সুরক্ষা সামগ্রীর সংকট অনেকটা কাটলেও কোভিড চিকিৎসকরা এখন নানা ধরনের প্রশাসনিক চাপে আছেন৷ বিশেষ করে তাদের আইসোলেশনের নিয়ম মানতে চাইছে না কোনো কোনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ৷
বিজ্ঞাপন
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নীতিমালার বাইরে গিয়ে তারা নতুন নতুন নিয়ম চাপিয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আদেশ অনুযায়ী একজন চিকিৎসক সাত দিন কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা দেয়ার পর ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকবেন৷ এরপর সাত দিন তিনি পরিবারের সাথে সময় কাটিয়ে আবার দায়িত্বে ফিরে যাবেন৷ এরমধ্যে তিনি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে নিয়ম অনুযায়ী চিকিৎসা হবে৷
কিন্তু সর্বশেষ ৩০ জুন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এক আদেশে আইসোলেশন বাতিল করে৷ তারা জানিয়ে দেয় কোভিড-১৯ পজেটিভ রোগীর সংস্পর্শে আসলে চিকিৎসক কিংবা কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আইসোলেশনে যেতে হবে না৷ কেউ গিয়ে থাকলে তাকে অনুপস্থিত বলে ধরা হবে৷
অধ্যক্ষের কার্যালয় থেকে পাঠানো এই আদেশে তারা বলছে, কেবল কোভিড আক্রান্ত হলে হাসপাতালে আইসোলশনের সুবিধা পাবেন চিকিৎসকরা৷ তাও ১০ দিন, ১৪ দিন নয়৷ আর পিপিইসহ সুরক্ষা সামগ্রীও দেয়া হবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়৷ এনিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হচেছ৷
ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী
এনিয়ে বক্তব্য জানার জন্য মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষকে পাওয় যায়নি৷ তবে চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক মোস্তফা খালেদ আহমেদ জানান, ‘‘অধ্যক্ষ আসলে ভুল বার্তা দিয়েছেন৷ তিনি অধিদপ্তরের নির্দেশনা বুঝতে পারেননি৷ আশা করি তিনি তার আদেশ সংশোধন করবেন৷’’
এর বাইরেও নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন চিকিৎসকরা৷ মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসাপতালের করোনার সেবা দেয়া চিকিৎসকরা তাদের হোটেলের খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে অন্য হোটেল বুক করায় পরিচালকসহ চারজন চিকিৎসককে বদলি করা হয়েছে৷ এর আগে মাস্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলায় দুইজন চিকিৎসককে ওএসডি করা হয়েছে৷ অভিযোগ আছে দুগ্ধপোষ্য শিশুর মা চিকিৎসককেও ডিউটি পালনে বাধ্য করা হচ্ছে৷ কোভিড চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালনের সময় নিয়ম অনুযায়ী বাসায় যান না৷ নির্ধারিত হোটেল বা আবাসস্থলে থাকেন৷
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন বিএমএ এর মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী জানান, ‘‘কুয়েত মৈত্রী হাসাপতালের চিকিৎসকদের অন্যায়ভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়৷ তাদের মধ্যে একজন কোভিড রোগীর চিকিৎসা শেষে নিয়ম অনুযায়ী আইসোলেশনে ছিলেন৷ আইসোলেশনে থাকার কারণেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ আরেকজন নারী চিকিৎসক দুগ্ধপোষ্য শিশু থাকায় তিনি ছুটি চান৷ আর আরেকজন দুই মাস আগেই পদত্যাগ করেন৷ কিন্তু নিয়ম নীতি না মেনেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
যারা বাঁচিয়ে রাখছেন তাদের ধন্যবাদ
তারা না থাকলে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতো অনেক বেশি মানুষ৷ করোনার কারণে ঘরবন্দি জীবনও হয়ে যেতো অচল৷ সারা বিশ্ব ধন্যবাদ জানাচ্ছে তাদের৷ দেখুন ছবি ঘরে...
