আন্তর্জাতিক জোট: বাংলাদেশের চাওয়া-পাওয়া ও চ্যালেঞ্জ
১ সেপ্টেম্বর ২০২৩স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন জোটে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ৷ ৷ তার মধ্যে সার্ক, বিমসটেকের মতো ভৌগোলিক বা আঞ্চলিক জোট যেমন আছে, তেমনি আছে ন্যাম, কমনওয়েলথ, ওআইসির মতো আন্তর্জাতিক জোটও৷ অর্থনীতি বা ভূ-রাজনৈতিক কারণে নতুন নতুন জোটে যাওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে৷ সেগুলো আবার পররাষ্ট্রনীতির নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে৷ বিশ্লেষকেদের মতে, এখন পর্যন্ত যেসব জোটের সদস্য হয়েছে বাংলাদেশ, সেগুলো থেকে স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রাপ্তি খুব বেশি না হলেও নানা কারণে সেগুলোতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ৷
জোট নিরপেক্ষতার জোট
‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়', পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এমন লক্ষ্যের কথাই বাংলাদেশ বরাবর উল্লেখ করে৷ বাংলাদেশের সংবিধানের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক বিভিন্ন অনুচ্ছেদেও তার প্রতিফলন আছে৷ ২৫ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অপর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা, এ সকল নীতিই হবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি...৷''
স্বাধীনতার পরে জোট বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও এই নীতি লক্ষ্য করা গেছে৷ বিভিন্ন সামরিক জোট থেকে বাংলাদেশ দূরে থেকেছে৷ তবে যুক্ত হয়েছে আর্থ-রাজনৈতিক নানা জোটে৷
চীনের আপত্তির কারণে দেরি হলেও ১৯৭৪ সালে এসে জাতিসংঘের সদস্যপদ পায় বাংলাদেশ৷ একই বছর মুসলিম প্রধান দেশগুলোর সংগঠন ওআইসির সদস্যপদ মেলে৷ তার আগে ১৯৭২ সালেই কমনওয়েলথের ৩৪তম সদস্য হয়৷ এক সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন থাকা দেশগুলোর এই জোটে ঢুকতে স্বভাবতই বেগ পেতে হয়নি বাংলাদেশকে৷
সোভিয়েত দেশগুলোকে নিয়ে ওয়ারশ প্যাক্ট, বিপরীতে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট-ন্যাটোর বাইরে ‘নিরপেক্ষ' দেশগুলোকে নিয়ে গড়ে ওঠা জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন বা নন অ্যালায়েন্ড মুভমেন্ট বা ন্যাম -এ বাংলাদেশ যোগ দেয় ১৯৭৩ সালে৷ ‘জোট নিরপেক্ষতার' এই জোট রাজনৈতিকভাবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পেরেছে তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন আছে বিশ্লেষকদের মনে৷
বৈশ্বিক এসব জোটের বাইরে সময়ে সময়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ৷ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সার্ক গঠনে নেতৃত্ব কূটনৈতিক জোটে বাংলাদেশের অন্যতম সাফল্য৷ ঢাকার উদ্যোগে ১৯৮৭ সালে সার্কের আনুষ্ঠানিক যাত্রা হয়৷ ২০০৮-০৯ সাল পর্যন্ত সার্ক ধীরে হলেও এগিয়েছে৷ কিন্তু জোটের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্কের কারণে সংস্থাটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি৷
আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে অর্থনৈতিক জোট বিমসটেক বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় ছিল৷ ১৯৮৭ সালে গঠিত এই জোটের সদস্য বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড৷ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যে এই জোটটি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও তার সুফল পাওয়া যায়নি মিয়ানমারের কারণে৷ সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘‘২০০৬ সালে এমনকি মিয়ানমারের ভিতরে ২২ কিলোমিটার রাস্তা আমরা নিজেদের খরচে করে দিতে চেয়েছিলাম, যাতে থাইল্যান্ড, চীনের সাথে আমাদের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়৷ কিন্তু মিয়ানমারের অবস্থান ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সেটা সম্ভব হয়নি৷ এখনও প্রতিষ্ঠানটি টিকে থাকলেও বা ঢাকায় এর সদর দপ্তর থাকলেও প্রকৃত অর্থে কিছু হচ্ছে না৷ ''
অবকাঠামো উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক কারণে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-বিআরআই'তে যোগ দেয় বাংলাদেশ৷ কিন্তু চীনের এই উদ্যোগকেও ভালো চোখে দেখে না ভারত৷ এ কারণে এই উদ্যোগের অধীনে দক্ষিণ এশিয়ার প্রকল্পগুলো নিয়ে অচলাবস্থা রয়েছে৷
জোটে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
জাতিসংঘের বাইরেও বিভিন্ন জোটের কাছ থেকে বাংলাদেশ নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক সহযোগিতা পায়৷ জাতিসংঘের তালিকার স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও নানা জোটের কাছ থেকে শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা মেলে৷ কমনওয়েলথের কাছ থেকে বিভিন্ন কারিগরি ও শিক্ষা বিষয়ক সহায়তা পায় বাংলাদেশ৷ সক্রিয় সদস্য হিসেবে ওআইসির ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ঋণ সুবিধা পেয়ে থেকে৷
