জঙ্গি প্রতিরোধে আফগান সীমান্তে বেড়া দেয়ার কাজ শুরু করেছে পাকিস্তান৷ তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফগান এবং পাকিস্তানি পশতুনদের মধ্যে যে দৃঢ় সাংস্কৃতিক বন্ধন রয়েছে, তাতে এই উদ্যোগ বিফল হবে৷
বিজ্ঞাপন
আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে আরও একধাপ এগিয়ে গেল পাকিস্তান৷ শনিবার তারা জানিয়েছে, পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে তারা বেড়া দেয়া শুরু করেছে৷ ইসলামাবাদ বলছে, আফগানিস্তান থেকে যেসব ইসলামি জঙ্গি তাদের দেশে এসে হামলা চালায়, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তেই এই উদ্যোগ নিয়েছে তারা৷
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়া শনিবার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের আদিবাসী এলাকা সফর করে বেড়া নির্মাণের ঘোষণা দেন৷ ঐ এলাকাটিকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি৷ তবে এই ঘোষণায় কেবল আফগানিস্তান নয়, পাকিস্তানের পশতু ভাষীরাও নিন্দার ঝড় তুলেছেন৷
প্রতিদিন লাখো আফগান ও পাকিস্তানি ড্যুরান্ড সীমান্ত অতিক্রম করে, যেটি পাক-আফগান সীমান্তের ২,৪৩০ কিলোমিটার সীমান্ত রেখা৷ তবে আফগান সরকার ওই রেখাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আফগান-পাকিস্তান সীমান্ত বলে স্বীকার করেনি৷ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমেই খারাপ হওয়ায় এবার পশতুনদের জন্য একটা অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে৷ ইসলামাবাদ এরইমধ্যে দুই দেশের মধ্যকার সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেছে৷ চলতি বছরের মার্চের ৭ তারিখে এখানকার পাক-আফগান সীমান্তটি সাময়িকভাবে তারা খুলে দিয়েছিল৷ ফেব্রুয়ারিতে জঙ্গি হামলায় বেশ কিছু সাধারণ মানুষ নিহতের পর ওই সীমান্ত বন্ধ করেছিল ইসলামাবাদ৷ আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাজিব দানিশ সংবাদ সংস্থা এপিকে বলেছেন, সীমান্তে বেড়া দেওয়ার বিষয়ে কিছুই জানে না আফগান কর্তৃপক্ষ৷ এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হলে আফগানিস্তান তা যে কোনো উপায়ে প্রতিরোধ করবে৷
পাকিস্তান: অগুনতি সন্ত্রাসী হামলার একটি দশক
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সঙ্গীদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে যোগ দেয়ার পর, চড়া মূল্য দিতে হয়েছে পাকিস্তানকে৷ উগ্রপন্থিদের হাতে দেশটির কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে ইতিমধ্যেই৷ ছবিঘরে দেখুন সেই মর্মান্তিক কাহিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/A Majeed
২০০৭ – সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাবর্তনের দিন করাচিতে হামলা
২০০৭ সালের ১৮ অক্টোবর করাচিতে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর গাড়িবহরে জোড়া বোমা হামলার ঘটনা ঘটে৷ সে সময় দীর্ঘ আট বছর পর দেশে ফিরছিলেন তিনি৷ হামলায় বেনজির বেঁচে গেলেও, প্রাণ হারায় ১৩৯ ব্যক্তি৷ কিন্তু এর মাত্র দু’মাস পর, ২৭ ডিসেম্বর, রাওয়ালপিন্ডিতে অপর এক হামলায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন পাকিস্তানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/N. Khawer
২০০৮ – ওয়াহ বোমা হামলা
ওয়াহ-তে অবস্থিত ‘পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিস’-এ জোড়া আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ হারায় ৬৪ ব্যক্তি৷ ২০০৮ সালের ২১ আগস্টের সেই হামলাই এখনও পর্যন্ত পাকিস্তানে কোনো সামরিক স্থাপনায় সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘তাহরিক-ই-তালেবান’ (টিটিপি) সে সময় ঐ হামলার দায় স্বীকার করেছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Khan
২০০৮ – রাজধানীর হোটেলে সন্ত্রাসী হামলা
