বায়ু দূষণ আজ গোটা বিশ্বে বড় সমস্যা৷ এ সংক্রান্ত তথ্যের উপর শুধু রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বা বিজ্ঞানীদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব নেই৷ কিছু স্যাটেলাইট বিশ্বব্যাপী দূষণের চিত্র সর্বসাধারণের নাগালে নিয়ে আসছে৷
বিজ্ঞাপন
২০১৮ সালের জুলাই মাসে গ্রিসের রাজধানীর প্রতি গোটা ইউরোপের নজর ছিল৷ প্রথমে পাইনউড বনে আগুন লাগে, তারপর শহরের কিছু এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে৷ প্রায় ৮০০ কিলোমিটার উচ্চতায় এক স্যাটেলাইট ধোঁয়া ও আগুনের উপর নজর রাখছে৷
স্যাটেলাইটে তোলা ছবির মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল যে এ ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবেই আগুন লাগানো হয়েছিল৷ উদ্ধারকর্মীরা ৮৩ জনের লাশ উদ্ধার করেন৷ ১৮৭ জন মানুষ গুরুতর আহত হয়েছিলেন৷
ভারতের বড় শহরে প্রতিদিন শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে দুষিত বায়ু লক্ষ লক্ষ মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করে৷ সেইসঙ্গে বিশাল মাত্রায় পার্টিকুলেট ম্যাটার বা বস্তুকণাও তাদের শরীরে ঢোকে৷ এর ফলে যে রোগব্যাধী হয়, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এ বিষয়ে নিখুঁত তথ্য পাওয়া যায়৷ চীনের রাজধানীতেও বস্তুকণার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত মাত্রার তুলনায় দশ গুণ বেশি৷
এখনো পর্যন্ত মাটির মধ্যে যথেষ্ট পরিমাপ করা হয়নি৷ মহাকাশ থেকে তোলা ছবির মাধ্যমে জমির মধ্যে ক্ষতিকারক পদার্থের ঘনত্ব আরও নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা সম্ভব৷ মানুষের সুরক্ষার জন্য গৃহিত পদক্ষেপ কাজ করছে কিনা, তাও বোঝা যায়৷ সে কারণে ২০১৩ সালে ইইউ কমিশন এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ এর আওতায় ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা একঝাঁক স্যাটেলাইট মহাকাশ পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল৷
সেগুলির মধ্যে ‘সেন্টিনেল ফাইভপি' নামের এক স্যাটেলাইটও ছিল৷ পৃথিবীর বুকে বাতাসের মান পরিমাপ করতে সব রকম প্রাসঙ্গিক তথ্য সরবরাহ করাই সেটির দায়িত্ব৷ ২০১৭ সালের ১৩ই অক্টোবর সেই স্যাটেলাইট মহাকাশের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়৷
বায়ুদূষণ রোধে যে দেশগুলোর রয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা
ইউরোপের বেশির ভাগ দেশই বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে বায়ুদূষণ রোধের চেষ্টা করছে৷ কিন্তু ইউরোপের বাইরের অনেক দেশেরই এ বিষয়ের উদ্যোগ সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না৷ চলুন জেনে নিই ছবিঘরে৷
ছবি: Imago/imagebroker
চীনে হাঁটার জন্য সহজ পথ
চীনের বড় বড় শহরগুলো বায়ুদূষণের প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে৷ চেংডু, চীনের পঞ্চম বৃহত্তম শহর৷ সেখানকার কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছেন, যাতে আবাসিক এলাকায় মানুষ যানবাহনের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে সহজে হাঁটাচলা করতে পারে৷ এই পরিকল্পনার আওতায় শতকরা ৫০ ভাগ রাস্তা গাড়িমুক্ত করার চিন্তা করছেন তারা৷ চীন এখন পর্যন্ত ৩০০টি ইকো-শহর নির্মাণ করেছে৷
