ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, মাদক পাচার, বিদেশ থেকে অনুদান – আফগানিস্তানের তালেবান গোষ্ঠী গত ১৫ বছর ধরে তাদের বিদ্রোহ চালিয়ে আসছে নানা উৎসের উপর নির্ভর করে, যেগুলি বন্ধ করা খুবই শক্ত৷
বিজ্ঞাপন
গত মাসে পাকিস্তানের কোয়েটা শহরের কাছে একটি গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে তালেবান নেতৃত্ব আফগানিস্তানের টেলিকম কোম্পানিগুলির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের একটি নতুন ‘‘সুরক্ষা কর'' দাবি করে বসে৷ বিনিময়ে কোম্পানিগুলির বিভিন্ন কার্যালয় ও কলকারখানা অথবা তাদের কর্মীদের আক্রমণ করা হবে না, এই হলো গ্যারান্টি৷ দিনকাল ভালো যাচ্ছে না, তাই তালেবানের দৃশ্যত নজর পড়েছে আফগানিস্তানের একমাত্র লাভজনক শিল্পটির দিকে, যার নাম টেলিকম৷ টেলিকম কোম্পানিগুলির কাছ থেকে আগেও তোলা নিয়েছে তালেবান; এবার কিন্তু তারা টেলিকম সেক্টরের কাছ থেকে সরাসরি টেন পার্সেন্ট (১০ শতাংশ) চাইছে, যা তারা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় সব ব্যবসায়ের কাছ থেকে নিয়ে থাকে – ডয়চে ভেলেকে বলেছেন ক্ষমতাচ্যুত তালেবান সরকারের এক সাবেক কর্মচারী৷
মাদক পাচার
দক্ষিণের হেলমন্দ, উরুজগান, কান্দাহার ও জাবুল প্রদেশের চাষিদের ভালোমতন টাকা দিয়ে আফিমের চাষ করায় তালেবান – এবং সে টাকার অঙ্ক অন্য যে কোনো বিকল্প জীবিকার তুলনায় অনেক বেশি৷ সেই সঙ্গে আছে চাষিদের প্রতি হুমকি ও সহিংসতা৷ এ তো শুধু উৎপাদন৷ মাদকের উৎপাদন থেকে শুরু করে পশ্চিমে পাচার অবধি বাণিজ্যপথের প্রতিটি চৌরাস্তায় ‘কর' তুলছে তালেবান৷ মাদক চালানের লরিগুলোর সুরক্ষাও ক্ষেত্রবিশেষে তালেবানের গ্যারান্টিতে৷ গোটা মাদক ব্যবসা থেকে তালেবান নাকি বছরে ১০ কোটি থেকে ৩০ কোটি ডলার রোজগার করে থাকে, বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান৷ বিশ্বের আফিম উৎপাদনের ৮০ শতাংশ আসে এই একটি দেশ থেকে, কাজেই আশ্চর্য হবার কিছু নেই৷
আফগানিস্তানে বাড়ছে আফিম চাষ
আফগান চাষীরা আবারো বেশি করে ঝুঁকছেন আফিম চাষের দিকে৷ এর মধ্যেই উৎপাদনের পরিমাণ অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে৷
ছবি: AP
বিশ্ব নেতা
আফিম চাষের দিক থেকে বিশ্বের কোনো দেশই আফগানিস্তানকে টেক্কা দিতে পারবে না – তাই এক্ষেত্রে আফগানিস্তানকে ‘বিশ্ব নেতা’ বলা যেতে পারে৷ ২০১৩ সালে দেশটিতে ২ লাখ ৯ হাজার হেক্টর জমিতে পপি ফুলের চাষ হয়েছে৷ এই পপি ফুলের বীজ থেকেই তৈরি হয় আফিম এবং হেরোইন৷ বিশ্বের অন্তত ৯০ ভাগ চেতনানাশক মাদক উৎপাদন হয় এখানে৷
ছবি: dapd
বৃহৎ জমি, ব্যাপক উৎপাদন
২০১৩ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে বলা হয় যে, ২০১৩ সালে এর আগের বছর, মানে ২০১২ সালের তুলনায় আফিমের উৎপাদন ৫০ ভাগ বেড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সেনা প্রত্যাহার কি সঠিক সিদ্ধান্ত?