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত মারিয়ট হোটেলে বিস্ফোরকভর্তি ট্রাক দিয়ে হামলা চালানো হয়৷ ২০০৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের সেই হামলায় প্রাণ হারায় কমপক্ষে ৬০ ব্যক্তি, আহত ২০০৷ হতাহতদের মধ্যে ২০ জন বিদেশিও ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Matthys
২০০৯ – পেশোয়ারে হামলা
পাকিস্তানের পেশোয়ারে নারী ও শিশুদের বাজার হিসেবে পরিচিত ‘মিনা বাজারে’ একটি গাড়ি বোমা হামলায় ১২৫ ব্যক্তি নিহত ও ২০০ ব্যক্তি আহত হয়৷ পাকিস্তান সরকার এই হামলার পেছনে তালেবান জড়িত বলে দাবি করলেও, জঙ্গি গোষ্ঠী তালেবান এবং আল-কায়দা – উভয়েই সেই হামলার দায় অস্বীকার করে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A Majeed
২০১০ – ভলিবল ম্যাচে আত্মঘাতী হানা
পাকিস্তানের বানুর একটি গ্রামে ভলিবল খেলা চলাকালে আত্মঘাতী হামলায় প্রাণ হারায় ১০১ ব্যক্তি৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Azam
২০১১ – চারসাদার পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে হামলা
পাকিস্তানের খাইবার পাকতুনখার চারসাদা জেয়া একটি পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে জোড়া বোমা হামলায় ৯৮ ব্যক্তি নিহত ও ১৪০ জন আহত হয়৷ ২০১১ সালে ১৩ মে ক্যাডেটরা যখন প্রশক্ষিণ শেষে দশদিনের ছুটিতে নিজ নিজ বাড়ি যাওয়ার পথে বাসে উঠছিল, তখন হামলার ঘটনাটি ঘটে৷ বলা হয়ে থাকে, ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেই নাকি ঐ হামলা চালায় তালেবান৷
ছবি: Getty Images/AFP/H. Ahmed
২০১৩ – পেশোয়ারে চার্চে বোমা হামলা
২০১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পেশোয়ারের ‘অল সেইন্ট চার্চে’ জোড়া আত্মঘাতী হামলায় ৮২ ব্যক্তি প্রাণ হারায়৷ ‘তাহরিক-ই-তালেবান’ বা টিটিপি সংশ্লিষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠী জুনদাল্লাহ সেই হামলার দায় স্বীকর করে৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Khan
২০১৪ – পেশোয়ারে স্কুলে হত্যাযজ্ঞ
২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর টিটিপি-র সাতজন বন্দুকধারী পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে হামলা চালায়৷ তারা ১৫৪ ব্যক্তিকে হত্যা করে, যাদের মধ্যে ১৩২টি শিশু ছিল৷ পাকিস্তানের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা৷
ছবি: AFP/Getty Images/A Majeed
২০১৫ – করাচিতে বাসে হামলা
২০১৫ সালের ১৩ মে আটজন বন্দুকধারী করাচিতে একটি বাসে হামলা চালিয়ে ৪৬ ব্যক্তিকে হত্যা করে৷ নিহতদের সবাই শিয়া মুসলমান ছিল৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করে জুনদাল্লাহ বা ‘আল্লাহ-র সেনা’ নামের জঙ্গি গোষ্ঠী৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
২০১৬ – হাসপাতালে বোমা হামলা
চলতি বছরের ৮ আগস্ট পাকিস্তানের কোয়েটায় সরকারি হাসপাতালে আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং গুলিতে ৭০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়৷ নিহতদের অধিকাংশই আইনজীবী, যাঁরা অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত বেলুচিস্তান বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিলাল আনওয়ার কাসির মরদেহ নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Khan
10 ছবি1 | 10
বিশেষজ্ঞদের মত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফগান ও পাকিস্তানের পশতুনদের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা অনেক৷ তাই যে কোনো সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এখানে ধোপে টিকবে না৷ এছাড়া দু'দেশের হোটেল ব্যবসা, যাতায়াত ক্ষেত্রে অনেকের ভাগ্য জড়িয়ে রয়েছে৷ সম্প্রতি এমন অনেক ব্যবসায়ীর পরিচয়পত্র নবায়ন করতে রাজি হয়নি পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ৷
