পাশ্চাত্যের দেশগুলির সহযোগিতায় আফগানিস্তানের শিক্ষাবিভাগ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে৷ বিশেষ করে জার্মানির অংশগ্রহণে এক্ষেত্রে অনেক লক্ষ্য পূরণ হয়েছে৷ আশা, এই ধরনের সহায়তা আগামী দশ বছরেও অব্যাহত থাকবে৷
বিজ্ঞাপন
‘‘২০০১ সালে আফগানিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪০০০৷ ছিলেন না কোনো ছাত্রী৷ বর্তমানে ২৬টি সরকারি ইউনিভার্সিটিতে ৮০.০০০ এরও বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন৷ এক দশকের মধ্যে এটা একটা বিরাট প্রসার৷'' বলেন জার্মান ছাত্র বিনিময় কর্মসূচি ডিএএডির আলেক্সান্ডার কুপ্ফার৷ আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয় সেক্টরকে পুনর্গঠনের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি৷
ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিবর্তন
অবশ্য কুপ্ফার অতিরিক্ত আশাবাদী হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেন৷ তাঁর মতে, এখন আফগানিস্তানে ঐতিহাসিক ও সামাজিক দিক দিয়ে এক বিরাট পরিবর্তন শুরু হয়েছে৷ ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করা চলে একে৷ তবে কয়েক বছরের মধ্যে আফগানিস্তান উন্নয়নের দিক দিয়ে ইউরোপের সমমানের হয়ে উঠবে, এই আশা একেবারে অবাস্তব৷ এই জন্য কয়েক প্রজন্ম লেগে যাবে৷''
আগামী দশ বছরে যা সম্ভব হতে পারে তা হলো, ‘‘শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও উন্নতমানের ব্যাচেলর ও মাস্টার্স ডিগ্রি চালু করা৷ ব্যাচেলর কোর্সের জন্য আরো মাস্টার্স ডিগ্রিধারী শিক্ষক প্রয়োজন৷ আর মাস্টার্স কোর্সের জন্য দরকার ডক্টরেট ডিগ্রিধারী শিক্ষক৷ আগামী দশ বছরের মধ্যে এই লক্ষ্যের অনেকটাই পূরণ হওয়া সম্ভব৷'' বলেন ডিএএডির কুপ্ফার৷
এই পর্যন্ত ডিএএডির পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে ৩০০০ আফগানকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে৷ আরো ৩০০০ বিশ্ববিদ্যালয় কর্মীকে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে৷
জার্মানির সহায়তায় বহু কিছু অর্জিত হয়েছে
আফগান বিশ্ববিদ্যালয় মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আসিম নূরবখশ ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘‘গত ১২ বছরে বন্ধুপ্রতীম জার্মানির সহায়তায় শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক কিছু অর্জিত হয়েছে৷'' তাঁর ইচ্ছা ভবিষ্যতে আরো শিক্ষার্থীকে জার্মানিতে ডক্টরেট করার সুযোগ দেওয়া হোক৷ যাতে তাঁরা স্বদেশে ফিরে গিয়ে শিক্ষকতা করতে পারেন৷
আফগানিস্তানের শিক্ষার্থীদের জন্য জার্মানিতে ‘করেসপন্ডেন্স কোর্স' চালু করার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চলছে৷ আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভর্তির জন্য আবেদনকারীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে৷ এতজনকে জায়গা দেওয়ার সামর্থ্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির নেই৷ ২০১২ সালে ১৪০,০০০ আবেদনকারী ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করেন৷ কিন্তু মাত্র ৪১,০০০ জনকে ভর্তি করা হয়৷ করেসপন্ডেন্স কোর্স চালু হলে এই সমস্যার কিছুটা সুরাহা হবে৷
সব দেশেই শিক্ষার ধরণ আলাদা
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে, বিশেষকরে আজকের এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে৷
ছবি: Getty Images
সব স্কুল কি এক রকম?
