ভারতের উদ্যোগে আফগানিস্তান নিয়ে প্রথম বড় বৈঠক। যোগ দিল রাশিয়া, ইরান সহ আট দেশ। পাকিস্তান, চীন যোগ দেয়নি।
বিজ্ঞাপন
আনুষ্ঠানিক নাম, দ্য দিল্লি রিজিওনাল সিকিউরিটি ডায়লগ, সংক্ষেপে দিল্লি ডায়লগ। বিষয় আফগানিস্তান। ভারতের উদ্যোগে আফগানিস্তান নিয়ে এই প্রথম অনেকগুলি দেশকে নিয়ে দিল্লিতে বৈঠক হলো। বুধবার এই বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন রাশিয়া, ইরান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, তুর্কেমেনিস্তান এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা(এনএসএ)। আমন্ত্রণ সত্ত্বেও আসেননি পাকিস্তান ও চীনের এনএসএ। চীন জানিয়েছে, এই সময়ে তাদের আসা সম্ভব নয়। আর পাকিস্তান বলেছে, যারা আফগানিস্তানের পরিস্থিতি খারাপ করেছে, তারাই এখন এই ধরনের বৈঠক করছে, সেখানে যোগ দেয়ার প্রশ্ন নেই।
চীন ও পাকিস্তানের মনোভাব থেকে স্পষ্ট, তালেবান শাসিত আফগানিস্তান নিয়ে ভারত কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করুক, তা তারা চায় না। এমনিতে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের কোনো সীমান্ত নেই। তা সত্ত্বেও কেন ভারত এই বৈঠক ডেকেছে, তা বৈঠকের গোড়াতেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন অজিত দোভাল। তিনি বলেছেন, ''আফগানিস্তানে কিছু ঘটলে তার প্রভাব পুরো অঞ্চলে পড়ে। তাই এই অঞ্চলের দেশগুলির আফগানিস্তান নিয়ে ঘনিষ্ট সহযোগিতা দরকার। এটাই হলো আফগানিস্তান নিয়ে আলোচনা করার জন্য সব চেয়ে ভাল সময়।''
এর আগে রাশিয়ার উদ্যোগে আফগনিস্তান নিয়ে দুইটি বৈঠক হয়েছে। সেই পথ ধরেই ভারতের এই উদ্যোগ। সাতটি দেশের এনএসএ বা নিরাপত্তা উপদেষ্টারা মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গেও দেখা করেছেন এবং কথা বলেছেন।
দিল্লি ঘোষণাপত্র
আট দেশ এই বিষয়ে একমত হয়েছে যে, আফগানিস্তানে সার্বভৌমত্ব, স্থায়িত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান জানানো হবে। তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করা হবে না। আফগানদের দুর্দশা নিয়েও চিন্তা প্রকাশ করেছে আট দেশ। সেই সঙ্গে কাবুল, কান্দাহার, কুন্দুজে বিস্ফোরণ ও জঙ্গি হামলার নিন্দা করা হয়েছে। এই অঞ্চলে মাদক পাচার, সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ রুখতে সকলে সমন্বয় করে চলবে বলেও ঘোষণাপত্রে জানানো হয়েছে।
অন্য দেশের মত
দিল্লির কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে তাজিকিস্তানের বক্তব্যে। সেদেশের সিকিউরিটি কাউন্সিলের সেক্রেটারি রহমতজন মাহমুদজোদা বলেছেন, ''আমরা আফগানিস্তানের মানুষের স্বার্থে তাদের সাহায্য করতে এই ধরনের বৈঠকে সবসময় যোগ দেব।''
তুর্কেমেনিস্তান জানিয়েছে, তাদের উদ্বেগ মাদক-পাচার নিয়ে। তাছাড়া তারা মানবিক কারণে আফগান জনগণের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলি বলে আসছে, কাবুল হলো মাদক পাচারের স্বর্গরাজ্য। ভারতের অভিযোগ, আফগানিস্তন থেকে পাকিস্তান হয়ে মাদক ভারতে আসে। কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান সুমিত দত্ত মজুমদার এর আগে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান হয়ে মাদক ভারতে আসে এবং তারপর তার সিংহভাগ ইউরোপে পাচার হয়। তালেবান শাসন শুরু হওয়ার পর তাই দেশগুলি মাদক পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে।
