গত সপ্তাহে আফগানিস্তানে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের আস্তানা লক্ষ্য করে চালানো মার্কিন হামলায় নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিক ছিল বলে জানিয়েছে আফগান প্রতিরক্ষা দপ্তর৷ তবে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ তথ্য এখনো জানানো হয়নি৷
বিজ্ঞাপন
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর অনুয়ায়ী, আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রাদমানিশ জানিয়েছেন, ‘‘নিহতদের তালিকায় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিকরা রয়েছে৷'' তাঁর কথায়, ‘‘হামলায় নিহত জঙ্গিদের অধিকাংশই পাকিস্তান, ভারত, ফিলিপাইন্স ও বাংলাদেশের৷''
জঙ্গি গোষ্ঠী তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর অবস্থান লক্ষ্য করে ১৩ এপ্রিল যে বোমাটি নিক্ষেপ করা হয়, সেটাকে বলা হয় জিবিইউ-৪৩৷ যার অন্য নাম ‘মাদার অফ অল বম্বস'৷ পারমাণবিক বোমার পর এটাই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বোমা৷ সেদিনের হামলার পর ১৮ এপ্রিল ঐ ঘটনায় নিহতদের জাতীয়তা সম্পর্কে জানান আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র৷ তবে কোন দেশের কতজন নাগরিক নিহত হয়েছে, তা নিশ্চিত করেননি তিনি৷ এছাড়া জঙ্গিদের মধ্যে বাংলাদেশি ছিল কিনা অথবা থাকলে কতজন ছিল, তা অন্য কোনো সূত্র থেকেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি ৷
সহেলি ফিরদৌস
পেন্টাগন এবং আফগান কর্মকর্তারা জানান, ‘হামলায় আইএস-এর শীর্ষস্থানীয় চার কমান্ডারসহ ৯৬ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে৷' মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের মুখপাত্র অ্যাডাম স্টাম্প বলেন, ‘‘বোমাটি এমসি-১৩০ যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষেপ করা হয় আইএস জঙ্গিদের গোপন সুড়ঙ্গ, গুহা ও বাংকারে৷''
বাংলাদেশের পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এআইজি সোহেলী ফেরদৌস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হওয়ার ব্যাপারে আফগান সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি৷ ফলে বিষয়টি আমাদের জানা নেই৷ একমাত্র আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এর উল্লেখ আছে৷ তাই আমরা নিশ্চিত নই যে, সেখানে আদৌ কোনো বাংলাদেশি নিহত হয়েছিল কিনা৷ তাছাড়া এ ধরনের তথ্য ইন্টারপোলের মাধ্যমেও জানানোর বিধান আছে৷ তবে ইন্টারপোলের মাধ্যমে কোনো তথ্য বাংলাদেশ পুলিশকে দেওয়া হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত হতে সময় লাগবে৷''
নূর খান
জঙ্গি বিষয়ক গবেষক এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেক বলেন, ‘‘বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বীজ বপন করেছিল আফগান ফেরত মুজাহিদরা৷ তখন তারা ছিল আল-কায়েদা দ্বারা প্রভাবিত৷ আইএস-এর উত্থানের পর বাংলাদেশ থেকে কিছু তরুণ সিরিয়া ও ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে গিয়ে জিহাদে যোগ দেয়৷ আইএস-এর এখন যে নতুন পরিকল্পনা, তাতে আফগানিস্তানে আইএস-এর সঙ্গে কোনো বাংলাদেশির থাকা নিয়ে তেমন সন্দেহ করার কিছু নেই৷ তাই নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশি থাকতেই পারে৷''
তবে তিনি আরো বলেন, ‘‘আফগানিস্তান কখন তথ্য দেবে তার জন্য বসে না থেকে আমাদেরই উচিত হবে যোগাযোগ করে তথ্য আদায়ের চেষ্টা করা৷ তাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে তাদের আত্মীয়স্বজন যারা বাংলাদেশে আছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলা৷ সার্বিক বিবেচনায় আমাদের নিরাপত্তার জন্যই এটা করা দরকার৷''
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, এ নিয়ে এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানের সঙ্গে অনুষ্ঠানিক যোগাযোগ না হলেও বাংলাদেশ পুলিশ নিহত বাংলাদেশিদের জন্য তথ্য জানতে আগ্রহী৷ আর সেটা কীভাবে জানা যায়, তা নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন৷
‘ইসলামিক স্টেট’ আসলে কী?