এই হারে আফিমের উৎপাদন বাড়ায় আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে জাতিসংঘকে৷ ধারণা করা হচ্ছে, সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির যে ক্ষতি হবে তা পোষাতে আফিমের উৎপাদন আরো বাড়াতে বাধ্য হবেন চাষীরা৷
ছবি: picture alliance/dpa
কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য
জাতিসংঘের অনুমান, ২০১৩ সালে আফগানিস্তানে যে পরিমাণ আফিম উৎপাদন হয়েছে তার মূল্য অন্ততপক্ষে ৯৫ কোটি মার্কিন ডলার৷
ছবি: picture-alliance/ dpa/dpaweb
অর্থের মোহ
স্বল্প উৎপাদনে বিপুল লাভের কারণে পপি উৎপাদনে চাষীদের লোভ বাড়ছে৷ এক কেজি আফিম আফগানিস্তানে বিক্রি হয় ১৫০ মার্কিন ডলারে৷ ফলে এটা তাঁদের জন্য একটি লাভজনক বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
হেলমন্দ – সমস্যাগ্রস্ত প্রদেশ
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফগানিস্তানে গত বছর যে পরিমাণ আফিম উৎপাদন হয়েছে তার অর্ধেক উৎপাদন হয়েছে দেশটির হেলমন্দ প্রদেশে৷ এই প্রদেশটি জঙ্গি গোষ্ঠী তালেবানের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বৃথা লড়াই
মাদকবিরোধী লড়াইয়ে আফগানিস্তানকে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র৷ ২০১৩ সালেই দু’দেশের মধ্যে ২৫ কোটি মার্কিন ডলারের একটি চুক্তি সই হয়েছে৷ আফগান সরকারের তথ্য অনুযায়ী, দেশের অন্তত ২ লাখ পরিবার আফিম চাষের উপর নির্ভরশীল৷
ছবি: AP
মাদক বাণিজ্য তালেবানের জন্য লাভজনক
আফগানিস্তানের এই মাদক বাণিজ্য থেকে একটা বড় লাভের অংশ যায় তালেবানের হাতে৷ কাবুল সরকার এবং আন্তর্জাতিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অর্থের জন্য আফিম চাষীরা বরাবরই তাদের লাভের একটা অংশ তালেবান জঙ্গিদের হাতে তুলে দেয়৷
ছবি: AP
মাদকাসক্ত শিশু
ব্যাপক উৎপাদনের সাথে ব্যাপক আসক্তির ব্যাপারটাও জড়িত৷ আফগানিস্তানে কেবল যে মাদক উৎপাদন হচ্ছে তাই না, স্থানীয়রা এই মাদক বেচা-কেনাও করে৷ জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরো দেশে ১৫ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত এবং এদের মধ্যে ৩ লাখই নাকি শিশু৷
ছবি: Getty Images
9 ছবি1 | 9
তোলা আর ‘কর'
তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণের কাছ থেকে অন্যান্য প্রথাগত করও আদায় করা হয়, যেমন ফসলের উপর ১০ শতাংশ কর, যার নাম উশর, বা সম্পত্তির উপর আড়াই শতাংশ কর, যার নাম জাকাত৷ এছাড়া জল বা বিদ্যুতের উপরও কর আদায় করা হয়, বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে৷ তালেবান জঙ্গিরা বিচার বা মামলার নিষ্পত্তির জন্যও ফি নিয়ে থাকে, সেই সঙ্গে থাকে জরিমানার টাকা৷
কারা তালেবানকে টাকা দেয়? কনট্র্যাক্টর, এনজিও, বেসরকারি কোম্পানি, এমনকি সরকারের সদস্য – প্রায় সকলেই, নিরুপায় হয়ে, কিংবা স্বস্তি পাবার জন্য, টাকা দিয়ে থাকে, যদিও টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করতে সকলেরই দ্বিধা৷
আফগানিস্তানের বাইরে থেকে আসে দানের টাকা, প্রধানত পাকিস্তান ও উপসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন ইসলামি দাতব্য সংস্থা ও অপরাপর প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে৷ এই প্রসঙ্গে পাকিস্তানের আইএসআই গুপ্তচর সংস্থার সঙ্গে আফগান তালেবানের বিশেষ সম্পর্কের কথা অনেকেই উল্লেখ করে থাকেন, যদিও তার কোনো প্রকাশ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই এবং পাকিস্তান সরকার তা বরাবর অস্বীকার করে এসেছেন৷
কোথা থেকে অর্থ পাচ্ছে আইএস?
