আফগানিস্তানের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইউএনডিপি৷ এক প্রতিবেদনে এ আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের এই সংস্থা৷
বিজ্ঞাপন
প্রতিবেদনে জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) বলেছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ভেঙে পড়তে পারে আফগানিস্তানের ব্যাংকিং ব্যবস্থা্৷ বিপর্যয় এড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বানও জানানো হয় প্রতিবেদনে৷
বিপর্যস্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা
প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানের ব্যাংকিং খাতের আমানত খুব দ্রুত কমে আসছে৷ ২০২০ সালের শেষ নাগাদ সে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট ২৬৮ বিলিয়ন আফগানির আমানত ছিল, এই মুহূর্তে তা কমে হয়েছে ১৯৪ বিলিয়ন আফগানি (দুই বিলিয়ন ডলার)৷ ইউএনডিপির আশঙ্কা, ২০২১ সালের শেষে আমানতের পরিমান আরো কমে ১৬৫ বিলিয়ন আফগানিতে গিয়ে ঠেকতে পারে৷
বর্তমানে আফগানিস্তানের ব্যাংকিং সেক্টরে রয়েছে ১২টি বাণিজ্যিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান৷ এর মধ্যে ছয়টি প্রাইভেট কমার্শিয়েল ব্যাংক, একটি প্রাইভেট ইসলামি ব্যাংক, তিনটি রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংক এবং দুটি বিদেশি ব্যাংক৷ ২০২০ সালের শেষ দিকের এক হিসেবে দেখা যায়, আফগানিস্তানের ব্যাংকিং সেক্টরের মোট সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশের মালিকানা রয়েছে আফগান ব্যক্তিদের হাতে৷
আফগানিস্তানের সরকারি কর্মচারিরাও নামছেন ভিক্ষায়
আফগানিস্তানে অর্থনৈতিক সংকট চরম রূপ নিচ্ছে৷ বেকারত্ব বাড়ছে, বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম৷ চাকরি হারানো অনেকের পেশা এখন ভিক্ষা৷ ডাব্লিউএফপি, আইএমএফ, ইইউ শঙ্কিত৷ বিস্তারিত ছবিঘরে...
ছবি: Oliver Weiken/dpa/picture alliance
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট
গত আগস্টে কাবুলের দখল নেয় তালেবান৷ তারপর মোটামুটি সারা দেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেও অর্থনীতি দ্রুত চরম বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে৷ আন্তর্জাদিক দাতা সংস্থাগুলো আফগানিস্তান ছেড়েছে৷ বিদেশি সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর থেকে দৃশ্যত বিদেশের কোনো অর্থনৈতিক সহায়তাও পাচ্ছে না তালেবানের আফগানিস্তান৷ প্রসঙ্গত, আফগানিস্তানের নাগরিক সেবা সংশ্লিষ্ট খরচের তিন চতুর্থাংশই বিদেশি সহায়তা নির্ভর৷
ছবি: Bernat Armangue/AP Photo/picture alliance
ব্যাংকে টাকার অভাব
আশরাফ গনি সরকারের রেখে যাওয়া ৯৫ বিলিয়ন ডলারের সম পরিমান অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পড়ে আছে৷ তালেবান সরকার তা তুলতে পারছে না৷ অন্যদিকে সরকার নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি টাকা তোলায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় অনেকে নিজের জমানো টাকাও প্রয়োজনমতো তুলতে পারছেন না৷ ওপরের ছবিতে এক ব্যাংকের সামনে টাকা তুলতে আসা মানুষদের দীর্ঘ লাইন৷
ছবি: Oliver Weiken/dpa/picture alliance
বেকারত্ব এবং বেতন-সমস্যা
গনি সরকারের আমলের অনেক সরকারি-বেসরকারি কর্মচারি তালেবান আমলে চাকরি হারিয়েছেন৷ এ কারণে আগে থেকেই ধুঁকতে থাকা আফগানিস্তানে বেকারত্ব আরো বেড়েছে৷ তাছাড়া কর্মরতদের অনেকেই বেতন নিয়মিত পাচ্ছেন না বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন৷ ছবিতে বেকারত্ব ও নারীদের ওপর আরোপিত নানা বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে আফগানদের বিক্ষোভ মিছিল৷