আফগানিস্তানকে ঘিরে চীন, পাকিস্তান, ভারতের নতুন ‘লড়াই’
লড়াইটা বেশি চলছে পর্দার আড়ালে৷ এ লড়াইয়ে পাকিস্তান আর চীন এ মুহূর্তে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায়৷ তবে তালেবান ফিরে আসায় দুর্ভাবনায় পড়লেও ভারতও হাল ছাড়ছে না৷ ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: Hoshang Hashimi/AFP
তালেবান-পাকিস্তান সম্পর্ক
তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের সম্পর্ক সবসময়ই বেশ ভালো৷ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তালেবানকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সহায়তার অভিযোগ উঠেছে বহুবার৷ গনি সরকারবিরোধী যুদ্ধে তালেবানকে সহায়তার অভিযোগও আছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে৷ পাকিস্তান অবশ্য সে অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷ ওপরের ছবিতে পাকিস্তানের খাইবার জেলার আফগানিস্তান সংলগ্ন তোরখাম সীমান্তে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছে তালেবান ও পাকিস্তানের সেনারা৷
তালেবান প্রায় পুরো আফগানিস্তানের দখল নেয়ায় পাকিস্তানে নানা পর্যায় থেকে ব্যাপকভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়েছে৷ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, তালেবানের আগমনে আফগানিস্তান ‘দাসত্বের শৃঙ্খলমুক্ত হলো’৷
ছবি: Saiyna Bashir/REUTERS
পাকিস্তানে উচ্ছ্বাসের কারণ
নিউইয়র্কের ইথাকা কলেজের শিক্ষক রাজা আহমেদ রুমি বলেন, ‘‘পাকিস্তানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং টেলিভিশনে যে উল্লাস দেখা গেছে তার মূল কারণ আফগানিস্তানের ওপর ভারতের যে প্রভাব গড়ে উঠেছিল তা দূর হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়া৷’’ ১৯৪৭-এর পর থেকে ভারত এবং পাকিস্তান যে নিজেদের মধ্যে তিনবার বড় যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং সে কারণে পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে যে ভারতবিরোধী মনোভাব কাজ করে তা-ও মনে করিয়ে দেন তিনি৷
ছবি: Rahmat Gul/AP/picture alliance
সম্পর্ক আরো ভালো করার চেষ্টা
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তালেবানের সরকারের রূপরেখা তৈরির কাজে অংশ নিচ্ছেন পাকিস্তানের কয়েকজন কর্মকর্তা৷ এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, পাকিস্তান চায় আফগানিস্তানে অংশগ্রহণমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক৷ তবে এ ক্ষেত্রে আফগান নাগরিকদেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: AFP via Getty Images
‘সময়মতো’ এগিয়ে এসেছে চীন
চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক দীর্ঘদিনের৷ অন্যদিকে ভারত-চীনের বৈরিতাও চলছে দীর্ঘদিন ধরে৷ ফলে তালেবানের আগমনে সেখানে ভারতের প্রভাব কমবে বলে চীনও খুশি৷ চীন বলছে, তালেবানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো রাখা জরুরি, কারণ, তালেবান শিনজিয়াং অঞ্চলকে ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম) জঙ্গি সংগঠনের প্রভাবমুক্ত রাখার কাজে সহায়তা করতে পারবে৷
ছবি: Li Xueren/Xinhua News Agency/picture alliance
তালেবান প্রশ্নে চীন-ভারতের মিল!
