নিজের দেশে গান-বাজনা নিষিদ্ধ, শাস্তিযোগ্য অপরাধ! কিন্ত নির্বাসিত জীবন মানতে বাধ্য হলেও আফগানিস্তানের কিছু তরুণ গানে গানে ইউরোপে ছড়িয়ে দিচ্ছেন মুক্তিকামীদের যন্ত্রণা আর প্রতিরোধ গড়ার কথা৷
২০২৩ সালে জার্মানির বন শহরে এসেছিলেন আফগান ইয়ুথ অর্কেস্ট্রার সদস্যরা৷ ইরানের সংগীতশিল্পীদের সঙ্গে বিঠোফেনফেস্টে ডয়েচে ভেলের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তারা৷ ছবি: Jennifer Taylor
বিজ্ঞাপন
২০২১ সালের আগস্ট মাসে আফগানিস্তানের দুঃখের দিনের শুরু, মনে করেন অনেকেই৷ দেশটির শাসক হিসেবে ফের ক্ষমতায় আসে তালেবান, আর ‘আফগান ইয়ুথ অর্কেস্ট্রা'র সম্পূর্ণ দলটি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়৷ গত চার বছরে আফগানিস্তান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মিউজিক (এএনআইএম)- এর তরুণ সংগীতশিল্পীরা তাদের নতুন ঘর খুঁজে পেয়েছেন পর্তুগালে৷ বার্লিনের ‘ইয়ং ইউরো ক্লাসিক ফেস্টিভ্যালের' তারা অন্যতম অতিথি৷
‘‘বাদ্যযন্ত্র তৈরি, বাজানো বা গান করা আফগানিস্তানে সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ৷'' ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন আহমদ সরমস্ত৷ তিনি এএনআইএমের প্রতিষ্ঠাতা ও মুখ্য আধিকারিকও বটে৷ আরো জানিয়েছেন, ওই সংগীত শিক্ষাভবনটির সঙ্গে যুক্ত ২৭৩ জনকে আফগানিস্তান ছাড়তে সাহায্য করেছেন তিনি৷ কাবুলে তার স্কুলটি অবশ্য মাটিতে মিশে গিয়েছে৷ ভাঙচুর করা হয়েছে স্কুলের বাদ্যযন্ত্রগুলিকেও৷
‘‘গানবাজনা মানুষের মৌলিক অধিকার৷ আফগানিস্তানের মানুষের আর সেই অধিকার নেই,'' তিনি জানান৷ তার কথায়, ‘‘আমার দেশ এখন নীরব একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে৷''
তালেবান শাসনে নারীরা ‘অদৃশ্য’
02:10
This browser does not support the video element.
নির্বাসনেও বেঁচে রয়েছে আফগান সংগীত
তবে নির্বাসনেও বেঁচে রয়েছে আফগান সংগীত৷ ইয়ং ইউরো ক্লাসিকের মতো বার্ষিক অর্কেস্ট্রার অনুষ্ঠানে শতাধিক তরুণ সংগীতশিল্পী, গায়ক, বাদক যোগ দেন৷ ইউরোপীয় ও অ-ইউরোপীয় শিল্পীর কাছেও যায় আমন্ত্রণ৷ এই অনুষ্ঠানের কার্যনির্বাহী ক্যারোলাইন ট্রিসপেলের মতে, ‘‘সংগীতই এই উৎসবের প্রাণকেন্দ্র৷ প্রতিটি দেশ কীভাবে নিজেদের দেশজ সংগীতকে দেখে, এই অনুষ্ঠান তারই প্রকাশ৷''
তার কথায়, এই সমস্ত তরুণ শিল্পীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাদের গান ও বাজনার জন্য একটা প্ল্যাটফর্মও বলা যেতে পারে এই উৎসবকে৷ এ বছর আফগান শিল্পীদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন বলিভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, গাম্বিয়ার মতো দেশের শিল্পীরাও৷ উত্তর স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সামি জনজাতির শিল্পীরাও যোগ দেবেন৷ পেশ করবেন তাদের সংগীত৷
বিজ্ঞাপন
নিষিদ্ধ সংগীত যেন কণ্ঠ খুঁজে পেল...