সন্ত্রাসবাদ এবং বাণিজ্য
আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলের কুনার প্রদেশে সীমান্তবর্তী এলাকায় থাকেন জুমা খান৷ তিনি জানিয়েছেন, পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষীরা সেই অঞ্চলে প্রায়ই বোমা নিক্ষেপ করে৷ এদের কারণে তারা স্বাধীনভাবে এলাকায় চলাচল করতে পারেন না বলে ডয়চে ভেলের কাছে অভিযোগ করেন তিনি৷ প্রতি বছর ড্যুরান্ড সীমান্ত দিয়ে দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য হয়৷ এছাড়া অবৈধ দ্রব্যের বাণিজ্য এবং পাচার তো হয়ই৷
বিখ্যাত কবি সুলেমান লায়েক ডয়চে ভেলেকে বলেন, সীমান্তে বেড়া দেয়া হলে দুই দেশের মধ্যে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না৷ বেড়া দেয়ার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই সরকারের হতে পারে না, বরং ঐসব এলাকার পশতুনরা সেই সিদ্ধান্ত নেবে৷ কারণ এটা কেবল তাদেরই অধিকার, যারা এসব এলাকায় বসবাস করে৷
দুর্নীতি ঠেকাতে কাবুলের দেয়ালে গান্ধীর ছবি
রাজধানী কাবুলের সরকারি ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এমনকি দূতাবাস সব ভবনে দেয়ালচিত্র বা গ্রাফিটি আঁকছেন আফগান শিল্পীরা৷ তাঁরা নিজেদের ‘আফগান ব্যাঙ্কসি’ বলতে পছন্দ করেন৷ ছবিঘরে থাকছে তাদের গ্রাফিটিগুলো৷
ছবি: DW/M. Bernabe
আফগান রাজধানীতে পথ শিল্প
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং দূতাবাসের দেয়ালগুলো বিস্ফোরণ প্রতিরোধক কংক্রিট দিয়ে তৈরি৷ সেই দেয়ালগুলোতে গ্রাফিটি আঁকছেন আফগান শিল্পী ও অধিকার কর্মীরা৷ ব্রিস্টল এর বিখ্যাত গ্রাফিটি শিল্পী ব্যাঙ্কসি-র অনুকরণে নিজেদের নাম দিয়েছেন ‘আফগান ব্যাঙ্কসি’৷ গ্রাফিটিতে সাধারণত সামাজিক সমস্যা ও যুদ্ধের ক্ষত তুলে ধরছেন তারা৷
ছবি: DW/M. Bernabe
শিল্পীর তুলি যখন হাতিয়ার
গ্রাফিটি কাবুলে দেখাই যায় না৷ এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা ওমাইদ শরিফ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘যখন আমরা এখানকার জনগণকে আমাদের কাজ সম্পর্কে অবহিত করি, তারা খুশি হয়৷ তাদের হাতে রং-তুলি ধরিয়ে দেই এবং ম্যুরালগুলো শেষ করতে তাদের সাহায্য চাই৷’’
ছবি: DW/M. Bernabe
ক্ষমতা, দুর্নীতি এবং অসত্য
বেশিরভাগ গ্রাফিটির মধ্যে চোখ খুব গুরুত্ব পেয়েছে৷ এখানে মহাত্মা গান্ধীর চোখ এঁকেছেন তারা৷ এমনভাবে গ্রাফিটি আঁকা হয়েছে, মনে হয় পথচারী থেকে প্রত্যেকটা মানুষের উপর নজর রাখছেন তিনি৷ গ্রাফিটিতে প্রধানত তুলে ধরা হয় দুর্নীতির চিত্র এবং তা নির্মূলে আহ্বান জানানো হয়৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তালিকা অনুযায়ী আফগানিস্তান অন্যতম দুর্নীতিবাজ দেশ৷
ছবি: DW/M. Bernabe
সরাসরি বার্তা দেয়া
‘বাবা, এই গাড়ি কেনার টাকা তুমি কোথায় পেয়েছো?’ গ্রাফিটিতে এই প্রশ্ন করছে এক ছেলে৷ প্রথম ম্যুরালটি আঁকা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভবনের দেয়ালে৷ যাতে সরাসরি সবার কাছে এই বার্তা পৌঁছে যায়৷
ছবি: DW/M. Bernabe
আফগানিস্তান শরণার্থী
২০১৫ সালে ইউরোপে দশ লাখ শরণার্থীর ২০ ভাগ এসেছে আফগানিস্তান থেকে৷
ছবি: DW/M. Bernabe
শরণার্থী চুক্তি
অক্টোবরে আফগান সরকারের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শরণার্থী নেয়া সংক্রান্ত একটি চুক্তি হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Bernabe
অর্থনীতির চিত্র
আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সৈন্য চলে যাওয়ার পর অনেক মানুষ চাকরিহীন হয়ে পড়ে৷ কেননা তাদের অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল যুদ্ধের ভিত্তিতে৷
ছবি: DW/M. Bernabe
নিরক্ষরতা
নিরক্ষরতার দিক দিয়ে বিশ্বে উঁচুতে অবস্থান আফগানিস্তানের৷ বয়স্ক মানুষদের মধ্যে অক্ষরজ্ঞান আছে মাত্র ৩১ ভাগ মানুষের৷
ছবি: DW/M. Bernabe
8 ছবি1 | 8
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