আপনি কি স্যামসাং, সনি কিংবা অ্যাপলের স্মার্টফোন ব্যবহার করছেন? এ সব ফোনে আজকাল লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ব্যবহৃত হচ্ছে৷ আর এই ব্যাটারি তৈরিতে প্রয়োজন হয় কোবাল্ট৷
বিজ্ঞাপন
বিশ্বের মোট কোবাল্টের অন্তত অর্ধেক আসে কঙ্গো থেকে৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, কঙ্গোর খনিগুলোতে শিশুরা কাজ করছে৷ তাদের কারও কারও বয়স এমনকি সাতও হতে পারে৷ মানবাধিকার এই সংস্থাটি বলছে, হয়ত এই শিশুদের সংগ্রহ করা কোবাল্টই স্মার্টফোনের ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে৷
কঙ্গোর দক্ষিণে বেশ কিছু খনি রয়েছে৷ কোনো খনি কোম্পানি সেখানে কর্মরত না থাকলেও ব্যবসায়ীরা অনানুষ্ঠানিকভাবে সেই খনি থেকে কোবাল্ট সহ অন্যান্য মূল্যবান ধাতু সংগ্রহ করে৷ আর এ কাজে প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে শিশুদেরও কাজে লাগানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে অ্যামনেস্টি৷
প্রতিবেদন তৈরিতে খনিতে আগে কাজ করেছে এবং এখন কাজ করছে এমন ৮৭ জন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে অ্যামনেস্টি৷ এর মধ্যে ১৭ জন শিশু ও ১৮ জন কোবাল্ট ব্যবসায়ী রয়েছে৷
ক্যামেরার চোখে বাংলাদেশে শিশু শ্রম
বাংলাদেশে ৪৫ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ তাদের মধ্যে ১৭ লাখের বেশি আবার কাজ করে রাজধানী ঢাকায়৷ আমাদের আলোকচিত্রী মুস্তাফিজ মামুন শিশুশ্রমের কিছু চিত্র তুলে এনেছেন আপনাদের জন্য৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বেলুন কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের একটি বেলুন তৈরির কারখানায় কাজ করছে দশ বছরের এক শিশু৷ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত, যার প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশু শ্রমিক খোদ রাজধানীতেই৷
ছবি: Mustafiz Mamun
নেই কোনো নজরদারি
কামরাঙ্গীর চরের এই বেলুন কারখানায় খোলামেলাভাবে নানা ধরনের রাসায়নিকের মাঝে কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও আদতে তা মানা হচ্ছে না৷ সরকারিভাবে নেই কোনো নজরদারির ব্যবস্থা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সিংহভাগই শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে কমপক্ষে দশটি বেলুন তৈরির কারখানা আছে, যেগুলোর সিংহভাগেই শিশু শ্রমিক কাজ করে৷ সড়ক থেকে একটু আড়ালে ভেতরের দিকেই কাজ করানো হয় শিশুদের৷ সপ্তাহে সাত দিনই সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে হয় তাদের৷ তবে শুক্রবারে আধাবেলা ছুটি মেলে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
ঢাকার কেরাণীগঞ্জে সিলভারের তৈজসপত্র তৈরির কারখানায় কাজ করে শিশু শ্রমিক আলী হোসেন৷ মারাত্মক উচ্চ শব্দের মধ্যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয় তাকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ট্যানারি কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার হাজারীবাগের একটি ট্যানারি কারখানায় বাইরে কাজ করে নোয়াখালীর আসিফ৷ বয়স মাত্র বারো৷ রাসায়নিক মিশ্রিত চামড়া শুকানোর কাজ করে সে৷ দিনে ১২ ঘণ্টারও বেশি কাজ করে সামান্য যে মজুরি পায় তা দিয়ে সংসার চালাতে মাকে সাহায্য করে আসিফ৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মায়ের সঙ্গে রাব্বি
কামরাঙ্গীর চরের একটি প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে মায়ের সঙ্গে কাজ করে চাঁদপুরের রাব্বি৷ এই কেন্দ্রের মালিক নাকি শিশু শ্রমিক নিয়োগের বিরোধী৷ মায়ের অনুরোধে রাব্বিকে কাজ দেয়া হয়েছে বলে দাবি তাঁর৷ কারণ রাব্বির মা সারাদিন খেটে যে মজুরি পান তাতে সংসার চলে না৷ সংসার চালাতে তাই কাজ করতে হচ্ছে রাব্বিকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