নিজেদের দেশে যে সংগীত নিষিদ্ধ, তাই গাওয়া হবে এখানে৷ উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সামি জনজাতির ‘ইয়োয়িক' গাওয়া অষ্টাদশ শতক থেকে বিংশ শতাব্দি পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়৷ বলা হত, এটি অখ্রিস্টীয়, তাই গাওয়ার অনুমতি নেই৷
ট্রিসপেলের কথায়, ‘‘ঔপনিবেশিকতার ফলে বহু দেশের নিজস্ব, দেশজ সঙ্গীত, জনজাতির সংস্কৃতি চাপা পড়ে গিয়েছে৷''
বোলিভিয়ার শিল্পীদল ‘ডস পারেস ডে লা অরকোয়েস্টা এক্সপেরিমেন্টাল ডে ইনস্ট্রুমেন্টোস নাটিভোস' বাজাবেন আন্দিজ পার্বত্য অঞ্চলের হারিয়ে যাওয়া সংগীত৷ পাশাপাশি দেশজ বাদ্যযন্ত্র দিয়ে নতুন সংগীতও শোনাবেন তারা৷
এদিকে আজাদা অনসম্বল হলো একটি আফগান দল, যারা আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী সংগীত এবং নৃত্য পরিবেশনা করে। তারা মূলত মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে সম্পর্ক, দেশের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলেন তাদের শিল্পে৷
নারীদের সব অধিকার হরণ করছে তালেবান সরকার৷ সম্প্রতি বন্ধ করে দেয়া হয় দেশের সব বিউটি পার্লার৷ শত শত কর্মীর জীবিকার কথা বিবেচনায় নিয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি উঠেছে সেখানে৷ হয়েছে বিক্ষোভ৷ ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: AFP/Getty Images
নারীর যেমন শিক্ষা চায় তালেবান
২০২১ সালের আগস্ট মাসে দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় আসে তালেবান৷ ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর ক্ষমতা দখল করেই নারীদের অধিকার সীমিতকরণের উদ্যোগ নেয় তারা৷ উচ্চ শিক্ষার অধিকার হারায় আফগানিস্তানের নারীরা৷ তালেবান সরকার জানিয়ে দিয়েছে, মেয়েরা এখন সর্বোচ্চ ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পারবে৷ ওপরের ছবিতে বেসরকারি উদ্যোগে খোলা দরিদ্র পরিবারের শিশুদের একটি ভ্রাম্যমান স্কুল৷
ছবি: Amir Khan Zaland/DW
পার্ক, মেলা, জিমও নিষিদ্ধ
আফগান নারীদের জন্য পার্কে বা মেলায় যাওয়াও নিষিদ্ধ করেছে তালেবান সরকার৷ হাতে গোণা যে কয়টি জিম রয়েছে, সেগুলো এখন শুধু পুরুষদের জন্য নির্ধারিত৷ হিজাব পরেও নারীর বাড়ি থেকে একটু দূরে একা যাওয়ার অনুমতি নেই৷ একটু দূরে যেতে হলে পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্যকে সঙ্গে রাখা বাধ্যতামূলক৷ ছবিতে কাবুলের এক পার্কে ট্রাম্পোলিনে মজার সময় কাটাচ্ছে ছেলে শিশুরা৷
ছবি: Rodrigo Abd/AP Photo/picture alliance
সরকারি-বেসরকারি চাকরিতেও নিষেধাজ্ঞা
উচ্চ শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি ‘শিক্ষিত’ নারীদের চাকরির অধিকারও খর্ব করেছে তালেবান সরকার৷ বেশির ভাগ সরকারি চাকরিই এথন নারীর জন্য নিষিদ্ধ৷ বেসরকারি চাকরিতেও নারীরা সুযোগ হারাচ্ছেন ক্রমশ৷ সম্প্রতি জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলোতে আফগান নারীদের নিষিদ্ধ করেছে সরকার৷ ছবিতে স্থানীয় এক এনজিওতে ইউএনএইচসিআর পরিচালিত প্রশিক্ষণ শিবিরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন শিক্ষানবিশ ধাত্রীরা৷
