আফগানিস্তানে তালেবান, সোনামুখীতে পাগড়ি বিক্রিতে ভাটার টান
২ সেপ্টেম্বর ২০২১৬০-৭০ বছর আগে সোনামুখীর তাঁত শিল্পীরা শুরু করেছিলেন পাগড়ি বোনার কাজ৷ আফগানিস্তান থেকে হিং, গালা বিক্রি করতে এসে তাঁতিদের হাতে বোনা ধুতি, সিল্কের থান দেখে মুগ্ধ হন কাবুলিওয়ালারা৷ নগদ টাকার বিনিময়ে পাগড়ি কেনার প্রস্তাব দেন৷ তারপর থেকে সোনামুখীর তাঁতিরা পাগড়ি তৈরি করছেন৷ এখানকার পাগড়ি সৌদি আরব, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের মাটিতে পৌঁছে যায়৷ রেশমের পাগড়ির দাম দু'হাজার টাকা থেকে শুরু, পলিয়েস্টার পাগড়ি শুরু ৪০০ টাকা থেকে৷ এক সময় খোদ কাবুলিওয়ালারা সেসব পাগড়ি কিনে নিয়ে যেতেন দেশে৷ পাশাপাশি সোনামুখী থেকে পাগড়ি আসতো কলকাতার বড়বাজার এলাকায়৷ সেখান থেকে পৌঁছে যেতো বিদেশের মাটিতে৷ লকডাউনের পর এই ব্যবসায় ভাটা পড়েছে৷ আগে ৭০০-৮০০ তাঁতি পাগড়ি বুনলেও, এখন সংখ্যাটা কমে ২০০-র নীচে এসে ঠেকেছে৷ এমনিতেই করোনা তাঁদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে৷ পাগড়ি বিক্রি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মূলধনে টান পড়েছে৷ এখন তালেবান আফগান দেশ দখল করার ফলে তাঁতশিল্পীরা আরো চিন্তায় পড়েছেন৷ পেটের দায়ে পেশা ছেড়ে দিয়েছেন কেউ কেউ৷ সামনেই পুজো৷ যে সোনামুখীর ৪০ শতাংশ মানুষ তাঁতশিল্পের উপর নির্ভরশীল, সেখানে এই শরতে বিষণ্ণতা৷
তাঁতশিল্পের অন্দরে
সোনামুখীর কৃষ্ণবাজার আর লালবাজার একসময় পাগড়ির পীঠস্থান হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল৷ এখন সেখানে শুধুই হতাশা৷ কথা বলছিলাম কৃষ্ণবাজারের তাঁতশিল্পী সম্পদ পালের সঙ্গে৷ ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি৷ বলেন, ‘‘করোনা আসার পর কাবুল থেকে পাগড়ি নিতে আসাটা কমে গিয়েছিল৷ এবার আফগানিস্তানে তালেবান শাসন শুরু হল, ফলে আমাদের আরও খারাপ অবস্থা! আমরা এখন রেশমের শাড়ি বুনছি৷’’
শাড়িতে কি লাভের মুখ দেখবেন? তিনি বলেন, ‘‘সুতোর দাম যা বেড়েছে তাতে লাভ দূরের কথা, মজুরি পাই না৷ আসলটাও ওঠে না৷ একটা শাড়ির দাম আড়াই হাজার টাকা হলেও বিক্রি করতে হয়েছে দু'হাজারে৷ সংসার চালানোর জন্য অনেককে আর্থিক ক্ষতি করে জিনিস বেচতে হয়েছে৷’’ অথচ ১০ বছর আগে যখন কাবুলিওয়ালারা আসতেন, পুরো বাজার চাঙ্গা হয়ে যেত৷ সেসব দিনের কথা বলতে বলতে উজ্জ্বল হয়ে যায় এলাকার তাঁতশিল্পীদের মুখ৷ কাবুল থেকে ক্রেতারা এসে সমস্ত পাগড়ি কিনে নিতেন নগদের বিনিময়ে৷ কিন্তু পাঠানরা না এলে পাগড়ি কিনবে কে! কাবুলিওয়ালারা যদি না আসেন, তাহলে খুব তাড়াতাড়িই পাগড়ি বোনায় ইতি হয়ে যাবে বলে অনেকে মনে করছেন৷ অনেকে পেটের দায়ে অন্যত্র কাজে যোগ দিয়েছেন, তাঁত ছেড়ে দোকানে কাজও নিয়েছেন অনেকে৷ তাঁতশিল্পী বাপন রজক পেশা থেকে সরে এখন মাছ ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ঘুরে ঘুরে মাছ ব্যবসা করছি৷ আমাদের এসব লাইন নয়৷ তবু কিছু করারও নেই৷ সংসার তো চালাতে হবে৷ বাড়িতে চারজন আছে, পেট চালাতে হবে৷’’ এলাকায় তাঁতশিল্পীদের সংগঠনও নেই যে তারা ভরসা জোগাবে৷ বাপন বলেন, ‘‘এখানে সব গরিব মানুষ৷ দিন আনে দিন খায়৷ সংগঠন করবে কী করে?’’
পাগড়ি তৈরি পুরোপুরি বন্ধ৷ শুধু শাড়ি বুনে সংসার চালানো দায়! ভবিষ্যৎ ভেবে শঙ্কিত অনেক তাঁতশিল্পী৷ তবু সকলে পিতৃপুরুষের পেশা ছাড়তে পারেননি৷ তাঁতশিল্পী দেবমাল্য দত্ত বলেন, ‘‘অনেকেই অন্য পেশায় চলে গেছেন৷ তবে আমি এখনও যাইনি৷ ভবিষ্যতে কী হবে জানি না৷ যেটুকু সঞ্চয় ছিল, সবই শেষ হয়ে গিয়েছে৷ ভবিষ্যতে কী উপায় হবে জানি না৷’’
লকডাউনে কাবুলিওয়ালরা কমই আসতেন৷ এখন তালেবান ঝঞ্ঝায় এই এক-দেড় মাস সব চুপচাপ৷ পাগড়ির ১২ হাত কাপড়ের বদলে এখন সাড়ে ১৩ হাত শাড়ি বুনছেন শিল্পীরা৷ তাতে কাপড় নষ্ট হচ্ছে৷ কিন্তু পেট চালানোর জন্য এছাড়া উপায় নেই৷ শিল্পীরা অভিযোগ করেন, মাস দেড়েকে কাঁচামালের দাম ৮০০-১০০০ টাকা বেড়েছে৷ সেই অনুযায়ী কাপড়ের দাম বাড়েনি৷ সুতোর দাম পেলেও বোনার মজুরি নেই৷ সরকারের দেওয়া চাল, গম মিলিয়ে টেনেটুনে সংসার চলছে তাদের৷ শুধু আশায় বেঁচে আছেন৷ তাঁতশিল্পী রাজু পাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জমানো টাকায় সংসার চলছে৷ পরের দিন বিক্রি হবার আশায় উৎপাদনও করে যাচ্ছি৷ পুরসভায় আবেদন করেছি৷ তারা আশ্বাস দিয়েছে, আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে৷’’ তাঁতশিল্পীদের করুণ অবস্থার কথা ডয়চে ভেলের কাছ থেকে জানতে পারেন রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহা৷ তিনি বলেন, ‘‘ব্যাপারটি দেখা হবে৷ তাঁতশিল্পীরা আসুন, আমাদের সঙ্গে কথা বলুন, আমরা বিষয়টি দেখবো৷’’