ছবি: Privat
খাদ্যের জন্য আসবাব বিক্রি, ভিক্ষা
খাদ্যপণ্যের তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে আফগানিস্তানে৷ দাম বাড়ছে হু হু করে৷ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, খাবার কেনার টাকা জোগাড় করতে তারা এখন ঘরের আসবাবপত্র বিক্রি করছেন৷ সাবেক সরকারি কর্মকর্তা আজমল (ছদ্মনাম) জানান, তিনি এমন কয়েকজন সাবেক চাকুরিজীবীকে চেনেন, যারা ‘‘এখন বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করছেন, কিংবা দিনমজুরের কাজ করছেন৷’’
ছবি: SHAH MARAI/AFP/Getty Images
দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা
খরা এবং করোনা মহামারির মাঝে আফগানিস্তান এখন এমন এক অবস্থায় যে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, সেখানে চরম মানবিক সংকট অত্যাসন্ন৷ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি)-র আফগানিস্তান শাখার প্রধান মেরি-এলেন ম্যাকগ্রোয়ার্টি মনে করেন, আফগানিস্তানের অন্তত ৮৭ লাখ মানুষ এ মুহূর্তে ‘‘অনাহার থেকে এক পা দূরে৷’’ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আফগানিস্তানে অচিরেই ভয়াবহ মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে৷
ছবি: Denis Elamu/Photoshot/picture alliance
আইএমএফ-এর হুঁশিয়ারি
এদিকে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে শরণার্থী সংকট চরম রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)৷ সংস্থাটি বলেছে, আফগানিস্তানের অর্থনীতি এ বছর ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সঙ্কুচিত হতে পারে। এর প্রভাবে লাখ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যকে বরণ করে নিতে বাধ্য হবে৷ এর প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোতেও নানাভাবে পড়বে বলে মনে করে আইএমএফ৷
ছবি: Privat
ইউরোপীয় ইউনিয়নের আশঙ্কা
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতি নির্ধারণ কমিটির প্রধান ইয়োসেপ বোরেল-ও আফগানিস্তান নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন৷ গত অক্টোবরে এক ব্লগ পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘‘ভয়ঙ্কর এক মানবিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তান৷ সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয় চরম রূপ নিচ্ছে৷ এ পরিস্থিতি আফগানদের এবং আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে৷’’
ছবি: David Dee Delgado/REUTERS
7 ছবি1 | 7
আফগানিস্তানের ব্যাংকিং সেক্টর টিকে আছে মূলত কাবুল, হেরাত আর মাজার-ই-শরিফকে ঘিরে৷ প্রধান ব্যাংকগুলোর ৪০০টি শাখার বেশিরভাগই রয়েছে এই তিন শহরে৷ শহরকেন্দ্রিক ব্যাংকগুলোর প্রায় ৬০ভাগ লেনদেনই বিদেশি মুদ্রা, বিশেষ করে ডলার নির্ভর৷ কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় ফেরার কয়েক সপ্তাহ পর দেশের সব ব্যাংক খোলা হলেও ব্যাংকগুলো ভালো অবস্থায় নেই৷ সেবাগ্রহিতাদের তারা ঋণ দিতে পারছে না নগদ টাকার অভাবের কারণে৷ ইউএনডিপির আফগানিস্তান ব্যুরোর প্রধান আল দারদারি মনে করেন, এ অবস্থার একটি কারণ আফগানদের মনে জন্ম নেয়া ভীতি৷ আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে যে চার মিলিয়ন ডলার রয়েছে সেখান থেকে মাত্র পাঁচ লাখ ডলার এখন বাজারে ঘুরছে৷ বাকিটা পুরোই রয়ে গেছে আফগানদের হাতে৷ আল দারদারি বলেন, ‘‘লোকজন ভয়ে আছে বলে বাকি টাকাটা এখন গদি বা বালিশের নীচে পড়ে আছে৷৷ ''
তালেবানের এই আফগানিস্তান
আফগানিস্তানে এখন আর বিদেশি সৈন্য নেই৷ সব জায়গায় শুধুই সশস্ত্র তালেবান যোদ্ধার উপস্থিতি৷ আরো অনেক পরিবর্তন চোখে পড়ছে দেশ জুড়ে৷ দেখুন ছবিঘরে..