ছবি: Reuters/H. McKay
ভবনজুড়ে ধন্য ধন্য
ব্রাজিলের সাও পাওলোর একটি ভবন৷ ভবনজুড়ে লেখা, সংহতি, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, ঐক্য এবং স্নেহ৷ এসবই দেশের সব নার্স, ডাক্তার এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য লেখা৷
খুব বড় অক্ষরে ধন্যবাদও জানানো হয়েছে তাদের
ছবি: Reuters/A. Perobelli
চিকিৎসাকর্মীদের ধন্যবাদ
করোন ভাইরাসের কবলে যুক্তরাষ্ট্রও বিপর্যস্ত৷ নিউ ইয়র্কের এক হাসপাতালে সংক্রমিতদের বাঁচানোর জন্য দিনরাত কাজ করছেন ডাক্তার-নার্সরা৷ বিশাল অক্ষরে তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছেন এক নিউইয়র্কবাসী৷
ছবি: Reuters/A. Kelly
কৃতজ্ঞ পাব
কদিন আগেও নিউইয়র্কের উইন্টার বিয়ার নামের পাবটির বাইরে লেখা থাকতো মেনু, খোলার সময় আর বন্ধের সময়৷ এখন সেই বোর্ড জুড়ে শুধু ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের কর্মীদের ধন্যবাদ জানানোর বার্তা৷
ছবি: Reuters/A. Couldridge
'গুরুত্বপূর্ণ' কর্মীদের ধন্যবাদ
সমাজে ডাক্তার-নার্সদের গুরুত্ব কে না বোঝে৷ তবে পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মুদি বা ঔষধের দোকানদার, কিংবা নিরাপত্তাকর্মীদের গুরুত্বের কথা স্বাভাবিক সময়ে ক''জনইবা মনে রাখে৷ করোনা সংকটের সময় তাদের গুরুত্ব খুব উপলব্ধি করছে সবাই৷ বৃটেনের ম্যানচেস্টার শহরের এক রাস্তায় তাদের ধন্যবাদ জানানো ব্যানার৷
ছবি: Reuters/P. Noble
নীল 'লন্ডন আই'
বৃটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের কর্মীদের প্রতি সমর্থন ও কৃতজ্ঞতা জানাতে নীল রঙে সেজেছে লন্ডন আই৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কিশোরীর কৃতজ্ঞতা
বৃটেনের হাই উইকম্ব শহরের এক দেয়ালে লিখেকরোনার বিরুদ্ধে যারা সামনে থেকে লড়ছেন, তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছে এক কিশোরী৷
ছবি: Reuters/E. Keogh
মুম্বাইয়ের ধন্যবাদ
হাততালি দিয়ে, থালাবাসন বাজিয়ে আর পতাকা নেড়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইরত অগ্রসৈনিকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে ভারতের মুম্বাইয়ের এক ভবনের মানুষ৷
ছবি: Reuters/F. Mascarenhas
যারা যত্ন নাও...
প্যারিসের এক বাড়ির ব্যালকনিতে সাদা কাপড়ে লেখা, ‘‘যারা আমাদের যত্ন নাও, তাদের অনেক ধন্যবাদ’’
ছবি: Reuters/B. Tessier
'তোমাদের জন্য হাততালি'
তখন সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জুরিখ হাততালি দিয়ে করোনা-সংকটের সময়ও যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে৷ এক নারীও যোগ দিলেন তাতে৷
ছবি: Reuters/A. Wiegmann
খেলার মাঠেও...
ইংল্যান্ডের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামেও এখন ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসকে ধন্যবাদ জানানোর বার্তা৷
ছবি: Reuters/M. Childs
10 ছবি1 | 10
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘অধিদপ্তর নিয়ম করেই খালাস৷ কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আইসোলেশন নীতি মানছে না অনেক হাসপাতাল৷ তারা তাদের ইচ্ছেমত নীতিমালা জারি করছে৷ এতে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীরা বাড়তি চাপে আছেন৷ তারা এমনিতেই মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে কোভিড রোগীর চিকিৎসা করছেন৷ আর এই বাড়তি চাপ তাদের আরো বিপর্যস্ত করে তুলছে৷’’
কয়েকজন কোভিড চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জানা যায়, আইসোলেশনের নীতি নিয়ে ঢাকার সরকারি হাসপাতালে সমস্যা তেমন হচ্ছে না৷ বেসরকারি কোভিড হাসপাতালে সমস্যা হচ্ছে৷ তাদের অনেককেই আইসোলেশন সুবিধা কমিয়ে দেয়া হচ্ছে বা দেয়া হচ্ছে না৷ তাদের বলা হচ্ছে, ‘‘আক্রান্ত না হলে আবার কিসের আইসোলেশন৷’’ অন্যদিকে ঢাকার বাইরে সরকারি হাসপাতালগুলো তাদের নিজেদের মর্জি মাফিক চলছে৷ পিপিই নিয়েও আছে সংকট৷
