এক বছর আগে আফগানিস্তানে ছেলেদের স্কুল খুলেছিল, কিন্তু মেয়েদের হাইস্কুল নয়। জাতিসংঘের মতে, লজ্জার ঘটনা।
বিজ্ঞাপন
এক বছর হয়ে গেছে মেয়েদের হাইস্কুল খোলেনি আফগানিস্তানে। ইউনাইটেড মিশনস ইন আফগানিস্তান বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, বিশ্বের কোনো দেশে এরকম হয় না। তালেবান কর্তৃপক্ষ এর কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।
জাতিসংঘের দাবি, অবিলম্বে মেয়েদের হাইস্কুল খুলতে হবে। বিবৃতি দিয়ে তারা বলেছে, এক বছর ধরে মেয়েদের হাইস্কুল বন্ধ। তালেবানঅনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তারা তা রাখতে পারেনি। এই ঘটনা খুবই দুঃখের, লজ্জার এবং তা অনায়াসেই এড়ানো যেত।
তালেবান কি মেয়েদের স্কুলে যেতে দেবে?
গত বছর ক্ষমতায় আসার পর তালেবান মেয়েদেরমাধ্যমিক স্কুল বন্ধ করে দেয়। তবে গত কয়েক সপ্তাহে চুপচাপ কয়েকটি স্কুল খুলেছিল।
ক্ষমতা দখলের এক বছর: তালেবান কি কথা রাখছে?
এক বছর আগে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালেবান৷ প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তারা মধ্যপন্থি নীতি পালনের কথা বলায় সারা বিশ্ব অবাক হয়েছিল৷ তাদের মূল অঙ্গীকার ছিল নারীর অধিকার৷ কিন্তু সেই কথা কি তারা রেখেছে?
ছবি: Ali Khara/File Photo/REUTERS
শরিয়তি আইন মেনে নারীর অধিকার
২০২১ সালের আগস্টে ক্ষমতায় এসে তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ শরিয়তি বিধান মেনে নারীর অধিকার রক্ষার কথা বলেছিলেন৷ কিন্তু ডয়চে ভেলের ফ্যাক্ট চেক টিম বলছে, সেটা হয়নি৷ কারণ বাড়ির বাইরে গেলে মেয়েদের আপাদমস্তক ঢেকে রাখতে বলা হয়েছে৷ রাস্তায় বেরিয়ে মুখ না ঢাকলে পরিবারের পুরুষ বাবা, ভাই বা স্বামী সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার আশঙ্কায় থাকছেন৷ পুরুষ অভিভাবক ছাড়া বিমানেও ওঠা যায় না৷
ছবি: Rahmat Gul/AP Photo/picture alliance
মেয়েদের হাইস্কুলে যেতে দিচ্ছে না
তালেবান মুখপাত্র মুজাহিদের দাবি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় মেয়েদের হাই স্কুলে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে৷ অথচ মার্চে একদিন স্কুল খুলেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে মন্ত্রণালয় শিক্ষকের অভাব ও স্কুল ইউনিফর্মের সমস্যাকে সামনে নিয়ে এসেছে৷ তালেবানের দাবি, ইসলামি আইন এবং আফগান সংস্কৃতি মেনে পরিকল্পনা তৈরি হলে মেয়েরা আবার স্কুলে যাবে৷ কিন্তু কোনো বদল হয়নি৷
ছবি: Ebrahim Noroozi/AP/picture alliance
প্রাক্তন শত্রুদের ক্ষমা?