ছবি: WANA NEWS AGENCY/REUTERS
যেন পুরুষের দেশ
তালেবান দখল নেয়ার পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবন ফিরছে আফগানিস্তানে ৷দোকান, অফিস-আদালত খুলছে৷ তবে কোনো জায়গাতেই নারীদের তেমন দেখা যায় না৷ ছবির এই রেস্তোরাঁতেও খেতে আসা সবাই পুরুষ৷
ছবি: WANA NEWS AGENCY/REUTERS
লিঙ্গবৈষম্য
কাবুলের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আফগানিস্তানের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এখন ছেলে আর মেয়েদের বসতে হয় আলাদা৷ মাঝে পর্দা অথবা কার্ডবোর্ডের দেয়াল দিয়ে আলাদা করা হয় তাদের৷ প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের বৈষম্য এভাবে তুলে ধরতে চায় তালেবান৷ এর কারণ জানাতে গিয়ে তালেবান নেতা আব্দুল বাগি হাক্কানি বলেন, ‘‘সহশিক্ষা ইসলামের মূল নীতিমালা এবং আমাদের জাতীয় মূল্যবোধ, রীতিনীতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷’’
ছবি: AAMIR QURESHI AFP via Getty Images
নারীর নিয়ন্ত্রিত অধিকার
হেরাতের মসজিদে এভাবেই এখন নামাজ আদায় করতে যান নারীরা৷ নারীদের শুধু নিজের পছন্দের পোশাক পরার অধিকারই কেড়ে নেয়া হয়নি, তালেবানের সাংস্কৃতিক কমিশনের প্রধান আব্দুল্লাহ ওয়াসিক জানিয়েছেন, এখন থেকে খেলাধুলাতেও সীমিত পরিসরে অংশ নিতে পারবেন মেয়েরা৷
ছবি: WANA NEWS AGENCY/REUTERS
অলি-গলিতেও সশস্ত্র তালেবান
ছবির এই রাস্তার মতো আফগানিস্তানের সব শহরের সব রাস্তায়ই থাকে তালেবান পাহারা৷ সশস্ত্র তালেবান যোদ্ধারা কেউ পশ্চিমা পোশাক পরেছেন কিনা, তালেবানবিরোধী কিছু করছেন কিনা এসব দিকে কড়া নজর রাখেন৷
ছবি: Haroon Sabawoon/AA/picture alliance
বেকারত্ব বাড়ছে
কাবুলের রাস্তার পাশে বসে কোনো কাজের সুযোগের অপেক্ষায় কয়েকজন দিনমজুর৷ আফগানিস্তানে বেকারত্ব দ্রুত বাড়ছে৷ জাতি সংঘের আশঙ্কা, বিদেশি সহায়তা না পেলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ বেকারত্ব ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যেতে পারে, দারিদ্র্যের হারও সর্বশেষ সমীক্ষার ৭২ শতাংশ থেকে বেড়ে শতকরা ৯৮ ভাগ হয়ে যেতে পারে৷
ছবি: Bernat Armangue/dpa/picture alliance
তালেবানকে চ্যালেঞ্জ
প্রতিবাদ, বিক্ষোভ রোধে লাঠি, বেত, এমনকি আগ্নেয়াস্ত্রও চালায় তালেবান৷ এ বিষয়ে তালেবানকে সতর্কও করেছে জাতিসংঘ৷ তালেবানের হামলায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে চারজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অনেক৷ তা সত্ত্বেও নিজেদের অধিকার আদায়ের দাবিতে সোচ্চার নারীরা৷ ওপরের ছবিতে এক নারী বিক্ষোভকারীর হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের (নারীর) ক্ষমতার ফলাফল৷’’
ছবি: REUTERS
তালেবানের নারী সমর্থক
তালেবান দখল নেয়ার পর আফগানিস্তানে তালেবান সমর্থক নারীদেরও দেখা যাচ্ছে৷ ওপরের ছবিতে তালেবান সমর্থক নারীদের বিক্ষোভের এক প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘‘মুজাহিদিনের দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবহারে আমরা সন্তুষ্ট৷ ’’
ছবি: AAMIR QURESHI/AFP/Getty Images
তালেবানের পক্ষপাত
তালেবানবিরোধীদের সমাবেশে হামলা হয়েছে, সেই খবর প্রকাশ করতে যাওয়া সাংবাদিকদেরও ধরে নিয়ে পিটিয়েছে তালেবান৷ অন্যদিকে তালেবান সমর্থকদের সমাবেশ কাভার করতে আহ্বান জানানো হয় সাংবাদিকদের৷
ছবি: AAMIR QURESHI/AFP/Getty Images
8 ছবি1 | 8
রক্ষার একমাত্র উপায়
তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের ব্যাংকিং খাতের ভগ্নদশা দেশটির জন্য বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে বলে মনে করেন ইউএনডিপির আফগানিস্তান ব্যুরোর প্রধান আব্দাল্লাহ আল দারদারি৷
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘‘ব্যাংকিং সেক্টরকে বাদ দিয়ে আফগানিস্তানের চলমান সংকটের মানবিক সমাধান কখনো সম্ভব নয়৷'' তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে আফগানিস্তানের বিষয়ে সার্বিক নীরবতা, নিষ্ক্রিয়তার প্রসঙ্গ টেনে তার প্রশ্ন, ‘‘আমরা কি আসলে আফগানিস্তানকে বিচ্ছিন্ন দেখতে চাই?''