আফগানিস্তান থেকে ন্যাটোর সৈন্য প্রত্যাহারের পর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে৷ তা মাথায় রেখে বিশেষ প্রস্তুতি নেয়া উচিত বলে ঢাকায় এক সেমিনারে বক্তারা অভিমত দিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্ট্যাডিজ বা বিআইপিএসএস-র আয়োজনে সোমবার ঢাকায় আফগানিস্তান বিষয়ক এক সেমিনারে বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান এবং ক্যানাডার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন৷ ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডাব্লিলউ গিবসন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন৷
অনুষ্ঠানে বিশ্লেষকরা বলেন, আগামী বছর আফগানিস্তান থেকে ন্যাটোর সৈন্য প্রত্যাহারের পর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নিরাপত্তার ওপর তা প্রভাব ফেলবে৷ প্রায় এক দশক ধরে আফগানিস্তানে ন্যাটোর অধীনে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনী কাজ করছে৷ কিন্তু আগামী বছর তারা আফগান জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে বিদায় নেবে৷ তাতে আফগানিস্তানে তালেবানসহ জঙ্গি তত্পরতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে৷ যার প্রভাব পড়বে এই অঞ্চলে৷
আফগানিস্তান ত্যাগ করছে জার্মান সেনাবাহিনী
আফগানিস্তানে জার্মান সামরিক বাহিনী ‘বুন্ডেসভেয়ার’ এর কম্ব্যাট মিশন শেষ হচ্ছে ২০১৪ সালে৷ তাই সেনাসদস্যদের সঙ্গে কয়েক হাজার টন যুদ্ধ উপকরণ এবং অন্যান্য পণ্যও ফেরত আনতে হবে৷ বিছানা থেকে শুরু করে বিশাল ট্যাংক রয়েছে তালিকায়৷
ছবি: cc-by/Sebastian Wilke/Bundeswehr
বিশাল কর্মযজ্ঞ
জার্মান সেনাবাহিনীর সাড়ে চার হাজারের মতো সেনা সদস্য, সতের শত যান এবং ছয় হাজারের মতো কন্টেইনার রয়েছে আফগানিস্তানে৷ ২০১৪ সালে আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক বাহিনী আইসাফ এর কর্মকাণ্ড শেষ হওয়ার আগেই জার্মান সেনাবাহিনীর অনেক সম্পদ ফিরিয়ে আনা হবে৷ এই সম্পদের মধ্যে মেশিনগান থেকে শুরু করে পঞ্চাশ টন ওজনের ট্যাংক রয়েছে৷
ছবি: cc-by-nd/Bundeswehr/Bienert
ট্রাবজন হাব
হিন্দুকুশ থেকে বিভিন্ন পণ্য ফিরিয়ে আনতে জার্মানি যে দুটি হাব ব্যবহার করছে তার একটি তুরস্কের ট্রাবজন৷ এই বন্দর হয়ে জার্মানিতে পৌঁছাবে বুন্ডেসভেয়ার-এর বিভিন্ন পণ্য৷ তবে আফগানিস্তান থেকে ট্রাবজন পর্যন্ত পণ্য পৌঁছানোর প্রক্রিয়া সহজ নয়৷
ছবি: cc-by-nd/Sebastian Wilke/Bundeswehr
পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার
গত এগারো বছরের বেশি সময় ধরে আফগানিস্তানে অবস্থান করছে জার্মান সেনাবাহিনী৷ তাদেরকে মূলত সেদেশের উত্তরে মোতায়েন করা হয়েছিল৷ ইতোমধ্যে অনেক ক্যাম্প খালি করা হয়েছে৷
ছবি: cc-by-nd/Bundeswehr/Bienert
সবাই সম্ভবত ফিরছেন না
২০১৪ সালের শেষ নাগাদ সম্ভবত সকল জার্মান সেনা ঘরে ফিরবেন না৷ জার্মানি আইসাফের ম্যান্ডেট মেনে আটশো সেনা আরো দীর্ঘ সময়ের জন্য আফগানিস্তানে রাখতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সব পণ্য ফিরবে না
আফগানিস্তানে পাঠানো কিছু জার্মান পণ্য ফেরত আনা হবে না৷ কিছু পণ্য বিক্রি অথবা ধ্বংসে করে ফেলা হবে৷ তবে অস্ত্রশস্ত্র কন্টেইনারে ভরে নিয়ে আসা হবে৷ ইতোমধ্যে এসব পণ্য জমা করা শুরু হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আরেক হাব: মাজার-ই-শরিফ
আফগানিস্তান থেকে জার্মান সেনাবাহিনীর পণ্য ফিরিয়ে আনার আরেকটি হাব হচ্ছে মাজার-ই-শরিফ৷ সে দেশের চতুর্থ বড় এই শহর থেকে অধিকাংশ পণ্য বিমানে পরিবহন করা হচ্ছে৷ তবে পাকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজাকিস্তান হয়ে সড়ক পথেও কিছু পণ্য ফেরত আনা হবে৷ তবে নিরাপত্তার কারণে বেশি পণ্য এভাবে পরিবহন হবে না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রক্ষণাবেক্ষণ এবং জীবাণুমুক্তকরণ
জার্মান সেনাবাহিনীর এসব পণ্যের মাধ্যমে আফগানিস্তান থেকে কোন জীবাণু যাতে জার্মানিতে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য এসব পণ্য জীবাণুমুক্ত করা হবে৷ জার্মানিতে এসব পণ্য প্রবেশের আগেই এটা করা হবে৷
ছবি: Bundeswehr - PIZ SKB/Foto: Vanita Schanze
বিমানে আফগানিস্তান ত্যাগ
বড় এবং ভারি যানবাহন পরিবহনের মতো বিমান জার্মান সামরিক বাহিনীর নেই৷ ফলে ছবির এই বিশাল সামরিক যান পরিবহনের জন্য একটি ইউক্রেনীয়-রাশিয়ান কনসর্টিয়ামের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে৷ এই ব্যবস্থায় প্রত্যেক উড়ালে ৩৭ মিটার দীর্ঘ জায়গায় ১৫০ টন পণ্য পরিবহন সম্ভব হচ্ছে৷
ছবি: cc-by-nd/Bundeswehr/Weinrich
সরাসরি জার্মানিতে ফেরত
অস্ত্র এবং কারিগরিভাবে সংবেদনশীল বিভিন্ন পণ্য বিমানে আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফ থেকে সরাসরি জার্মানিতে ফেরত আনা হচ্ছে৷ ছবির ট্যাংকটি এই সুবিধা পাচ্ছে৷
ছবি: cc-by-nd/Bundeswehr/Schmidt.
