গর্ভপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে
৩১ মার্চ ২০১৪‘‘আমি গর্ভপাতের জন্য ওষুধ খেয়েছি৷'' নীচু স্বরে বলেন লিনা৷ এতে তাঁর আফসোস নেই৷ কারণ তাঁর আর কেন উপায় ছিলনা৷
‘‘আমার স্বামীকে এক হামলার অভিযোগে জেলে পাঠানো হয়৷ তার আগেই আমি গর্ভধারণ করি৷'' বলেন বছর কুড়ির এই তরুণী৷
‘‘তা না হলে আমার পরিবার লজ্জায় পড়তো৷ সবাই জিজ্ঞাসা করতো, এই বাচ্চা কীভাবে হলো?''
রক্ষণশীল সমাজে টিকে থাকা
লিনা তাঁর আসল নাম নয়৷ প্রকৃত নাম প্রকাশ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়৷ আফগানিস্তানের ছোট্ট এক জায়গায় বসবাস করেন তিনি৷ সেখানকার লোকজন অত্যন্ত রক্ষণশীল৷ স্বামী ছাড়া গর্ভধারণের কোনো গুজব হলেও মুখ দেখানোর অবস্থা থাকে না পরিবারের, হতে হয় একঘরে৷
এ ক্ষেত্রে সাধারণত মেয়েরাই হন ভুক্তভোগী৷ অনিচ্ছাকৃতভাবে সন্তান গর্ভে এলে গর্ভপাত করিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চান বহু মেয়ে৷ ‘‘আমার পরিচিত অনেক মেয়েই এই কাজটি করেছে৷ ডাক্তারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে খাওয়ার পর গর্ভের বাচ্চাটি মারা যায়৷'' বলেন লিনা৷
গর্ভপাত নিষিদ্ধ
যদিও ইসলামি প্রজাতন্ত্র আফগানিস্তানে গর্ভপাত নিষিদ্ধ৷ ব্যতিক্রম হলো, যদি প্রসবকালে মায়ের জীবন বিপন্ন হওয়ার কিংবা বাচ্চাটির গুরুতর প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ এছাড়া গর্ভপাত করালে কারাদণ্ড বা জরিমানা হতে পারে৷ এমনকি ধর্ষণ বা ইন্সেস্ট থেকে সন্তানসম্ভবা হলেও গর্ভপাত করানো যাবে না৷ বলেন পশ্চিম আফগানিস্তানের হেরাট শহরের একটি হাসপাতালের চিকিৎসক মালিকা পাইঘাম৷ মা ও সন্তানের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিলে ইন্টারনাল মেডিসিনের তিন জন ডাক্তার ও একজন গাইনোকোলোজিস্ট প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার পর গর্ভপাত করান৷ এছাড়া এতে ইসলামি উলামা পরিষদ ‘শুরা উলামা'-র অনুমোদনপত্রও লাগে৷
অনেক সময় কোনো উপায় থাকে না
লিনার গর্ভপাত করাও ছিল বেআইনি৷ ‘‘আমি জানি গর্ভপাত হলো সন্তানকে খুন করা৷ কিন্তু আমার তখন একটাই চিন্তা ছিল৷ হয় আত্মহত্যা করতে হবে, নয়তো বাচ্চাটিকে হত্যা করতে হবে৷''
লিনার আরো তিন সন্তান রয়েছে৷ মেয়েদের কাছ থেকে বহু সন্তান আশা করা হয়, বিশেষ করে পুত্র সন্তান৷ কেননা মনে করা হয়, ভবিষ্যতে তাঁরা পরিবারের দায়িত্ব নিতে ও নিরাপত্তা রক্ষা করতে পারে৷ আফগানিস্তানের কঠোর রক্ষণশীল সমাজে ‘জারজ' সন্তান কল্পনাও করা যায় না৷
এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে আফগানিস্তানে জন্মের হার সবচেয়ে বেশি৷ অনেক নারী কম সন্তান চাইলেও শিক্ষার অভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন না তাঁরা৷ জাতিসংঘের শিশু সাহায্য সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী ৭৯ শতাংশ মেয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ করেন না৷ পরিবারকে ছোট রাখার জন্য গর্ভপাতই তাদের একমাত্র ভরসা৷
জীবনের ঝুঁকিও থাকে
অন্যদিকে গর্ভপাত বেআইনি বলে গর্ভপাতের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধাত্রীদের কাছে যেতে হয় তাদের৷ এই সব ধাত্রী প্রায়ই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন৷ রক্তপাত ও জটিলতাকে আয়ত্তে আনতে পারেননা তাঁরা৷ জানান আফগানিস্তানের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র আডেলা মুবাশের৷
অনেক নারী আবার বেসরকারি হাসপাতালে যান গর্ভপাতের জন্য৷ সেখানে খরচও অনেক বেশি৷ বিয়ের আগে যে সব তরুণী অবাঞ্ছিতভাবে গর্ভধারণ করে, তাদের গর্ভপাতের জন্য এই সব হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া অনেক সময় গতি থাকে না৷ জানান এক বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি৷
অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও একটি সুষ্ঠু স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি আফগানিস্তানে৷ গত দশ বছরে মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেলেও সারা বিশ্বে এখনও তা সর্বোচ্চ৷ ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী আফগানিস্তানে প্রতি দুই ঘণ্টায় একজন নারী গর্ভকালীন জটিলতার কারণে মারা যান৷
প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও কর্মীর অভাব
ডক্টর্স উইদাউট বডার্সের সেভেরিন কালুভেয়ার্টস সমালোচনা করে বলেন, ‘‘আফগানিস্তানে চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর অভাব রয়েছে৷ পুরুষ গাইনোকোলজিস্টকে দেখাতে চান না মেয়েরা৷ অন্যদিকে নারী ডাক্তার রয়েছেন খুব কমই৷''
সেভেরিন কালুভেয়ার্টস ও তাঁর সহকর্মীরা এ ব্যাপারে শিক্ষাদানের ওপর গুরুত্ব দেন৷ ‘‘আমরা মেয়েদের স্বাস্থ্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে থাকি৷ কেননা আমরা জানি এতে করে মা ও শিশুর জীবন রক্ষা হতে পারে৷''
আজ লিনাও বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছেন৷ তাঁর দাবি, সমাজের এই সমস্যার ব্যাপারে আরো সচেতনতা বাড়াতে হবে৷ তিনি আশা করেন, ‘‘দেশের গণমাধ্যম ও ইসলামি কর্তৃপক্ষ জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আরো সোচ্চার হবেন৷ সমাজের ট্যাবুর কারণে এতো গর্ভপাত আর ঘটবে না৷''