ছবি: Ali Khara/REUTERS
বিউটিপার্লারও নিষিদ্ধ
গত মাসে এক নির্দেশনায় বিউটিপার্লারও নিষিদ্ধ করে এক মাসের মধ্যে দেশের সব পার্লার বন্ধের আদেশ দেয় সরকার৷ ওপরের ছবিতে সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী বিউটি পার্লার বন্ধ করছেন নারী কর্মীরা৷ গত ২৪ জুলাইয়ের ছবি৷
ছবি: ALI KHARA/REUTERS
৬০ হাজার নারী বেকারত্বের ঝুঁকিতে
বন্ধ হতে চলেছে তিল তিল করে গড়া বিউটি পার্লার৷ সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ৷ কাবুলের এক পার্লার কর্মীকে গ্রাস করেছে সেই দুশ্চিন্তা৷ তালেবান সরকার আকষ্মিক ঘোষণায় সব পার্লার বন্ধ করে দেয়ায় সারা দেশে ১২ হাজার বিউটি পার্লারের ৬০ হাজারেরও বেশি নারী বেকারত্ব বরণ করবেন৷
ছবি: ALI KHARA/REUTERS
আইএলও-র উদ্বেগ
বিউটি পার্লার নিষিদ্ধ হওয়ায় আফগানিস্তানে ‘বেকার’ নারীর সংখ্যা আরো বাড়বে৷ এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)৷ আফগানিস্তানে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এমনিতেই কম৷ পাশ্চাত্যের সমর্থনপুষ্ট সাবেক সরকারের আমলেও কর্মক্ষেত্রে মাত্র ২৩% ছিল নারী৷ তালেবান আমলে সেই হার খুব দ্রতই কমছে৷ ওপরের ছবিতে বন্ধ হওয়ার আগে এক বিউটি পার্লারে কর্মীদের ব্যস্ততা৷
ছবি: ALI KHARA/REUTERS
স্বপ্নের মৃত্যু
আত্মনির্ভরশীল জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা৷ সেই স্বপ্ন থেকেই গড়েছিলেন বিউটি পার্লার৷ সব গুটিয়ে এখন তাদের ঘরে ফেরার পালা৷
ছবি: ALI KHARA/REUTERS
প্রতিবাদ, বিক্ষোভ
তালেবান সরকারের হঠাৎ দেশের সব বিউটি পার্লার বন্ধের ঘোষণা অবশ্য নীরবে মেনে নেয়নি আফগানিস্তানের নারীরা৷ সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে কয়েকটি শহরে৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘আমাদের খাদ্যের অধিকার, কাজের অধিকার কেড়ে নিয়ো না’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ‘খাদ্য’, ‘সুবিচার’, ‘কাজ’ ইত্যাদি লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করছেন নারীরা৷ তারা বলছেন, ‘‘আমাদের খাদ্যের অধিকার, কাজের অধিকার কেড়ে নিয়ো না৷’’ ওপরের ছবিটি গত ১৯ জুলাইয়ের৷
ছবি: AFP/Getty Images
জাতিসংঘের নিন্দা
নারীদের বিক্ষোভ করতে না দেয়ায় তালেবান সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছে ইউনাইটেড নেশন্স অ্যাসিস্ট্যা্ন্স ইন আফগানিস্তান (ইউএনএএমএ)৷ এক টুইট বার্তায় ইউএনএএমএ বলেছে, ‘‘বিউটি পার্লার নিষিদ্ধ করা আফগানিস্তানে নারীর অধিকার অস্বীকারের আরেকটি উদাহরণ৷ এর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদও শক্তি প্রয়োগে দমনের বিষয়টি গভীর উদ্বেগের৷ সহিংসতা ছাড়া মত প্রকাশের অধিকার কর্তৃপক্ষকে সমুন্নত রাখতে হবে৷’’