পেট্রোলিয়াম বিক্রি থেকে শুরু করে ব্যাংক ডাকাতি, অধিকৃত এলাকায় কর চাপানো এবং প্রাচীন সামগ্রী বিক্রি করে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট প্রায় ২০০ কোটি ডলার একত্র করেছে৷ তাতে তাদের আরও ২ বছর চলে যাবার কথা৷
ছবি: picture alliance/abaca
বেআইনি তেল বিক্রি
বেআইনি ভাবে পেট্রোলিয়াম বিক্রি আইএস-এর আয়ের প্রধান উৎস৷ সিরিয়া ও ইরাকে বেশ কিছু বড় তৈলকূপ আপাতত তাদের দখলে৷ মূলত তুরস্কের মধ্য দিয়েই তারা চোরাচালানের কাজ চালিয়ে থাকে৷ মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, কালোবাজারে তেল বিক্রি করে আইএস-এর মাসে প্রায় ৪ কোটি ডলার আয় হয়৷
ছবি: Getty Images/J. Moore
ব্যাংক ডাকাতি
সিরিয়া ও ইরাকে কোনো এলাকা দখলের পর আইএস সবার আগে ব্যাংকগুলি কবজা করে ফেলে৷ মার্কিন প্রশাসনের ধারণা, এভাবে তারা ৫০ থেকে ১০০ কোটি ডলার আত্মসাৎ করেছে৷ শুধু মোসুল শহর দখল করেই তারা নাকি ৬২ কোটি ডলার লুট করেছিল৷ বছরে প্রায় ৫০,০০০ জিহাদি কর্মীর বেতন দিতে এই অর্থ যথেষ্ট৷
ছবি: Getty Images/S. Platt
কর আদায় ও চাঁদাবাজি
আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকার প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষকে ৫ থেকে ১৩ শতাংশ আয়কর দিতে হয়৷ জার্মান সরকারের সূত্র অনুযায়ী, আইএস অ-মুসলিমদের কাছ থেকে জিজিয়া করও আদায় করে৷ তাছাড়া চাঁদাবাজিও তাদের আয়ের আরেকটি উৎস৷
ছবি: DW/Andreas Stahl
প্রাচীন সামগ্রী বিক্রি
‘জিহাদিরা’ আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ ধ্বংস করতে অভ্যস্ত৷ তবে বেশি দামি অ্যান্টিক সম্পদ সযত্নে সরিয়ে ফেলে কালোবাজারে বিক্রি করে তারা৷ প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছ থেকেও অমূল্য সম্পদ কেড়ে নিয়ে বিক্রি করতে পিছপা হয় না এই গোষ্ঠী৷ তবে বিক্রিমূল্যের সঠিক অঙ্ক জানা নেই৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
মুক্তিপণ ও প্রচারণা
মানুষজনকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় আইএস-এর দু-মুখী চাল৷ একদিকে এটা আয়ের একটা উৎস, অন্যদিকে এর মাধ্যমে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রচারণার কাজও হয়ে যায়৷ কিছু ‘মূল্যবান’ জিম্মির শিরশ্ছেদ করে সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়ে প্রচারণার ক্ষেত্রে বিপুল সাফল্য পায় আইএস৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
সহানুভূতি দেখাতে চাঁদা
আইএস-এর প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ মানুষ গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে রয়েছে৷ তারা এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তহবিলে আর্থিক অবদান রাখে৷ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সূত্র অনুযায়ী সৌদি আরবে ২০১০ সাল থেকে ৮৬০ জন ব্যক্তিকে সন্ত্রাসের কাজে আর্থিক সাহায্য দেবার অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হয়েছে৷ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ সেখানে ১০০ জনের শাস্তি হয়েছে৷