রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভবিষ্যতেও যেন আন্তর্জাতিক সমর্থন বজায় থাকে, সে লক্ষ্যে কাজ করতে একটি কমিটি গঠন করেছে আন্তর্জাতিক ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা ওআইসি৷ ঢাকায় ওআইসির সম্মেলনে কমিটি গঠনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়৷
বিজ্ঞাপন
সংস্থার মহাসচিব ইউসেফ বিন আহমেদ আল-ওথাইমিন একে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ তিনি বলেন, নতুন এই কমিটি ‘‘রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের ধরতে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমর্থন জোগাড় ও সমন্বয়ের কাজ করবে৷’’
ওআইসি মহাসচিব বলেন, ‘‘আমাদের (রোহিঙ্গা) ভাই ও বোনদের সমস্যার সমাধানে এটি অন্যতম একটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ৷’’
সমস্যার সমাধানে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সহায়তা চেয়েছেন৷ ‘‘এটি ধর্মীয় বিষয় নয়৷ এটি আমাদের ভাই ও বোনদের মৌলিক মানবাধিকারের বিষয়,’’ বলেন তিনি৷
রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার চিত্র
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
8 ছবি1 | 8
এদিকে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের নির্যাতন ‘আন্তর্জাতিক আইনের ভয়াবহ লঙ্ঘন’ বলে মনে করছে ওআইসি৷ এছাড়া এই নিপীড়নের ঘটনা ‘জাতিগত নিধন’ বলেও জানিয়েছে ৫৩টি ইসলামি রাষ্ট্রের ঐ সংগঠন৷ এর আগে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রও ‘জাতিগত নিধন’ শব্দযুগল ব্যবহার করেছে৷
এর আগে শুক্রবার ওআইসি-র একটি প্রতিনিধি দল কক্সবাজারে কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে দেখেছে৷ তাঁরা ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথাও বলেছেন৷
পাকিস্তানের প্রতিবাদ
এদিকে, সম্মেলনে যে ‘ঢাকা ডিক্লারেশন’ ঘোষিত হয়েছে তা প্রকাশের আগে বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেনি বলে সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করেছে ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাই কমিশন৷ সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই ঢাকা বিবৃতিটি প্রকাশ করে বলে অভিযোগ তাদের৷ ‘‘এতে (ঢাকা ডিক্লারেশন) শুধু আয়োজক দেশের বক্তব্য প্রতিফলিত হয়েছে৷ এবং সেজন্য এটা তাদের দায়িত্বে প্রকাশিত হয়েছে, ফলে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি,’’ দাবি পাকিস্তান হাই কমিশনের৷
তবে তাদের এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম৷ ওআইসি সচিবালয়ের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া কোনো কিছু করা হয়নি৷ ‘‘ওআইসি সচিবালয়ের নির্দেশনা ও পরামর্শ মেনে সবকিছু করা হয়েছে,’’ বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে বলেন তিনি৷
ওআইসির সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘যদি কারও ক্ষোভ থাকে তাহলে তাদের প্রথম ওআইসি সচিবালয়কে জানানো উচিত৷’’
মিয়ানমার সেনাপ্রধানের বক্তব্য
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করেছে৷ সেই সময় দেশটির সেনাপ্রধান মিন অং লায়িং-এর সঙ্গেও বৈঠক করে দলটি৷ সেই সময় সেনাপ্রধানের দেয়া একটি বক্তব্যের অংশ শনিবার তাঁর ফেসবুক পাতায় প্রকাশ করা হয়৷ এতে বলা হয়, ফেরত আসা রোহিঙ্গারা যদি তাদের জন্য নির্মিত মডেল গ্রামে থাকে, তাহলে তারা নিরাপদ থাকবে৷
সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের একটি নির্দিষ্ট স্থানে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য থাকতে বাধ্য করার যে আশংকা করা হয়েছিল, সেটিই আবার নতুনভাবে উঠে এলো বলে মনে করছে বার্তা সংস্থা এএফপি৷
সেনাপ্রধান তাঁর বক্তব্য রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলে সম্বোধন করেছেন৷ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ এনেছে, তা ‘অতিরঞ্জিত’ বলে মন্তব্য করেন তিনি৷ ‘‘বাঙালিরা কখনও বলবে না যে, তারা খুশি হয়ে সেখানে (বাংলাদেশে) গিয়েছে৷ তারা যদি নিপীড়ন আর কষ্টের কথা বলে তাহলেই শুধু তারা সেখানে সমবেদনা পাবে,’’ বলেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান৷
জেডএইচ/এসিবি (এএফপি, এপি)
রোহিঙ্গাদের ইতিহাস
একটা সময় ছিল যখন কয়েকজন রোহিঙ্গা মিয়ানমার সংসদে সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ আর এখন রোহিঙ্গাদের ভোট দেয়ারই অধিকার নেই৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