মুজাহিদের দাবি ছিল, ‘‘কোনো প্রতিশোধ নয়৷ ২০ বছর ধরে যুদ্ধ করা হাজারো সেনাকে ক্ষমা করা হয়েছে৷’’ কিন্তু ডিডাব্লিউর ফ্যাক্ট চেক টিম বলছে, এ দাবিও মিথ্যা৷ আফগানিস্তানে জাতিসংঘ বলছে, ২০২১ সালের ১৫ অগাস্ট থেকে ২০২২ সালের ১৫ জুনের মধ্যে তালেবান কর্তৃপক্ষ ১৬০টি বিচারবহির্ভূত হত্যা, ১৭৮টি নির্বিচারে গ্রেপ্তার, ২৩টি আচমকা গ্রেপ্তার এবং প্রাক্তন সরকার ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের নির্যাতনের ৫৬টি ঘটনা ঘটিয়েছে৷
ছবি: WDR
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
তালেবানের ‘সাংস্কৃতিক কাঠামোতে’ হস্তক্ষেপ না করলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বজায় থাকবে বলে জানিয়েছিলেন মুজাহিদ৷ বাস্তবে ক্ষমতায় এসেই ডয়চে ভেলের সাংবাদিকের আত্মীয়কে হত্যা করে তারা৷ ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ জার্নালিস্টস জানিয়েছে, ২০২১-এর সেপ্টেম্বরে তালেবান এবং ন্যাশনাল রেজিস্টেন্স ফ্রন্ট অফ আফগানিস্তানের যোদ্ধাদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন আফগানিস্তানের জাতীয় সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রধান ফাহিম দাশতি৷
ছবি: Ebrahim Noroozi/AP/picture alliance
পরিসংখ্যান কী বলছে
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সালের জুলাই মাসে আফগানিস্তানে নিউজরুমে ১০ হাজার জন কাজ করতেন৷ ডিসেম্বরে কাজ করেছেন চার হাজার ৩৬০ জন৷ তালেবান শাসনের প্রথম তিন মাসে ৫৪৩টির মধ্যে ২৩১টি সংবাদমাধ্যম আচমকা উধাও হয়ে গিয়েছে৷ অধিকার সংস্থাগুলো বলছে, তালেবানদের হাতে সাংবাদিকদের হত্যার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তাদের কাছে নেই৷
ছবি: Ebrahim Noroozi/AP/picture alliance
যা বলছে উল্টো করছে
মার্চ মাসে ডয়চে ভেলে, বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সম্প্রচার বন্ধ করে তালেবান৷ এপ্রিলে এক ডজন সাংবাদিক গ্রেপ্তার হন৷ সাংবাদিকদের নির্বিচারে আটক বন্ধ করার আহ্বান করেছে জাতিসংঘ৷ অথচ ডয়চে ভেলেকে জানুয়ারি মাসে তালেবান মুখপাত্র বলেন, কোনো সংবাদমাধ্যম বন্ধ করেননি৷ তিনি স্বীকার করেন পশ্চিমা গণমাধ্যমকে তালেবানের কিছু নিয়ম মানতে হবে, যাকে পশ্চিমা দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ ভাবতে পারে৷
ছবি: Zerah Oriane/ABACA/picture alliance
মাদক উৎপাদন নয়
ক্ষমতায় এসে তালেবান মুখপাত্র মাদক উৎপাদন না করার অঙ্গীকার করেছিলেন৷ এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে তালেবানকে উদ্যোগী দেখা যাচ্ছে৷ গত এপ্রিলে আফিম চাষ ও ফসল কাটা নিষিদ্ধ করে তারা৷
ছবি: Abdul Khaliq/AP/picture alliance
7 ছবি1 | 7
এএফপি জানাচ্ছে, মেয়েদের হিজাব পরে স্কুলে যেতে দেখা যাচ্ছে। যদিও কয়েকটি এলাকায় তালেবান জানিয়ে দিয়েছে, সরকারি নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
স্থানীয় মিডিয়ায় মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ফুটেজ আসার পর সেই স্কুলগুলিকে আবার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পূর্ব পাকতিয়াতে মেয়েরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, সেই ফুটেজও সামনে এসেছে।
তালেবান মেয়েদের স্কুলে যেতে অনুমতি দেয় কি না, তা জানার জন্য অপেক্ষা করছেন আফগানরা।
এর আগের দুই দশকে আফগানিস্তানে মেয়েদের স্কুলে যেতে দেয়া হতো, তাদের চাকরি করতে দেয়া হতো।
বেশ কিছু তালেবান নেতা জানিয়েছিলেন, মেয়েদের স্কুলে যেতে না দেয়ার বিষয়টি সাময়িক। কিন্তু এখনো সরকারি নীতিতে কোনো বদল ঘটেনি। তারা স্কুল খোলার কোনো সময়সীমাও দেয়নি।
আফগান নারীদের যেসব অধিকার কেড়ে নিয়েছে তালেবান
দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় এসে যুযোপযোগী শাসনব্যবস্থার কথা বললেও একে একে নারীর অনেক অধিকারই কেড়ে নিয়েছে তালেবান৷ ছবিঘরে দেখুন...
