মাথার চুল ছোট করে কাটা, পরনে ছেলেদের মতো পোশাক৷ এরা ‘বাচ্চা পশ' – আফগানিস্তানে ছেলেদের মতো করে বড় হয়ে ওঠা অনাকাঙ্খিত, অবাঞ্ছিত সব মেয়ে৷ যেমন ১৪ বছরের তোহেবা৷ বাবার গাড়ি সারানোর কারখানায় কাজ করে৷ তবে শাফি নামে৷
বিজ্ঞাপন
তোহেবারা ওরফে শাফিরা আফগানিস্তানে ছেলেদের মতো স্কুলে যায়, অন্যান্য বোনদের দেখাশোনাও করে৷ ততদিন পর্যন্ত, যতদিন না তাদের ঋতুচক্র শুরু হয় অথবা নারীসুলভ দৈহিক সৌর্ন্দয ফুটে ওঠে৷
বহু পুরনো প্রথা হলেও ‘বাচ্চা পশে’-র কারণগুলোকে তিন ভাগে চিহ্নিত করা যায়৷
সামাজিক
আফগান সমাজে ছেলে শিশুর মর্যাদা মেয়ে সন্তানের থেকে উঁচুতে৷ আজও সে দেশে ছেলে সন্তানের জন্মকে অপরিহার্য ও সম্মানের বলে বিবেচনা করা হয়৷ আফগানদের দৃষ্টিতে পুত্র সন্তান বংশের ও পরিবারের সম্মানের ধারক-বাহক৷ তাই যার পুত্র সন্তান নেই, সবাই তাকে দেখে করুণার চোখে৷
আর্থিক
যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে আর্থিক অস্থিতিশীলতাও ‘বাচ্চা পশ’ প্রথার পিছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে৷ সে দেশের মেয়েরা স্বাধীনভাবে ঘরের বাইরে কাজ করতে পারে না৷ তাই পুত্রহীন দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের মেয়েদের ‘বাচ্চা পশ’ হতে বাধ্য করে৷ শুধু গ্রামে-গঞ্জেই নয়, রাজধানী কাবুলেও বাচ্চা পশের বহু নজির আছে৷
কুসংস্কার
আফগানিস্তানে এখনও এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা মনে করেন যে, সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের পিছনে মায়ের ভূমিকা আছে৷ ‘বাচ্চা পশ’ প্রথার মাধ্যমে একটি মেয়ে শিশুকে ছেলের মতো করে পালন করা হয়, যাতে মায়ের মনে ছেলে সন্তান জন্ম দেওয়ার আকাঙ্খা জাগে৷
বলা বাহুল্য, এই প্রথার ফলে শারীরিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে মেয়ে শিশুটি নিপীড়িত হয়, কারণ, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত এক ধরনের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হবার পর, হঠাৎ করেই আবার তার জীবনাচরণে পরিবর্তন আসে৷ স্বাভাবিকভাবেই এতে মেয়েটির মনে মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়৷ গতকালও যে মেয়েটি ছেলেদের মতো সালোয়ার-কুর্তা পড়তো, তাকেই হয়ত আজ চাদরে মুখ ঢাকতে হচ্ছে৷ গতকালও যে ছেলেদের সাথে খেলা করতো, আজ থেকে ছেলেদের সাথে খেলা করা তার জন্য হয়ত নিষিদ্ধ হয়ে গেছে৷ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে ইচ্ছেমতো বাইরে যাওয়া, স্কুলে গিয়ে পড়াশোনাও৷
আফগান নারীদের সোনালি অতীত
তালেবান শাসনামলে মেয়েদের জন্য বোরকা বাধ্যতামূলক করা হয় আফগানিস্তানে৷ অথচ আফগানিস্তানে এমন একটা সময়ও ছিল, যখন সে দেশের মানুষ, বিশেষ করে নারীরা পশ্চিমা পোশাকে অভ্যস্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উচ্চাকাঙ্খী চিকিৎসকরা
কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’জন নারী মেডিসিন শিক্ষার্থীকে দেখা যাচ্ছে এক অধ্যাপকের সঙ্গে মানবদেহের একটি অংশ পরীক্ষা করতে৷ ছবিটি ১৯৬২ সালে তোলা৷ সে’সময় আফগান সমাজে নারীদের একটি সক্রিয় ভূমিকা ছিল৷ তখন তাঁদের শিক্ষার সুযোগ যেমন ছিল, তেমনই বাড়ির বাইরেও ছিল অবাধ বিচরণ৷
ছবি: Getty Images/AFP
পাশ্চাত্যের পোশাক কাবুলের রাস্তায়
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে একটি রেডিও স্টেশনের বাইরে হাঁটছেন পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরা দুই নারী৷ ১৯৬২ সালে তোলা ছবি এটি৷ কিন্তু উগ্র ইসলামপন্থি তালেবান গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ক্ষমতা গ্রহণের পর, সব কিছু বদলে যায়৷ আর সব কিছু ঢাকা যায়, এমন বোরকা পরে জনসমক্ষে যেতে বাধ্য করা হয় নারীদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার জন্য সম অধিকার - সবসময় নয়
গত শতকের সত্তরের দশকে আফগান শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে মেয়েদের বিচরণ স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল৷ কিন্তু তার মাত্র ২০ বছর পর শিক্ষাকেন্দ্রে মেয়েদের যাতায়াত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়৷ ২০০১ সালে তালেবানের পতনের পর পরিস্থিতি আবার কিছুটা বদলেছে৷ ২০০৩ সালে আফগান সংবিধানে নারী ও পুরুষ উভয়ের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/Hulton Archive/Zh. Angelov
কম্পিউটার প্রশিক্ষণ
কাবুল পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে আফগান শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন একজন সোভিয়েত প্রশিক্ষক৷ ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত – অর্থাৎ এই দশ বছর আফগানিস্তান সোভিয়েতদের দখলে ছিল৷ তাই সেই সময়টায় আফগান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বহু অধ্যাপক অধ্যাপনা করেছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP
শিক্ষার্থীদের ঘোরাফেরা
১৯৮১ সালে তোলা এই ছবিটিতে আফগান ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে৷ ১৯৭৯ সালে সোভিয়েতরা আফগানিস্তানে হামলা চালালে যুদ্ধ শুরু হয় এবং তা দশ বছর ধরে চলে৷ পরবর্তীতে, ১৯৮৯ সালে, সোভিয়েতরা দেশটি ছেড়ে গেলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় আফগানিস্তানে৷ এই গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ১৯৯৬ সালে, তালেবানের ক্ষমতাগ্রহণের মধ্য দিয়ে৷
ছবি: Getty Images/AFP
সবার জন্য স্কুল
সোভিয়েতদের অধিকৃত আফগানিস্তানের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছবি এটি৷ তবে তালেবানের শাসনামল শুরু হওয়ার পর আফগান মেয়েদের স্কুলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়৷ এমনকি বাড়ির বাইরে কাজ করাও নিষিদ্ধ ছিল তাঁদের৷
ছবি: Getty Images/AFP
তেমন কিছু বদলায়নি
এই ছবিটি ১৯৮১ সালে তোলা৷ হিজাব, বোরকা ছাড়া এক মা তাঁর সন্তানদের নিয়ে রাস্তায় হাঁটছেন৷ এমন দৃশ্য এখন আর আফগানিস্তানে দেখা যায় না৷ এমনকি তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ১৫ বছর পরেও না!