ছবি: Imago/Photoshot/Construction Photography
কলম্বিয়ায় গাড়িবিহীন দিন
কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায় সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক বাস পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে৷ ১৯৭৪ সাল থেকে এই শহরের মেয়র নির্দেশ দিয়েছেন সপ্তাহে একদিন ১২০ কিলোমিটার রাস্তায় কোনো গাড়ি চলবে না৷ এর পাশাপাশি শহর কর্তৃপক্ষ কয়েকশ’ কিলোমিটার সাইকেল লেন নির্মাণ করছেন৷ ফলে গাড়িবিহীন দিনগুলোতে এখানে সাইকেল আরোহীদের সংখ্যা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
ছবি: Transmilenio Colombia
দক্ষিণ কোরিয়ায় কমছে গাড়ির ওপর নির্ভরশীলতা
দক্ষিণ কোরিয়ার শহর ইনচেনের আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক এলাকা সংদোতে গাড়ির তুলনায় সাইকেল চালকদের প্রাধান্য দেয়া হয়৷ গণপরিবহণের পাশাপাশি যাতে বিপুল সংখ্যক সাইকেল নির্বিঘ্নে চলতে পারে, সেজন্য এই এলাকার রাস্তাগুলোকে চওড়া করা হয়েছে৷ আবাসিক এলাকার ভবনগুলো এমন দূরত্বে নির্মাণ করা হয়েছে যাতে হেঁটে যাওয়া যায়৷ ২০২০ সাল নাগাদ এই পরিকল্পনা অনুযায়ী এই শহরের নির্মাণকাজ শেষ হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Yonhap
বিশুদ্ধ বাতাসের শহর
২০২০ সাল নাগাদ স্যান ফ্রান্সিস্কো মার্কেট এলাকায় সব ধরনের গাড়ি নিষিদ্ধের পরিকল্পনা করছেন কর্তৃপক্ষ৷ এই প্রস্তাবের আওতায় ঐ এলাকায় গণপরিবহণকে প্রাধান্য দেয়া হবে৷ এছাড়া এই এলাকাটি সাইকেলআরোহী এবং পথচারীবান্ধব করে গড়ে তোলা হবে৷ আগামী ২৫ বছরের মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া জীবাশ্ম জ্বালানি চালিত যান নিষিদ্ধের পরিকল্পনা করছে৷
ছবি: Imago/imagebroker
মেক্সিকো সিটির পরিকল্পনা
বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহরগুলোর একটি হলর মেক্সিকো সিটি৷ কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ২০২৫ সাল নাগাদ সব্ ধরনের ডিজেলচালিত গাড়ি নিষিদ্ধের অঙ্গীকার করেছে শহরটি৷
ছবি: Imago/ZUMA Press
ভারতে বৈদ্যুতিক রিকশা
ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে ক্রমাগত বাড়ছে বায়ুদূষণ৷ ইলেকট্রিক রিকশা এক্ষেত্রে বায়ুদূষণ রোধে সহায়ক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ ২০৩০ সাল নাগাদ নতুন সব বাহন হবে বিদ্যুৎচালিত এবং রাজধানীতে গ্যাস চালিত যান নিষিদ্ধ করা হবে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Kiran
6 ছবি1 | 6
তারপর থেকে এই পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট ২৪ ঘণ্টা ধরে বাতাসের মান সংক্রান্ত তথ্য পাঠিয়ে চলেছে৷ ৮০০ কিলোমিটার উচ্চতায় সেটি দিনে ১৪ বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে চলেছে৷ এই স্যাটেলাইট বস্তুকণা, মিথেন, ওজোন, কার্বন মোনোক্সাইড বা সালফার ডাই অক্সাইডের মতো নানা রাকম ক্ষতিকারক পদার্থ পরিমাপ করে৷