হিউম্যান হলারে শিশু হেল্পার
ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী হিউম্যান হলারগুলোতে শিশু শ্রমিক চোখে পড়ার মতো৷ বাহনগুলো দরজায় ঝুলে ঝুলে কাজ করতে হয় এ সব শিশুদের৷ চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকারও হয় এসব শিশুরা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ব্রিক ফিল্ডে শিশুরা
ঢাকার আমিন বাজারের বিভিন্ন ব্রিক ফিল্ডেও কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ প্রতি হাজার ইট বহন করে পারিশ্রমিক পায় ১০০-১২০ টাকা৷ একটি কাঁচা ইটের ওজন কমপক্ষে তিন কেজি৷ একেকটি শিশু ৬ থেকে ১৬টি ইট এক-একবারে মাথায় নিয়ে পৌঁছে দেয় কমপক্ষে ৫০০ গজ দূরে, ইট ভাটায়৷ তাদের কোনো কর্মঘণ্টাও ঠিক করা নেই৷ একটু বেশি উপার্জনের আশায় রাত পর্যন্ত কাজ করে তারা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেদ কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা
পুরনো ঢাকার লালবাগের একটি লেদ কারখানায় কাজ করে ১১ বছরের শিশু রহিম৷ সারাদিন লোহা কাটা, ভারি যন্ত্রপাতি মেরামত, হাতুরি পেটানোসহ নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে সে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
9 ছবি1 | 9
ব্যবসায়ীরা কোবাল্ট সংগ্রহের পর সেগুলো ‘কঙ্গো ডঙফাঙ মাইনিং' বা সিডিএম কোম্পানির কাছে বিক্রি করে৷ সিডিএম চীনের মিনারেল জায়ান্ট ‘হুয়াইয়ো কোবাল্ট'-এর একটি সাবসিডিয়ারি৷ কঙ্গো থেকে যাওয়া কোবাল্ট প্রক্রিয়াজাত করে দু'টি চীনা কোম্পানি৷ তারপর সেগুলো চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাটারি তৈরি করে এমন কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়৷ এই কোম্পানিগুলো অ্যাপল, মাইক্রোসফট, সামস্যাং, সনি সহ গাড়ি নির্মাতা ডাইমলার ও ফল্কসভাগেনের জন্য ব্যাটারি তৈরি করে৷
কোম্পানিগুলো যা বলছে
অ্যামনেস্টির পক্ষ থেকে ঐ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা যে জবাব দিয়েছে সেগুলো ‘সুনির্দিষ্ট' নয় বলে মন্তব্য করেছে মানবাধিকার এই সংস্থাটি৷ যেমন অ্যাপল বলেছে, তাদের ব্যবহার করা কোবাল্ট কঙ্গো থেকে এসেছে কিনা তা ‘খতিয়ে' দেখা হচ্ছে৷ তবে তারা অতীতে অপ্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে৷ মাইক্রোসফট আর স্যামসাং বলেছে, তাদের কোবাল্ট কঙ্গো থেকে এসেছে কিনা তা তারা নিশ্চিত করতে সমর্থ নয়৷ আর সনি, ডাইমলার ও ফল্কসভাগেন বলেছে, অ্যামনেস্টি যা বলছে তা যে ঘটছে তার প্রমাণ নেই৷ এদিকে, হুয়াইয়ো কোবাল্ট বলছে, তারা কোবাল্ট সংগ্রহের ক্ষেত্রে সরবরাহকারী বাছাইয়ে কঠোর পদ্ধতি অনুসরণ করে৷ যারা শিশুদের শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করে তাদের কাছ থেকে কোবাল্ট ক্রয় করা হয় না৷ ২০১৪ সালে যখন তারা দু'টি খনি পরীক্ষা করতে গিয়েছিল তখন কোনো শিশুর দেখা তারা পায়নি বলেও জানিয়েছে কোম্পানিটি৷
ষড়যন্ত্র!
কঙ্গোর সরকার বলছে, কোবাল্ট উৎপাদনকারী অন্য দেশগুলো কঙ্গোর সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে এ ধরনের অভিযোগ করছে৷
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কঙ্গোর দক্ষিণের খনিগুলোতে কাজ করতে গিয়ে কমপক্ষে ৮০ জন প্রাণ হারিয়েছে বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি৷
ইউনিসেফ বলছে ২০১৪ সালে কঙ্গোর দক্ষিণাঞ্চলের খনিগুলো প্রায় ৪০ হাজার শিশু কাজ করেছে৷ এর মধ্যে অনেকে কোবাল্ট খনিতে কাজ করেছে৷