর্ঘ অর্ধাহার, অনাহারে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে৷ তাঁদের চিকিৎসা চলছে৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা
প্রতিবছর এভাবেই মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে শত শত রোহিঙ্গা৷ মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কিছু বাংলাদেশিও থাকেন সব সময়৷ ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী তোলায় অনেক নৌযান ডুবে যায় সাগরে, সলিলসমাধি হয় অনেকের৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম তিন মাসে ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছেড়েছেন অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি৷
ছবি: Asiapics
ওদের কোনো দেশ নেই!
বৌদ্ধপ্রধান দেশ মিয়ানমারে ৮ লক্ষের মতো রোহিঙ্গা মুসলমানের বাস৷ তবে সংখ্যাটা দ্রুতই কমছে৷ বৌদ্ধদের সঙ্গে দাঙ্গার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই৷ মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকারই করে না৷ তাদের মতে, রোহিঙ্গারা ‘বাংলাদেশি অভিবাসী’৷ আবার বাংলাদেশে আশ্রয় নিলে ঐতিহাসিক কারণেই তাঁদের মিয়ানমার থেকে আগত বহিরাগতের মর্যাদা দেয় বাংলাদেশ৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
আধুনিক দাস-বাণিজ্য
মানবপাচারকারীদের কাছে সমুদ্রপথে বাংলাদেশ ছাড়া রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিরা যেন ক্রীতদাস৷ মাত্র ২০০ ডলারের বিনিময়ে নির্বিঘ্নে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেয়ার কথা বলে নৌযানে তুললেও যাত্রীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়৷ খেতে না দেয়া, ছোট্ট জায়গায় গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য করা, শারীরিক নির্যাতন – বলতে গেলে সব ধরণের অত্যাচারই চলে তাঁদের ওপর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Yulinnas
থাইল্যান্ড নিয়ে আতঙ্ক
রোহিঙ্গারা থাইল্যান্ডেও যান৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, ২০১২ সালে আড়াই লাখ মানুষ অবৈধভাবে থাইল্যান্ডে প্রবেশ করেছেন৷ অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য থাইল্যান্ড অবশ্য একেবারেই নিরাপদ ঠিকানা নয়৷ মানবপাচারকারীরা সে দেশে নিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করে৷ মুক্তিপণ না দিলে মেরেও ফেলা হয়৷ সম্প্রতি মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে বেশ কিছু গণকবরের সন্ধান পেয়েছে থাই সরকার৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
পরিত্যক্ত
থাইল্যান্ড সরকারের অভিযান শুরুর পর অনেক রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিকে গভীর জঙ্গলে ফেলে পাচারকারীরা পালিয়ে যায়৷ মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে এ পর্যন্ত অন্তত শ’ খানেক অভিবাসন প্রত্যাশীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে থাই কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: AFP/Getty Images/Str
7 ছবি1 | 7
জায়গার মালিক ব্যবসায়ী আবু বক্কর সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, ‘‘বান্দরবানে আমার ১২০ একর জায়গা রয়েছে৷ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেয়ারটেকার হিসাবে গোপাল দাশ নামে একজনকে দায়িত্ব দেই৷ পরে জানতে পারি গোপাল দাশ আমার জায়গাতে একটি রোহিঙ্গা পরিবারকে থাকতে দিয়েছে৷ তারাই খামারটি দেখাশোনা করছে৷ তবে এতে কোনো সমস্যা হচ্ছিল না৷ আর এই জায়গা নিয়ে কারো সাথে আমার কোন বিরোধ নেই৷''
বান্দরবান সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, পারিবারিক কলহের জের ধরে আমিনের স্ত্রী ও শ্যালকরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ তাঁদের গ্রেফতারে সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে অভিযান চালানো হচ্ছে৷ পুলিশের একটি টিম চট্টগ্রাম গেছে বলেও জানান তিনি৷ পাশাপাশি এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্য কোনো রহস্য আছে কিনা সে বিষয়েও পুলিশ তদন্ত করছে৷ স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রবণতা বেশি৷ সেই প্রবণতার কারণেই এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড৷