স্বাধীনতার আগে
বর্তমানে মিয়ানমার নামে পরিচিত দেশে ১২ শতক থেকে মুসলমানরা বাস করছে বলে দাবি অনেক ইতিহাসবিদ ও রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বলছে, মিয়ানমার যখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন (১৮২৪-১৯৪৮) ছিল তখন বর্তমানের ভারত ও বাংলাদেশ থেকে অনেকে শ্রমিক হিসেবে সেখানে গিয়েছিল৷ তবে তারা যেহেতু ব্রিটিশ আমলে এসেছে তাই স্বাধীনতার পর মিয়ানমার তাদের অবৈধ হিসেবে গণ্য করে৷ প্রতিবেদন পড়তে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Reuters/Z. Bensemra
রোহিঙ্গা সাংসদ
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সংসদকে জানান, বার্মায় ১৯৫১ সালের নির্বাচনে পাঁচজন ও ১৯৫৬ সালে ছ’জন রোহিঙ্গা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ সব মিলিয়ে মিয়ানমার সংসদে মোট ১৭ জন রোহিঙ্গা সাংসদ ছিলেন বলে জানান তিনি৷ এর মধ্যে দুজন ছিলেন নারী৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Gacad
অভ্যুত্থান
১৯৬২ সালে বার্মায় সামরিক অভ্যুত্থান হয়৷ এরপর সব নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধন কার্ড করতে বলা হলেও রোহিঙ্গাদের দেয়া হয়েছিল বিদেশি পরিচয়পত্র৷ ফলে রোহিঙ্গাদের জন্য চাকরি ও পড়াশোনার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়৷ ছবিটি ১৯৬২ সালের ৪ মার্চ তৎকালীন বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন থেকে তোলা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AFP
প্রথমবার বিতাড়ন
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে তাড়াতে ১৯৭৭ সালে নির্যাতন শুরু করা হয়৷ ফলে ১৯৭৮ সালের মে মাসের মধ্যে প্রায় দু’লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিল৷ এরপর জুলাইতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ জাতিসংঘও মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল৷ ফলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল মিয়ানমার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/K. Huda
‘গোপন’ চুক্তি
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হওয়া ঐ চুক্তির উপর ‘সিক্রেট’ অর্থাৎ ‘গোপন’ শব্দটি লেখা ছিল৷ ২০১৪ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়টি চুক্তিটি প্রকাশ করে৷ এতে দেখা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে যাঁদের পরিবারের একসময় জাতীয় নিবন্ধন কার্ড ছিল তাঁদের মিয়ানমার সরকার ‘বার্মার বৈধ বাসিন্দা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ চুক্তিটি পড়তে উপরে (+) চিহ্ন ক্লিক করুন৷
ছবি: http://dataspace.princeton.edu
রাষ্ট্রহীন
১৯৮২ সালে পাস হওয়া নতুন নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের বস্তুত রাষ্ট্রহীন করে দেয়া হয়৷ ঐ আইনে মিয়ানমারের ১৩৫টি জাতিগত গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, যার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম নেই৷ এই আইনের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য পড়াশোনা, চাকরি, ভ্রমণ, ধর্মীয় রীতিনীতি পালন, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া ইত্যাদি সীমিত হয়ে যায়৷ এছাড়া রোহিঙ্গাদের ভোটের অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়৷
ছবি: Reuters/C. McNaughton
দ্বিতীয় পর্যায়ের বিতাড়ন
১৯৯১ ও ১৯৯২ সালে আবার রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন শুরু করে মিয়ানমার৷ ফলে প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিল৷ এরপর তাদের ফিরিয়ে নিতে দুই দেশ একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছিল৷ বিবৃতিতে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমারের বাসিন্দা’ এবং ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল৷
সবশেষ ঘটনা
গত আগস্টের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে অভিযান শুরু করে৷ ইতিমধ্যে এই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ৷ নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ছয় লক্ষ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে৷ তবে তাদের ফিরিয়ে নিতে দু’দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে৷