সারা বিশ্বের ছাত্ররা একইভাবে পড়ালেখা শেখে? না, তবে প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে৷ কোনো দেশে ছাত্র-ছাত্রীরা খোলা আকাশের নীচে মাটিতে পা মুড়ে বসে লেখাপড়া করে, কোথাও আবার স্কুল বেঞ্চে বসে৷ আবার কোনো কোনো দেশের ছাত্রদের রয়েছে নিজস্ব ল্যাপটপ৷
ছবি: AP
ডিজিটাল স্কুলের বই
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ডিজিটাল সিস্টেমে চলে৷ প্রতিটি ক্লাস রুমেই রয়েছে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট৷ সরকারের ইচ্ছে সব স্কুল বই পুরোপুরিই ই-বুকে রূপান্তরিত করার৷ ডিজিটাল সিস্টেমে লেখাপড়া করতে কোনো ছেলে-মেয়ের যেন অসুবিধা না হয় এবং ডিজিটাল বইয়ের অভাবে যেন কারো লেখাপড়া বন্ধ না হয়, সেজন্য সরকার বিনা মূল্যে তাদের ট্যাবলেট এবং কম্পিউটার দিয়ে থাকে৷
ছবি: AP
গ্রামের স্কুলে যাওয়ার অসুবিধা
অন্যভাবেও পড়াশোনা চলতে পারে৷ কোনোরকমে ঝুলানো একটি ব্ল্যাকবোর্ড এবং কয়েকটি কাঠের বেঞ্চই আফ্রিকার ঘানার এই স্কুলটির জন্য যথেষ্ট৷ এই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে লেখা পড়া করা যায়, যদিও কাগজে কলমে রয়েছে ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখপড়া বাধ্যতামূলক৷ পড়াশোনার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ায় গ্রামের ছাত্রদের অনেকেরই লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়৷
ছবি: Fotolia/Living Legend
টাচপ্যাডের মাধ্যমে লেখা শেখা
তবে জার্মানির এই স্কুলটি ব্যতিক্রম৷ কাগজ, পেন্সিল ছাড়া ছাত্ররা পুরোপুরি স্মার্টবোর্ড এবং নেটবুকের মাধ্যমে লেখা শেখে৷ ডিজিটাল নেটওয়ার্কিং-এর ছাত্রদের যোগাযোগের কাজে সাহায্য করে এবং কর্মদক্ষতা বাড়ায়৷ জার্মানিতে এখনো দুই মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লিখতে পড়তে পারেন না, যদিও পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে জার্মানির সবাই লেখাপড়া জানেন৷
ছবি: AP
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলা থেকেই সুবিধা
শিল্পোন্নত দেশ মানেই সে দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের অন্যদেশের চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক বেশি এগিয়ে থাকা৷ এমনকি ছোট বাচ্চাদেরও সেভাবেই তৈরি করা হয়, যেমন অ্যামেরিকার এই স্কুলটিতে৷ শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলার শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং ৭০ শতাংশ বাচ্চাই প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার আগে অনেককিছু শিখে ফেলে৷ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ১০ জনের মধ্যে হয়ত তিনজন কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার সুযোগ পায়৷
ছবি: AP
যেখানে শিক্ষা অর্থের জন্য বাঁধাগ্রস্থ
কেনিয়াতে সব ছাত্রই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়তে পারে৷ তারপরও অনেকে তার আগেই স্কুল ছেড়ে দেয়৷ স্কুল ড্রেস, বই, খাতা, জুতো ইত্যাদি জোগাড় করা অনেক বাবা মায়ের জন্য কষ্টকর হয় দাঁড়ায়৷ সেখানে ছাত্রের সংখ্যা অনেক বেশি এবং পড়াশোনার মানও নিম্ন৷ যাঁদের সামর্থ রয়েছে সে রকম অনেক বাবা-মা তাঁদের বাচ্চাদের প্রাইভেট স্কুলে পাঠান৷
ছবি: DW/J.Bruck
স্কুল ড্রেস পরে লেখাপড়া
ইংল্যান্ডে স্কুল ড্রেস ছাড়া কেউ স্কুলে যায় না৷ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ কারণ স্কুল ড্রেস যার যার স্কুলের পরিচয় বহন করে এবং পড়াশোনার প্রতি উৎসাহী করে৷ দরিদ্র পরিবাররের ছেলে-মেয়েরা স্কুল ড্রেসের জন্য স্কুল থেকে টাকা পেয়ে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
খোলা আকাশের নীচে ক্লাসরুম
একটি পাবলিক পার্কে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানের একটি স্কুলে৷ গরিব বাবা-মায়েরা পয়সার অভাবে এমন স্কুলেই তাঁদের সন্তানদের পাঠিয়ে থাকেন৷ পাকিস্তানে শিক্ষা খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে, কারণ সরকার শিক্ষার চেয়ে সামরিক খাতে বেশি খরচ করে৷ যা ছাত্ররাও বুঝতে পারছে৷
ছবি: AP
কমপক্ষে মৌলিক শিক্ষা থাকতে হবে
আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ ও নানা সমস্যার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত৷ বিশেষকরে মেয়েদের ক্ষেত্রে একথাটি বেশি প্রযোজ্য৷ প্রতি দশজনের একজন লিখতে পড়তে পারে সেখানে৷ তবে এ হার পুরুষদের ক্ষেত্রে শতকরা ৪০ জন৷ তাছাড়া স্কুলগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট স্কুলও নেই, অভাব রয়েছে শিক্ষক এবং শিক্ষার সরঞ্জামেরও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত
আফগানিস্তানের মতো প্রায় একই অবস্থা দক্ষিণ সুদানেও৷ এদেশেও মেয়েদের প্রতি পাঁচজনের একজন লিখতে ও পড়তে পারে৷ সেজন্যই বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো সুদানের মেয়েদের শিক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিয়ে থাকে৷ বহু বছরের গৃহযুদ্ধ সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে৷ অনেক স্কুলেই বই-খাতা এবং টেবিল-বেঞ্চও ঠিকমতো নেই৷
ছবি: dapd
কো-এডুকেশন পছন্দ নয়
কো-এডুকেশন? না, ইরানে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়৷ ছেলে এবং মেয়ে আলাদাভাবে পড়াশোনা করে ইরানে৷ এমন কি এই ইহুদি স্কুলেও ইসলামিক স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ এখানে মেয়েরা যে ধর্মেরই হোক না কেন সবাইকেই চুল ঢেকে রাখতে হবে, অর্থাৎ হিজাব পরতে হবে৷
ছবি: AP
ধনী-গরিবের পার্থক্য
ব্রাজিলের গ্রামাঞ্চলের ছাত্রদের জন্য লেখাপড়া করা বেশ কঠিন৷ কারণ সেখানকার স্কুলগুলোতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই৷ যেমন মন্টে আলেগ্রের এই স্কুলটির মতো ৷ যদিও ব্রাজিল শিল্পোন্নত দেশগুলোর একটি, তারপরও এদেশে গরিব এবং ধনীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটা একই রকম
বাংলাদেশের গ্রামের স্কুল এবং রাজধানী ঢাকা শহরের স্কুলের মধ্যে বিশাল পার্থক্য৷ বড় শহরগুলোতে ছাত্ররা কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে৷ আর গ্রামের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কম্পিউটার ব্যবহার করার ইচ্ছা – এখনো স্বপ্ন!
ছবি: Getty Images
13 ছবি1 | 13
জনসাধারণের অর্ধেকই শিশু কিশোর
আফগান জনসাধারণের ৫০ শতাংশ ১৫ বছর ও তারও কম৷ স্কুল শেষ করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ছুটবে৷ তাদের সংখ্যাটা প্রতি বছরই বাড়ছে৷ সেই সময়ের জন্য এখনই প্রস্তুত হতে হবে৷ বলেন কুপ্ফার৷ তাঁর মতে, শিক্ষাক্ষেত্রে মূল্যবোধের পরিবর্তন করা উচিত৷ জার্মানির মতো আফগানিস্তানেও সামাজিক দিক দিয়ে মর্যাদাসম্পন্ন পেশার দিকে ঝুঁকতে চায় অনেকে৷ আর এই কারণে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভিড় বাড়তে থাকে৷ কিন্তু নার্সিং-এর মতো সেবামূলক পেশাগুলিকে উপেক্ষা করা হয়৷ যেখানে এক্ষেত্রে কর্মীর অভাব প্রকট৷
জার্মানির আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা, জিআইজেড আফগানিস্তানে পেশাগত দিকটা দেখাশোনা করছে৷ কাবুলে কর্মরত সংস্থার মুখপাত্র গুস্টাফ রাইয়ারও মনে করেন, আফগানিস্তান অনগ্রসরতা কাটিয়ে উঠে সামনের দিকে বিরাট পদক্ষেপ দিয়েছে৷
তাঁর ভাষায়, ‘‘আমরা কিছুদিন আগে আমাদের কর্মসূচির অন্তর্গত ৫০টি পেশামূলক স্কুল পর্যবেক্ষণ করেছি৷ বিস্ময়ের সাথে অনেক নতুন স্কুল কিংবা নির্মীয়মান স্কুলভবন লক্ষ্য করেছি৷ যেগুলির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই৷''
তালিবানদের ব্যাপারে আশঙ্কা তেমন বড় নয়
এই প্রসঙ্গে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ও তালিবানের উত্থানের সম্ভাবনাও এসে যায়৷ রাইয়ার অবশ্য এ ব্যাপারে তেমন উদ্বিগ্ন নন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখানে জার্মান সেনাবাহিনী আসার আগে থেকেই কাজ করছি৷ আশা করি ২০১৪ সালের পরও এখানে কাজ করতে পারবো৷''
নারীশিক্ষা ও নারী উন্নয়নের ব্যাপারেও আশাবাদী তিনি৷ তালিবান জঙ্গিদের আমলের মতো পরিস্থিতি আর ফিরে আসবে না বলে মনে করেন জার্মান এই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ৷ জনগণই তাদের প্রতিরোধ করবে৷ গত ৩০ বছরে যা হারিয়েছে, সেটা এখন অনুভব করছেন তাঁরা৷