ছবি: Wakil Kohsar/AFP/Getty Images
একা একা দূরে নয়
গত ২৬ ডিসেম্বরের নির্দেশনা অনুযায়ী, আফগানিস্তানের নারীরা ৭২ কিলোমিটারের (৪৫ মাইল) চেয়ে বেশি দূরে একা যেতে পারবেন না৷ যেতে হলে সঙ্গে কোনো পুরুষকে রাখতে হবে৷তালেবান মিনিস্ট্রি ফর প্রোপাগেশন অফ ভার্চু অ্যান্ড দ্য প্রিভেনশনস অফ ভাইস এক নির্দেশনায় কোনো চালক যাতে কখনো একা দূরে যেতে আগ্রহী নারীকে গাড়িতে না তোলেন সেই কথাও বলা হয়েছে৷
ছবি: Sayed Khodaiberdi Sadat/AA/picture alliance
গৃহনির্যাতন মেনে নিতে হবে!
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপি-কে বলেছেন, তালেবান মিনিস্ট্রি ফর প্রোপাগেশন অফ ভার্চু অ্যান্ড দ্য প্রিভেনশনস অফ ভাইস-এর নির্দেশনায় গৃহ নির্যাতনের স্বীকার হলেও নারীদের স্বামীর সংসার ছেড়ে না যাওয়ার কথাও বলা হয়েছে৷
ছবি: Safi/Xinhua/imago
টেলিভিশনে, মুভিতে চেহারা দেখানো যাবে না
টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রে নারীদের চেহারা দেখানোও সীমিত করেছে তালেবান৷ এই নির্দেশের ফলে কোনো নারী আর টিভি শো, নাটক বা চলচ্চিত্রে অংশ নিতে পারেন না৷ বিশেষ ক্ষেত্রে অংশ নিলেও নারীকে অবশ্যই হিজাব পরতে হয়৷এক প্রতিবেদনে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স জানিয়েছে, তালেবান ক্ষমতায় আসার পর অনেক নারীই মিডিয়া ছেড়েছেন৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Ariana News
নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয় অবলুপ্ত
২০০১ সালে নারীদের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় খুলেছিল তখনকার সরকার৷২০২১ সালে ক্ষমতায় এসে সেই মন্ত্ণালয় বন্ধ করেছে তালেবান৷ ওপরের ছবিতে কাবুলের এক বেকারির সামনে দরিদ্র নারীদের মধ্যে রুটি বিতরণের দৃশ্য৷ রুটি দিচ্ছেন এক সাধারণ নাগরিক৷
ছবি: Petros Giannakouris/AP/picture alliance
শিক্ষার সুযোগ সীমিতকরণ
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) অক্টোবরের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আফগানিস্তানে প্রাইমারির ওপরে মেয়েদের প্রায় সব স্কুলই বন্ধ করে দিয়েছে তালেবান৷ এর ফলে মেয়েদের উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ কমে গেল৷
ছবি: Bulent Kilic/AFP
নারী-পুরুষ একসঙ্গে নয়
গত আগস্টে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কান্দাহারের দখল নিয়েই সেখানকার বিভিন্ন ব্যাংকে গিয়ে নারীদের বের করে দেয় তালেবান৷পরে অন্যান্য শহরেও নারীদের কর্মস্থল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে তারা৷ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবানের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, তারা মনে করেন, আফগান নারীদের পুরুষদের সঙ্গে বসে কাজ করা উচিত নয়৷
ছবি: TASS/dpa/picture alliance
বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষাক-বিধি
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তালেবানের শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করেন, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী ও পুরুষকে আলাদা বসতে হবে এবং সবাইকে ‘ইসলামি পোশাক’ পরতে হবে৷
ছবি: Javed Tanveer/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
কট্টরপন্থি তালেবানরা স্কুল খোলার জন্য বেশ কিছু অজুহাত দিয়েছে। তারা বলেছে, স্কুলের পাঠক্রম ঢেলে সাজানোর জন্য তাদের অর্থ চাই।
জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল গুতেরেস রোববার টুইট করে বলেছেন, একটা বছর কেটে গেল। জ্ঞান অর্জনের ও পড়ার সুযোগ নষ্টের এক বছর। এই সময়টা আর ফিরে আসবে না। মেয়েদের স্কুলে যেতে দিতেই হবে। তালেবানদের সেই ব্যবস্থা করা উচিত।