আফগানিস্তানে আরও সৈন্য পাঠানোর ঘোষণা করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ সেইসঙ্গে পাকিস্তানকে কড়া হুঁশিয়ারি দিলেন তিনি৷ তালেবান আফগানিস্তানকে অ্যামেরিকার ‘কবরখানা' করে তোলার পালটা হুমকি দিয়েছে৷
ছবি: Getty Images/M. Wilson
বিজ্ঞাপন
নির্বাচনি প্রচারে বিদেশে মার্কিন সেনাবাহিনী পাঠানোর কড়া সমালোচনা করেছিলেন প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ ক্ষমতায় এলে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের অঙ্গীকারও করেছিলেন তিনি৷ তাঁর সমর্থকরাও সেই অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছিলেন৷ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প এর বিপরীত পথে এগোতে চলেছেন৷ সোমবার এক ভাষণে তিনি বলেন, আফগানিস্তানে তালেবানের বিরুদ্ধে মার্কিন সেনাবাহিনী আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করবে৷ সেই যুদ্ধ জয় করতে আফগানিস্তানে আরও মার্কিন সৈন্য পাঠানো হবে৷ কোনো সংখ্যা ও সময়সীমা ছাড়াই এই কৌশল কার্যকর করা হবে৷ স্থানীয় মার্কিন কমান্ডাররা খুঁটিনাটি বিষয়ে ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপ ছাড়া অভিযান পরিচালনা করতে পারবেন – এমন আশ্বাস দিয়েছেন ট্রাম্প৷
তবে ‘নেশন বিল্ডিং' বা দেশের পুনর্গঠন নয়, সন্ত্রাসবাদীদের হত্যা করতেই এই প্রয়াস, বলেন ট্রাম্প৷ তবে এই সিদ্ধান্তে তাঁর মন যে সায় দিচ্ছে না, সেটাও স্বীকার করেন ট্রাম্প৷ তা সত্ত্বেও সামরিক উপদেষ্টাদের এই প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন তিনি৷ তাঁর এই সিদ্ধান্তের পেছনে আরেকটি কারণ হলো, দ্রুত সৈন্য প্রত্যাহার করলে আফগানিস্তানে সেই শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে আসবে তালেবান ও তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের মতো গোষ্ঠীর সন্ত্রাসবাদীরা৷ মার্কিন জাতীয় স্বার্থে সেটা হতে দেওয়া চলে না৷
সন্ত্রাসবাদীদের শায়েস্তা করার সব দায় অ্যামেরিকা নিজের কাঁধে নিতে প্রস্তুত নয় বলেও হুঁশিয়ারি দেন ট্রাম্প৷ এক্ষেত্রে আফগান সরকার, পাকিস্তান, ভারত ও ন্যাটোর সহযোগী দেশগুলিকেও আরও উদ্যোগ নিতে হবে, বলেন ট্রাম্প৷ দক্ষিণ এশিয়া সংক্রান্ত এক সামগ্রিক কৌশল স্থির করতে চান ট্রাম্প৷ এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের কড়া সমালোচনা করেন তিনি৷ তিনি বলেন, সে দেশে সন্ত্রাসবাদীদের নিরাপদ আশ্রয় সম্পর্কে অ্যামেরিকা আর নীরব থাকবে না৷ পাকিস্তানের প্রতি তাঁর পরামর্শ, মার্কিন প্রশাসনের এই উদ্যোগে শামিল হলে তাদের লাভ হবে৷ সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয় দিয়ে চললে অনেক ক্ষতি হবে৷ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতে, ট্রাম্প পাকিস্তানকে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সহায়তা কমাতে পারেন৷
মার্কিন কর্মকর্তাদের সূত্র অনুযায়ী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস-এর উদ্যোগে আপাতত প্রায় ৪,০০০ মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তানে পাঠানো হবে৷ উল্লেখ্য, এই মুহূর্তে সে দেশে প্রায় ৮,৪০০ মার্কিন সৈন্য মোতায়েন রয়েছে৷
ট্রাম্পের ভাষণের পর তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ পালটা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আফগানিস্তান অ্যামেরিকার আরেকটি কবরখানা হয়ে উঠতে পারে৷ যতদিন দেশে মার্কিন সৈন্য থাকবে, তালেবান তার জেহাদ চালিয়ে যাবে৷
আফগানিস্তানে ক্ষমতার অন্তহীন লড়াই
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান হামলার ১৬ বছর পরও যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটি ইসলামপন্থিদের সন্ত্রাসের কবল থেকে রেহাই পায়নি৷ কূটনৈতিক এলাকায় সাম্প্রতিক হামলাই বলে দিচ্ছে, জঙ্গিরা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী৷
ছবি: picture alliance/Photoshot
কাবুলের সবচেয়ে নিরাপদ এলাকায় হামলা
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে ৩১ মে ভয়ঙ্কর ট্রাক বোমা হামলায় অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছে৷ এবার জঙ্গিরা হানা দিয়েছে কাবুলের ‘গ্রিন জোনে’ অবস্থিত অত্যন্ত সুরক্ষিত কূটনৈতিক এলাকায়৷ হামলায় জার্মান অ্যাম্বাসিরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে৷ কোনো গোষ্ঠী তাৎক্ষণিকভাবে হামলার দায় স্বীকার করেনি৷ তবে তথাকথিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন তালেবান এবং আইএস অতীতে এই শহরে বড় হামলাগুলো করেছিল৷