বাকি পণ্য আসছে তুরস্ক হয়ে
অস্ত্রবিহীন গাড়ি, রেডিও এবং তাঁবুর মতো পণ্য সরাসরি জার্মানিতে আনা হচ্ছে না৷ আফগানিস্তান থেকে বিমানে এগুলো তুরস্কের ট্রাবজন বন্দরে আনা হচ্ছে৷
ছবি: cc-by/Sebastian Wilke/Bundeswehr
জাহাজে প্রত্যাবর্তন
ট্রাবজন বন্দরে জার্মান সেনাবাহিনীর জন্য কাজ করছেন ১৭০ ব্যক্তি৷ এই বন্দর থেকে ত্রিশ হাজার বর্গমিটার পণ্য জাহাজে জার্মানিতে পাঠাতে কাজ করছেন তারা৷ সমুদ্রপথে বিভিন্ন পণ্য ট্রাবজান থেকে জার্মানিতে পোঁছাতে সময় লাগে দুই সপ্তাহের মতো৷
ছবি: Bundeswehr - PIZ SKB/Foto: Vanita Schanze
11 ছবি1 | 11
বিআইপিএসএস-র প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামান (অব.) ডয়চে ভেলেকে বলেন, ন্যাটোর সৈন্য প্রত্যাহার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে জঙ্গি তত্পরতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে৷ তিনি জানান, বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর যোগাযোগ আছে আফগানিস্তানের তালেবানের সঙ্গে৷ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ এবং জেএমবিসহ আরো অনেক জঙ্গি সংগঠন গড়ে উঠেছে আফগান ফেরত ‘মুজাহিদ'দের নেতৃত্বে৷ তাদের অনেক নেতা-কর্মী এক সময়ে আফগানিস্তানে রাশিয়া বিরোধী যুদ্ধে অংশ নিয়েছে৷ পরবর্তী সময়ে তালেবানরা তাদের বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন গড়ে তুলতে অর্থ এবং রসদ দিয়ে সহায়তা করেছে৷ গত এক দশক আফগানিস্তানে তালেবান চাপের মুখে থাকায় বাংলাদেশের জঙ্গিরাও ঝিমিয়ে পড়েছিল৷ আফগানিস্তান থেকে ন্যাটোর সৈন্য প্রত্যাহার হওয়ার পর তালেবান যদি সক্রিয় হয় তার প্রভাব বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপরও পড়বে৷
ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া'র পরিচালক লে. জেনারেল পি কে সিং (অব.) ডয়চে ভেলেকে বলেন কোনো দেশেই জঙ্গি বা সন্ত্রাসীরা তাদের পাশের দেশের জঙ্গিদের সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারেনা৷ আর সে কারণেই আফগানিস্তানে তালেবানরা আবার সক্রিয় হলে তার প্রভাব বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত এবং পাকিস্তানে পড়বে৷ তবে শুধু যে এই কারণেই জঙ্গি তত্পরতা বাড়বে তা নয়৷ তাদের অর্থ এবং রসদের ব্যাপারটিও গুরুত্বপূর্ণ৷ আর তা বন্ধ করা না গেলে তাদের দমন করা কঠিন৷ এজন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর উচিত পরস্পরকে সহযোগিতা করা৷
মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামান (অব.) বলেন, সে জন্য বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর এখনই প্রস্তুতি নেয়া উচিত৷ আফগানিস্তান থেকে ন্যাটোর সৈন্য প্রত্যাহার পরবর্তী প্রভাব সম্পর্কে ধারণা নিয়ে তা মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে৷ জঙ্গিদের অর্থ এবং রসদের উত্স বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে৷