ছবি: Morteza Nikoubazl/REUTERS
নারীদের ওপর জলকামান
ভিডিওতে দেখা যায় বিক্ষোভরত নারীদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে তালেবান নিরাপত্তাকর্মী৷ এক নারী তাদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেন৷ এক পর্যায়ে জলকামান ছুঁড়ে ছত্রভঙ্গ করা হয় নারীদের৷ এ সময় গুলির শব্দও শোনা যায়৷ শার-এ-নাও-এর এর এক নারী বলেন, ‘‘আমরা কাজ করার অধিকার চেয়েছিলাম৷ চেয়েছিলাম সরকার তার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুক৷ কিন্তু তালেবান তার জবাবে জলকামান আর ফাঁকা গুলি ছুঁড়লো, কয়েকজন নারীকে ধরে নিয়ে গেল৷’’
ছবি: AFP/Getty Images
11 ছবি1 | 11
তালেবানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
২০২৩ সালে জার্মানির বন শহরে এসেছিলেন আফগান ইয়ুথ অর্কেস্ট্রার সদস্যরা৷ ইরানের সংগীতশিল্পীদের সঙ্গে বিঠোফেনফেস্টে ডয়েচে ভেলের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তারা৷ আহমদ জানান, বনে তাদের অর্কেস্ট্রার সব সদস্য অবশ্য আসেননি৷ বার্লিনের ইয়ং ইউরো ক্লাসিকে তাদের অর্কেস্ট্রার সব সদস্য, অর্থাৎ, ৫১ জনই যোগ দেবেন৷
আহমদের কথায়, ‘‘আমাদের গাওয়া ও বাজানো প্রতিটা সংগীত আফগানিস্তানের বর্তমান অবস্থা ও তালেবানের নীতি তুলে ধরবে৷''
আফগান সমাজকে আরও বেধে বেধে থাকার ডাক দিতে চায় আফগান ইয়ুথ অর্কেস্ট্রা৷ আহমদ জানান, ‘‘তালেবানের হাতে নির্যাতিতা আফগান নারীদের স্বাধীনতা ও সাম্যের লড়াইয়ে আফগান পুরুষদের সহযোগিতার ডাক নিয়ে একটি গান রয়েছে৷''
একটি সংগীত রয়েছে আফগানিস্তানে নতুন বছর উদযাপন নিয়েও, যা এখন তালেবান সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে৷ আহমদ স্পষ্ট জানান, ‘‘হাজার বছর ধরে এটা উদযাপন হত৷ তালেবান যে আমার দেশের সংস্কৃতি নষ্ট করছে, এই সংগীতের মাধ্যমে তার প্রতিবাদ করছি আমরা৷''
তবু আশা বেঁচে থাকে
কনসার্টের শেষ গানটি ফারসি একটি কবিতার উপর ভিত্তি করে৷ আয়োজন করেছেন তরুণ পর্তুগিজ কন্ডাক্টর টিয়েগো মোরেইরা ডা সিলভা৷ এতে শান্তি ও বসন্তের ফিরে আসার কথা বলা হয়েছে৷
আহমদ চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদার কবিতা উদ্ধৃত করে বলেন, ‘‘ফুল ও গাছ ধ্বংস করে দিলেও বসন্ত ফিরে আসে৷ তাকে রোখা যায় না৷''
সমাজমাধ্যমের সাহায্যে নিজেদের জন্মভূমির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন আফগান ইয়ুথ অর্কেস্ট্রার সদস্যরা৷
আহমদের আশা আফগানিস্তানে একদিন ফের ফিরে আসবে সংগীত, শিল্প, সংস্কৃতি৷ তালেবানকে তার বার্তা, ‘‘মানব ইতিহাসে কোনো স্বৈরাচারী খুব বেশিদিন কখনওই ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, তালেবানেরও তাই হবে৷''