ছবি: REUTERS/O. Sobhani
অতীতের পুনরাবৃত্তি
কাবুলের কূটনৈতিক এলাকায় এই হামলা দীর্ঘ ধারাবাহিকতারই পুনরাবৃত্তি৷ এর আগে মে মাসেই আইএসের বোমা হামলায় ৮ বিদেশি সৈন্য প্রাণ হারায়৷ এর আগে মার্চে কাবুলের কূটনৈতিক এলাকায় আফগান সামরিক হাসপাতালে হামলায় রোগী-ডাক্তার-নার্সসহ ৩৮ জন নিহত এবং ৭০-এর বেশি আহত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Hossaini
মরিয়া আক্রমণ
গত এপ্রিলে আফগানিস্তানের তালেবানরা সে দেশে থাকা যৌথ বাহিনী এবং আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর উপর আক্রমণ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়৷ জঙ্গি সংগঠনটি বলছে, চলতি বছর তারা আক্রমণের কৌশল বদলেছে৷ ২০১৬ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত মোল্লাহ আখতার মনসুরের নামে তারা এর নাম দিয়েছে, ‘অপারেশন মনসুর’৷
ছবি: Reuters
ট্রাম্পের আফগান নীতি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো তার আফগান নীতি ঘোষণা করেননি৷ আফগানিস্তান বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগলিম্যান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ট্রাম্পের আফগান নীতি অনেক ক্ষেত্রেই ওবামা প্রশাসনের মতোই হবে৷ তাঁর মতে, ওবামার মতো ট্রাম্পও হয়ত তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে সমঝোতার ধারণার পথেই হাঁটবেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J. Ernst
আফগান শান্তি প্রক্রিয়া
কিন্তু তালেবানরা শান্তি আলোচনায় কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না৷ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই জঙ্গি দল সমঝোতার পথে হাঁটবে বলে মনে হচ্ছে না৷ এখন যুদ্ধেই তাদের পূর্ণ মনোযোগ৷ ২০০১ সালের পর এরা এখন সবচেয়ে বেশি জেলা নিয়ন্ত্রণ করছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Shirzad
পাকিস্তানি সহায়তা
আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি গত বছর বলেছিলেন, পাকিস্তান তালেবানকে সমঝোতার টেবিলে আনবে বলে আর আশা করা যাচ্ছে না৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইসলামাবাদ তালেবানকে আফগানিস্তানে ভারতীয় প্রভাব কমাতে ব্যবহার করছে৷ পাকিস্তানি তালেবানের (তেহরিক-ই-তালেবান) সাবেক মুখপাত্র এহসানুল্লাহ এহসান সম্প্রতি ধরা পড়েন৷ তালেবানের ভারত সহায়তা দিচ্ছে– এমন অভিযোগ করার পর ইসলামাবাদ তাকে মাফ করে দেয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/H. Muslim
যুদ্ধবাজ নেতাদের ভূমিকা
তালেবান ছাড়াও আফগানিস্তান জুড়ে রয়েছে নানা গোষ্ঠিগত ও আঞ্চলিক যুদ্ধবাজ নেতা৷ আফগান রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে হেজবি ইসলামির নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার ২০ বছর পর এ বছরের মে মাসে কাবুলে ফিরে আসেন৷ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আফগান সরকার তার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছিল৷ এতে অন্যান্য যুদ্ধবাজ নেতা ও জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো সরকারের সাথে সুসম্পর্ক গড়তে উৎসাহী হবে বলে আশা করেছিল সরকার৷
ছবি: Reuters/O.Sobhani
রাশিয়ার স্বার্থ
বহু বছর নিরাপদ দূরত্বে থাকার পর রাশিয়া আবার আফগানিস্তানে তার যোগাযোগ বাড়াতে শুরু করেছে৷ কিন্তু এই অঞ্চলের সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক অবস্থায় মনে হচ্ছে, রাশিয়া আর আগের মতো দীর্ঘস্থায়ী এই দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকতে চাচ্ছে না৷ গত কয়েক মাসে চীন, পাকিস্তান ও ইরানকে সাথে নিয়ে রাশিয়া বেশ কয়েকটি আফগান-সম্মেলনও করেছে৷
ছবি: picture-alliance/A. Druzhinin/RIA Novosti
অদক্ষ সরকার
ক্ষমতার এই অন্তহীন লড়াইয়ে প্রেসিডেন্ট গনির সমর্থন কেবলই কমছে৷ ব্যাপক দুর্নীতি এবং সরকারে থাকা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ সন্ত্রাস দমনের লড়াইকে দুর্বল করে দিচ্ছে৷