তবে আর্থিক ও বাণিজ্যিক সুফল বাদ দিলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে বিভিন্ন জোটের কাছ থেকে বাংলাদেশ তেমন জোরালো সমর্থন পায়নি৷ এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ রোহিঙ্গা ইস্যু৷ মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘অধিকাংশ জোটই এমন যে এগুলো থেকে প্রাপ্তির আশা করা ঠিক না৷ ...রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদেরকে কে কী সাহায্য করেছে? প্রায় কারো কাছ থেকেই আমরা কোনো সহায়তা পাইনি সমাধানের ব্যাপারে৷ বড়জোর কিছু অর্থ সহায়তা পাওয়া গেছে৷''
তারপরও কূটনৈতিক জোট বা সংগঠনগুলোতে সদস্য থাকাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এই বিশ্লেষকেরা, কেননা, সেগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফোরামে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোকে অন্তত তুলে ধরার সুযোগ পায় বাংলাদেশ৷
মো. তৌহিদ হোসেন ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘‘আমি মনে করি না এই সংস্থাগুলো আমাদের বিরাট কোনো সহযোগিতা করতে পেরেছে৷ তারপরও এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে সদস্য থাকা আমি সমর্থন করি৷ কারণ, কমপক্ষে আমাদের যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলোকে দৃশ্যমান করতে বা রাখতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের উপস্থিতি কাজে লাগে৷'' অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খানের মতে, ‘‘জোটবদ্ধ হওয়া কোনো সমস্যা না, বরং তাতে নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হয়৷''
ভবিষ্যতের জোট, বৃহৎশক্তির ভূরাজনীতি
এই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক মনে করেন, বিশ্ব রাজনীতি ও নতুন অর্থনীতির বাস্তবতায় বাংলাদেশ আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ ‘‘ বিশেষ করে বাংলাদেশ যে মডেলকে সামনে নিয়ে এসেছে, তাতে বাংলাদেশকে নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অনেকের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে৷ অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিদেশিদের এখানে বিনিয়োগের জায়গা তৈরি হচ্ছে৷ সেই অর্থে বাংলাদেশ তাদের আগ্রহের কেন্দ্রে আছে৷''
এমন আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা অনেক সময় বড় ধরনের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখেও ঠেলে দিচ্ছে বাংলাদেশকে৷ ২০২০ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট স্টিফেন বেইগান দিল্লি হয়ে ঢাকা এসে জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিকে অন্যতম মূল অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে৷ মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সঙ্গে ‘চতুর্পাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ'-কোয়াডকে সম্পৃক্ত হিসেবে দেখা হয়৷ যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত এই উদ্যোগকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে চীন৷ এমন প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে এ নিয়ে প্রকাশ্যে সতর্কও করেছিলেন দেশটির রাষ্ট্রদূত৷
মো. তৌহিদ হোসেনের মতে, সামনে নতুন নতুন এমন অনেক উদ্যোগ চলতে থাকবে৷ সেই সঙ্গে নতুন চ্যালেঞ্জও আসবে বাংলাদেশের সামনে৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রত্যেকটি জোটের পেছনে উদ্যোক্তাদের স্বার্থ থাকে৷ আমাদেরকে দেখতে হবে কোনো প্রতিষ্ঠান বা জোটের সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা কোনো পক্ষ নিয়ে নিচ্ছি কিনা বা কারো প্রতি শত্রুতামূলক আচরণ করে এমন কোনো গ্রুপের সদস্য হয়ে যাচ্ছি কিনা৷'' তিনি মনে করেন, পারিপার্শ্বিক কারণে বাংলাদেশের পক্ষে খুব বড় শক্তিতে পরিণত হওয়া কঠিন৷ তাই দেশের স্বার্থে কাজে লাগবে এমন যে কোনো জোটেই বাংলাদেশের যোগ দেয়া উচিত৷
সম্প্রতি ব্রিকসে বাংলাদেশের যোগ দেয়া নিয়েও ব্যাপক প্রত্যাশা তৈরিহয়েছিল৷ সরকারের পক্ষ থেকে সেই সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল৷ আগস্টের শেষে সাউথ আফ্রিকায় পাঁচ দেশের এই জোটটির শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমন্ত্রিত হন৷ সেখানে ছয়টি দেশকে নতুন সদস্য করার ঘোষণা দেয়া হলেও বাংলাদেশের জায়গা হয়নি৷ ড. তানজিম উদ্দিন খান মনে করেন সদস্যপদ নিয়ে বাংলাদেশে ‘রাজনৈতিক হাইপ' তৈরি করা হয়েছে৷ তবে সেটি না পাওয়ায় বাংলাদেশের জন্য বরং ভালো হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এখানে সদস্য হলে খুবই স্পষ্ট হতো আপনি একটা বলয়ে অবস্থান করছেন৷ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আমরা দেখছি, রাশিয়া, চীন, ভারত একটা বলয়ে আছে৷ আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমারা আরেকটা বলয়ে আছে৷''