২০১৮ সালের মে মাসে সেন্টিনেল ফাইভপি হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের এক অগ্নুৎপাতের সাক্ষী হয়েছিল৷ বিশাল পরিমাণ সালফার ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে৷ সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা এই প্রথম বিষাক্ত মেঘের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে সেই মেঘ কোথায় ছড়িয়ে পড়বে, সে বিষয়ে পূর্বাভাষ দিতে পেরেছেন৷ ফলে বিপর্যয়ের সময় সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অনেক সুবিধা হয়েছে৷
এই স্যাটেলাইট আরও কিছু কাজ করতে পারে৷ দুর্গম অথবা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জায়গা সম্পর্কেও তথ্য সরবরাহ করে এটি৷ যেমন বিশ্বের উত্তরতম শহর৷ সেখানে রাশিয়ার শিল্পক্ষেত্রের জন্য নিকেল প্রক্রিয়াকরণ করা হয়৷ স্যাটেলাইটের ছবির ভিত্তিতে বিশাল এলাকা জুড়ে সালফার ডাই অক্সাইডের দূষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে৷
গোটা বিশ্বের উপর নজরদারি চালানো হচ্ছে৷ মানচিত্রে লাল অংশগুলি সালফার ডাই অক্সাইডের উচ্চ মাত্রা চিহ্নিত করছে৷ শুধুমাত্র পারস্য উপসাগর অঞ্চলে পেট্রোলিয়াম উৎপাদনকারী দেশগুলিতেই এই সমস্যা নেই৷
ইউরোপের উপরও লক্ষ্য রাখা হচ্ছে৷ সেন্টিনেল ফাইভপি স্যাটেলাইটের তোলা ছবি সবার জন্য বিনামূল্যে পাওয়া যায়৷ ফলে যে কেউ বায়ু দূষণের উৎস শনাক্ত করতে পারে৷
জার্মানির কয়লা চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি কি বাতাসে অতিরিক্ত মাত্রায় সালফার ডাই অক্সাইড নির্গমন করে? ভবিষ্যতে কার্যত যে কেউ তার উপর নজর রাখতে পারে৷ জার্মানির শহরগুলির বাতাসে কি মাত্রাতিরিক্ত নাইট্রোজেন অক্সাইড রয়েছে? সেন্টিনেল ফাইভপি-র মতো স্যাটেলাইট বিশ্বের যে কোনো নাগরিককে পরিবেশের উপর নজর রাখার সুযোগ দিচ্ছে৷
ইয়োসেফিন কারোল/এসবি
নগরবাসীদের ভয় কিসে ও কেন?
শহরগুলি চুম্বকের মতো মানুষজনকে টানে৷ শহরে আছে অবকাঠামো, শিক্ষা, চাকুরি ও সামাজিক মেলামেশা....কিন্তু শহরগুলির আয়তন ও জনসংখ্যাই তাদের সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/Asianet Pakistan/R. Ali
সন্ত্রাসী আক্রমণ
ইউরোপ কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শহরবাসীদের সবচেয়ে বড় ভয় হল কোনো আচম্বিত ও অপ্রত্যাশিত সন্ত্রাসী আক্রমণ – অথচ কাবুল কিংবা আলেপ্পোর তুলনায় পশ্চিমে খুব কম মানুষই সন্ত্রাসের শিকার হন৷
ছবি: Reuters/S. Perez
জলবায়ু পরিবর্তন
পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপ অনুযায়ী পশ্চিমে শহরবাসীদের কাছে দ্বিতীয় বৃহত্তম আশঙ্কার উৎস হলো জলবায়ু পরিবর্তন৷ বিশ্বের অধিকাংশ শহরই হয় সমুদ্রের উপকূলে, নয়ত নদীতীরে অবস্থিত (ছবিতে হিউস্টন); কাজেই সাগরের পানির উচ্চতা বাড়লে শহরগুলির বিপদ ঘটবে বৈকি৷ অপরদিকে তথাকথিত হটহাউস গ্যাসগুলির ৭৫ শতাংশ আসে শহরগুলি থেকে৷
ছবি: Reuters/J. Bachmann
আবহাওয়ার চরম...