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তালেবানের সার্বিক ক্ষমতাবৃদ্ধির প্রশ্নে চীন আর পাকিস্তানের অবস্থান বাস্তবে এক নয়৷ সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ-এর অধ্যাপক ঝ্যাং লি-ওর মতে, ‘‘পাকিস্তান যেমন আফগানিস্তানকে ভারতবিরোধী অবস্থানে দেখতে চাইবে, চীনের বেলায় এমন দৃষ্টিভঙ্গি অত্যাবশ্যক নয়৷ চীন সবার আগে চায় শিনজিয়াং অঞ্চলে কোনোভাবেই যাতে সন্ত্রাসবাদ বিস্তার লাভ না করে৷’’
ছবি: Reuters
চীনের ‘অস্বস্তি’
চীনের বিরুদ্ধে রয়েছে মুসলিম নিপীড়ন, বিশেষ করে উইগুরদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালানোর সুদীর্ঘ অভিযোগ৷ বেইজিং এ অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে সব সময়৷তালেবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হলেও এ বিষয়টি দু পক্ষের মধ্যে অস্বস্তি হয়ে থাকবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা৷
ছবি: Emrah Gurel/AP Photo/picture alliance
চীনের কাছে তালেবানের প্রত্যাশা
দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর অধ্যাপক ব্রহ্মা চেলানি মনে করেন, আফগানিস্তানে নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠার পর থেকে দু ধরনের সহায়তা জরুরি ভিত্তিতে চাইছে তালেবান৷ এক, তালেবান সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে কূটনৈতিক সহায়তা, দুই, অবকাঠামো নির্মাণ এবং সার্বিক অবস্থার উন্নয়নে অর্থনৈতিক সহায়তা৷ অধ্যাপক ব্রহ্মার মতে, চীন দুই ধরনের সহায়তা দিতেই এখন পুরোপুরি প্রস্তুত৷
ছবি: Hoshang Hashimi/AFP
সন্ত্রাসবাদে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা এবং ভারতের আশঙ্কা
ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানে ঢুকে হত্যা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী৷ ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয় আফগানিস্তানের কান্দাহারে৷ পাকিস্তানি তিন জঙ্গিকে জেল থেকে মুক্তি দেয়ার বিনিময়ে বিমানের যাত্রীদের ফেরত পেয়েছিল ভারত৷ অন্যদিকে বিমান ছিনতাইকারীদের নিরাপদে পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল তালেবান৷ আবার যাতে এমন ঘটনা না ঘটে তা নিশ্চিত করতে চায় ভারত৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ভারতের আরেক আশঙ্কা
গত ২০ বছর আশরাফ গনি সরকারের পাশে ছিল ভারত৷ এ সময়ে আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশেই উন্নয়নমূলক নানা ধরনের প্রকল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে দেশটি৷ কাবুলে জাতীয় সংসদ ভবনও তৈরি হয়েছে ভারতের অর্থায়নে৷ মোদী সরকারের আশঙ্কা, তালেবান ক্ষমতায় আসায় সমস্ত বিনিয়োগ ‘ভেস্তে’ যেতে পারে৷
ছবি: courtesy PIB, Gov. of India
ভারতের কৌশলগত ভুল
যুক্তরাষ্ট্র যখন তালেবানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে, তখনো ভারত পুরোপুরি এবং শুধুই আশরাফ গনি সরকারের পাশে থেকে কৌশলগত ভুল করেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন৷ তাদের মতে, তালেবান একে একে আফগানিস্তানের সব রাজ্য দখলে নিতে শুরু করার পরও যে ভারত তালেবানবিরোধী বক্তব্যে অটল ছিল কূটনৈতিকভাবে তা-ও এখন ভুল প্রমাণিত৷
ছবি: courtesy PIB, Gov. of India
চীন, পাকিস্তান সুবিধাজনক অবস্থানে, তবু আশাবাদী ভারত
তালেবান ফেরায় আফগানিস্তানে পাকিস্তান এবং চীনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা স্পষ্টতই উন্মুক্ত৷ তবে ভারত একটু দেরিতে হলেও পরিস্থিতি বুঝে কৌশল পরিবর্তন করেছে৷ কাবুলে এক সময় ভারতের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা জয়ন্ত প্রসাদ মনে করেন, ভারত এখন সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ‘লং গেম’ খেলবে, অর্থাৎ লম্বা সময় নিয়ে চেষ্টা করবে এবং তাতে তালেবানের সঙ্গে একটা সমঝোতার সম্পর্ক গড়া হয়ত সম্ভবও হবে৷
ছবি: Tolga Akmen/AFP
12 ছবি1 | 12
তবে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র টুইট করে জানিয়েছেন, আফগান প্রতিনিধিদল বুধবার পাকিস্তান পৌঁছেছে। তারা পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এর আগে মস্কো ও কাবুলে আফগানিস্তান নিয়ে যে আলোচনা হয়েছিল, সেটাকেই আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং মানবিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক বিষয়গুলি নিয়ে কথা হবে।
প্রবীণ সাংবাদিক আশিস গুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''ভারত বৈঠকে চীন ও পাকিস্তানকে ডেকেছিল। তারা আসেনি। পাকিস্তান এখন দেখাতে চাইছে, আফগানিস্তানের বিষয়ে তারাই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। তালেবান নেতাদের সবসময়ই সমর্থন করছে পাকিস্তান। তালেবান নেতারা পাকিস্তানে থেকেছেন। ইসলামাবাদ এখন জাহির করতে চাইছে, ভারত নয়, তারাই এব্যাপারে সব চেয়ে প্রভাবশালী দেশ।'' আর আশিস মনে করেন, ''ভারত এই পরিস্থিতিতে চুপ করে বসে থাকতে পারে না। তাই ভারতও বৈঠকে উদ্যোগী হয়েছে। সেই বৈঠকে রাশিয়া ও ইরানের যোগদান নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।''