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৯৪০ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন৷ মারা গেছেন ১২ জন৷ বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি ডাক্তার আছেন ৩০ হাজার৷ আর সবমিলিয়ে রেজিষ্টার্ড চিকিৎসক আছেন এক লাখের মতো৷ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং কোভিড -১৯ বিষয়ক মিডিয়া সেলের প্রধান মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘‘চিকিৎসক কম থাকায় সরকারি হাসপাতালে কোথাও কোথাও আইসোলেশ নীতি পুরো মানা সম্ভব হচ্ছে না৷ তবে সেটা পরিস্থিতি বিবেচনায় হতে পারে৷ কিন্তু সাধারণভাবে নীতি মানতে হবে৷’’
ডা. নিরুপম দাস
বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) প্রধান ডা. নিরুপম দাস জানান, ‘‘অনেক জায়গা থেকেই আমরা কোভিড চিকিৎসকদের আইসোলেশন নীতি না মানার অভিযোগ পাচ্ছি৷ উপসর্গ না থাকলে আইসোলেশন নিয়ে নানা বাহানা করা হচ্ছে৷ আর কোভিড চিকিৎসকদের সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় সবাই মুখ বন্ধ করে আছেন৷’’
তিনি বলেন, ‘‘চিকিৎসকরা হলেন কোভিডের সুপার স্প্রেডার৷ এখন চিকিৎসক সংকট বলে যদি নীতি অনুসরণ না করা হয় তাহলে পরিস্থিতি খারাপ হবে৷ তারাতো নানা প্রশাসনিক আদেশে এমনিতেই এখন বিপর্যস্ত৷ উপরন্তু তারাই হতে পারেন করোনা ছাড়ানোর বড় কেন্দ্র৷’’
ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ যে আদেশ দিয়েছেন তা আইনের বাইরে৷ তিনিতো আইনের বাইরে কাজ করতে পারেন না৷ তার জানা উচিত আমাদের দেশে এখন ২৩ ভাগ কোভিড আক্রান্তের কোনো উপসর্গ নেই৷
‘‘আমাদের মনে রাখতে হবে এরইমধ্যে বিশ্বে চারজন কোভিড চিকিৎসক মানসিক চাপের মুখে আত্মহত্যা করেছেন৷ তাই আমাদের চিকিৎসকদের যতদূর সম্ভব চাপ মুক্ত রাখতে হবে,’’ বলেন এই চিকিৎসক নেতা৷
করোনার শিকার ডাক্তার, নার্স, পুলিশদের কথা
করোনার রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কমপক্ষে ৯০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হয়েছেন। অনেকে মারাও গেছেন। অনেক পুলিশ ও দমকল কর্মীরও প্রাণ কেড়েছে করোনা ভাইরাস।
ছবি: Reuters/Str.
মেক্সিকো
করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন নার্স অক্টাভো লোপেজ। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে তার দেহভষ্ম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বোন ক্রিস্টিনা লোপেজ। ইন্টার ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর নার্সেস-এর তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ মে পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে কমপক্ষে ২৬০ জন নার্স মারা গেছেন।
ছবি: Reuters/J. Luis Gonzalez
যুক্তরাষ্ট্র
অনেক দেশেই স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিৎসা সরঞ্জাম পাননি। এ কারণে প্রতিবাদ, বিক্ষোভও হয়েছে। গত ৭ মে ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের সামনে এভাবে নিজেদের পায়ের সাদা জুতো সাজিয়ে বিক্ষোভ করেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
ছবি: Reuters/T. Brenner
ব্রিটেন
স্বাস্থ্যকর্মী স্বামীর মৃত্যুশোকে কাঁদছেন এক নারী। চোখের জল মুছে দিচ্ছে তিন বছরের সন্তান।
ছবি: Reuters/P. Nicholls
ভারত
দূরে দাঁড়ানো অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে আছেন সদ্য করোনায় সংক্রমিত হয়ে মারা যাওয়া পুলিশকর্মী।
আকাশে গুলি ছুঁড়ে তাকে শেষ বিদায় জানাচ্ছে দিল্লি পুলিশ।
ছবি: Reuters/D. Siddiqui
ফ্রান্স
ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলের একটি শহরে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা যাওয়া চিকিৎসকের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন তাঁর সহকর্মীরা।
ছবি: Reuters/P. Rossignol
ইকুয়েডর
গুয়াকুলি শহরে করোনায় সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন এক চিকিৎসক ও তার স্ত্রী। তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত স্বাস্থ্য ও দমকল কর্মীরা।
ছবি: Reuters/S. Arcos
রাশিয়া
সেন্ট পিটার্সবার্গে করোনার শিকার চিকিৎসকের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা।
ছবি: Reuters/A. Vaganov
ব্রাজিল
সাও পাওলোর এক হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীকে শেষ বিদায় জানাচ্ছেন তার সহকর্মীরা।
উহানে করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে সবাইকে সতর্ক করেছিলেন ডা. লি ওয়েনলিয়াং৷ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে করোনায় সংক্রমিত হয়ে তিনিও মারা যান৷