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া যে চরমে উঠথে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ এ বছর ‘ইর্মা’ কিংবা ‘হার্ভে’-র মতো ঘূর্ণিঝড় বা (ছবিতে) মুম্বইতে বর্ষার প্লাবন – এ সবই লক্ষ লক্ষ মানুষের, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের জীবন ও জীবিকার বিপদ ঘটাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/I.Shaikh
প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলে ফাঁদে
ভূমিকম্প বা সুনামির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে শহরবাসীরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন, কেননা তাদের পালাবার পথ নেই৷ অপরদিকে অতি স্বল্পসময়ের মধ্যে হাসপাতাল, পথঘাট এবং সেতু, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ভেঙে পড়তে পারে৷
ছবি: Getty Images/Feng Li
সাইবার আক্রমণ
নগরসভ্যতায় আজ পানি কি বিদ্যুৎ সরবরাহ, পরিবহণ কিংবা হাসপাতাল – সবই চলে কম্পিউটারে৷ তাই এই সব কম্পিউটার প্রণালীর উপর হ্যাকারদের সাইবার আক্রমণের সম্ভাবনা নগরবাসীদের তৃতীয় বৃহত্তম আশঙ্কা – বলছে পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপ৷
ছবি: Colourbox
যানজট ও পরিবহণে অচলাবস্থা
শহরে বাসস্থান থেকে কর্মস্থান, সব কিছু কাছে হওয়ার কথা৷ কিন্তু শহরের কেন্দ্রীয় এলাকাগুলিতে বাড়িভাড়া আকাশছোঁয়া হওয়ার ফলে বহু মানুষ অনিচ্ছাসত্ত্বেও ‘ডেইলি প্যাসেঞ্জার’ হয়ে পড়েছেন, অনেক সময় নিজের গাড়িতে৷ জার্মানিতে শ্রমিক-কর্মচারীদের ৬০ শতাংশই কাজে আসেন দূরদূরান্ত থেকে; কাজেই পথে যানজট, শহরে যানজট ও সেই পরিমাণে বায়ুদূষণ৷
অপরাধবৃত্তি
শহর-নগর অপরাধের কেন্দ্রস্থল: চোরডাকাতি, ধর্ষণ, সহিংসতা৷ বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক শহরগুলি হলো মধ্য ও দক্ষিণ অ্যামেরিকায়: ভেনেজুয়েলার কারাকাসে প্রতি এক লাখ বাসিন্দার অনুপাতে বছরে ১৩০ জন মানুষ খুন হন; মেক্সিকোর আকাপুলকোয় এই সংখ্যা হলো ১১৩; হন্ডুরাসের সান পেদ্রো সুলায় বছরে প্রতি এক লাখ মানুষ প্রতি খুন হন ১১২ জন মানুষ৷ একমাত্র যুদ্ধের এলাকায় এর চেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারান৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Felix
ধনি-দরিদ্র
বড় বড় শহরগুলিতে ধনি-দরিদ্রের ব্যবধান বিশেষ করে চোখে পড়ে: একদিকে বিপুল সম্পদ ও সেই পরিমাণে সম্ভোগ; অন্যদিকে বস্তি ও হাভেলা, অভাব-অনটন ও সহিংসতা৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/McPHOTO
তবুও মানুষ শহরের খোঁজে
লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু শহরে আসেন গ্রাসাচ্ছাদন, নিরাপত্তা ও সুন্দর জীবনের খোঁজে৷ (ছবিতে বার্লিনের) সরকারি কার্যালয়ে নাম লেখানোর জন্য ছেলে কোলে দাঁড়ানো উদ্বাস্তু মায়ের কাছে শহর, এমনকি বিদেশি শহরও ভয়ভীতি নয়, আশার প্রতীক, সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের প্রতীক৷