আল-কায়েদার অখ্যাত এক উপদল থেকে প্রভাবশালী ‘মিলিট্যান্ট মুভমেন্টে’ পরিণত হয়েছে তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস৷ জিহাদি এই গোষ্ঠীটির দখলে থাকা অঞ্চল থেকে আক্রমণের কৌশল – আইএস-এর এমন নানা দিক তুলে দেয়া হলো এই ছবিঘরে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleiman
আইএস কোথা থেকে এসেছে?
ইসলামিক স্টেট (আইএস) সুন্নী ইসলামিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী আল-কায়েদার একটি উপদল, যেটি আইএসআইএল, আইসিস এবং দায়েশ নামেও পরিচিত৷ ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আক্রমণের পর এটির বহিঃপ্রকাশ ঘটে৷ এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন আবু বকর আল-বাগদাদি৷ জঙ্গি গোষ্ঠীটির লক্ষ্য হচ্ছে ইরাক, সিরিয়া এবং অন্যান্যা অঞ্চল নিয়ে একটি ইসলামিক স্টেট বা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আইএস কোথায় কাজ করে?
বিশ্বের ১৮টি দেশে আইএস সক্রিয় রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷ ইরাক এবং সিরিয়ার কিছু অংশ এই গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং এটি সিরিয়ার রাকা শহরকে রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করে৷ তবে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে এখন অবধি নিজেদের দখলে থেকে এক চতুর্থাংশ এলাকা তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে৷
কারা তাদের বিরুদ্ধে লড়ছে?
আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বেশ কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে৷ বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশের সমন্বয়ে তৈরি মার্কিন নেতৃত্বাধীন একটি ‘কোয়ালিশন’ আইএস অধ্যুষিত এলাকায় বিমান হামলা চালাচ্ছে৷ এই কোয়ালিশনে কয়েকটি আরব দেশও রয়েছে৷ অন্যদিকে সিরিয়া সরকারের পক্ষে সেদেশে বিমান হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া৷ তবে ভূমিতে তাদের বিরুদ্ধে লড়ছে কুর্দিশ পেশমার্গার মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো৷
ছবি: picture-alliance/abaca/H. Huseyin
আইএস-এর অর্থের উৎস কী?
জঙ্গি গোষ্ঠীটির অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে তেল এবং গ্যাস৷ এটি এখনো সিরিয়ার তেল উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ দখলে রেখেছে৷ আর মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিমান হামলার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জঙ্গি গোষ্ঠীর এই মূল্যবান সম্পদ৷ এছাড়া কর, মুক্তিপন এবং লুট করা পুরাকীর্তি বিক্রি করেও অর্থ আয় করে এই জঙ্গি গোষ্ঠীটি৷
ছবি: Getty Images/J. Moore
আইএস কোথায় কোথায় জঙ্গি হামলা চালিয়েছে?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস৷ চলত বছর সবচেয়ে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলাটি চালানো হয়েছে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে, যেখানে দু’শোর বেশি মানুষ নিহত ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে৷ আইএস-এর নেতারা জঙ্গি গোষ্ঠীটির আদর্শে বিশ্বাসীদের এককভাবে বিভিন্নস্থানে আঘাত হানতে উৎসাহ প্রদান করে৷
অন্যান্য আর কী কৌশল ব্যবহার করে আইএস?
নিজেদের ক্ষমতার পরিধি বাড়াতে অনেক কৌশল ব্যবহার করে আইএস৷ জঙ্গি গোষ্ঠীটি ‘কালচারাল ক্লিনজিংয়ের’ নামে সিরিয়া এবং ইরাকের অনেক ঐতিহাসিক শিল্পকর্ম লুট ও ধ্বংস করেছে৷ এছাড়া সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর কয়েকহাজার মেয়েকে ক্রীতদাসী বানিয়েছে৷ গোষ্ঠীটি নিজেদের ‘প্রোপোগান্ডা’ এবং নিয়োগের কাজে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে থাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
শরণার্থী হয়েছেন কতজন?
সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে সেদেশের প্রায় ৬০ লাখ মানুষ প্রতিবেশী লেবানন, জর্ডান এবং তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছেন৷ অনেক সিরীয় ইউরোপেও পাড়ি জমিয়েছেন৷ এছাড়া প্রায় ৩০ লাখ ইরাকে ইরাকের মধ্যেই অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর৷