আফগান রূপকথা থামিয়ে প্রথমবার ফাইনালে সাউথ আফ্রিকা
২৭ জুন ২০২৪৫৭ রান। প্রথমবারের মত কোনো বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলতে হলে সাউথ আফ্রিকার ক্রিকেট দলকে করতে হবে মাত্র ৫৭ রান, তাও ২০ ওভারে। যে সাউথ আফ্রিকা ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে খেলেছে পাঁচ বার, ২০ ওভারের বিশ্বকাপে এবারের আগে সেমিফাইনালে খেলেছে দুই বার অথচ একবারের জন্যও শেষ চারের গন্ডি পার করতে পারেনি, সেই দলটার সামনে ফাইনালে যাওয়ার জন্য সহজতম লক্ষ্য।
কারণ ত্রিনিদাদে, ব্রায়ান লারা ক্রিকেট একাডেমি মাঠে প্রথম সেমিফাইনালে আফগানিস্তান অলআউট হয়েছে ৫৬ রানে। আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে এটাই সর্বনিম্ন স্কোর, আফগানিস্তানেরও টি-টোয়েন্টিতে সর্বনিম্ন স্কোর। অধরা থেকে যাওয়া ফাইনালটা যে এত সহজেই ধরা দিতে যাচ্ছে অবশেষে, সেটা বিশ্বাস হচ্ছিল না কাগিসো রাবাদার। দুই ইনিংসের মাঝে এই পেসার সম্প্রচার সংস্থার মাইক্রোফোনে বললেন, ' এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, মনে হচ্ছে সবকিছু দুলছে'।
টসের সময়ই রশিদ খান আভাস দিয়েছিলেন যে ঠিকঠাক নেই তার দল। সেন্ট ভিনসেন্ট থেকে ত্রিনিদাদে আসার ফ্লাইট দেরি করেছে চার ঘণ্টা, আফগান ক্রিকেটাররা ঘুমানোর সময় পেয়েছেন মাত্র এক ঘণ্টা। সেই ক্লান্তিই কি ভর করলো অকুতোভয় আফগানদের চোখেমুখে? টস জিতে ব্যাট করতে নামার পর আফগান ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিংয়ে ক্লান্তির ছাপ,একই সঙ্গে প্রোটিয়া পেসারদের একের পর এক বাউন্সার। দুইয়ে মিলেই নাজেহাল আফগানিস্তান, রূপকথার সেমিফাইনাল পরিণত হল দুঃস্বপ্নে।
প্রোটিয়া ধ্বংসযজ্ঞের শুরুটা মার্কো ইয়ানসেনের হাতে। দীর্ঘদেহী এই বামহাতি পেসার করেন ম্যাচের প্রথম ওভার, তৃতীয় বলেই স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন ইব্রাহিম জাদরান কিন্তু সেটা হাতে জমাতে পারেননি রেজা হেনড্রিকস। শেষ বলটা করার আগে লেগসাইডে দুটো ওয়াইড বল, এরপর শেষ বৈধ বলটা ছিল হাফ-ভলি। কিন্তু তাতেই স্লিপে ক্যাচ দিয়ে বসলেন রহমানউল্লাহ গুরবাজ। আসরের সর্বোচ্চ রান করা ব্যাটসম্যানকে সেমিফাইনালে শূন্য রানে ফিরিয়ে দেয়ার আনন্দে ভাসলো প্রোটিয়ারা।
দ্বিতীয় ওভারটা করতে এলেন কেশব মহারাজ, তাতে কোনো বিপদ হয়নি। কিন্তু নিজের দ্বিতীয় আর ম্যাচের তৃতীয় ওভারে ফের বোলিংয়ে এসে ইয়ানসেন উড়িয়ে দিলেন গুলবদিন নাইবের স্টাম্প। তিন বল পর নিজের প্রথম ওভারের প্রথম বলে কাগিসো রাবাদা বোল্ড করলেন ইব্রাহিম জাদরানকে। আসরের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান করা ব্যাটসম্যান সেমিফাইনালে করলেন মাত্র দুই রান! একই ওভারের চতুর্থ বলে মোহাম্মদ নবিকেও শূন্য রানে বোল্ড করলেন রাবাদা, চার ওভার শেষে আফগানিস্তান ২০ রানে চার উইকেট।
আফগান রূপকথার শেষের শুরুটা সেখানেই। টপ-অর্ডারই বেশিরভাগ ম্যাচে কাবুলিওয়ালাদের এনে দিয়েছিল লড়াইয়ের পুঁজি, মিডল-অর্ডার খুব একটা ভাল করেনি। ভালো কোনো ব্যাটসম্যানও নেই মাঝ বরাবর। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, একে একে পড়েছে উইকেট। নিজের তৃতীয় ওভারে বল করতে এসে ইয়ানসেন নিয়েছেন খারোটের উইকেট, আইনরিখ নরকিয়াও প্রথম ওভারে হাত ঘুরাতে এসে তুলে নিয়েছেন আজমতউল্লাহ ওমারজাই এর উইকেট।
এরপর রশিদ খান খানিকটা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টায় আগ্রাসী ব্যাটিং করলেন, রাবাদার বলে পরপর দুটো চার মারলেন। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হলো না। একপ্রান্তে দাঁড়ানো রশিদ দেখলেন বামহাতি লেগস্পিনার তাবরিজ শামসি একই ওভারে আউট করলেন করিম জানাত ও নুর আহমেদকে। দুজনেই রিভিউ নিয়েছিলেন আম্পায়ারের এলবিডাব্লিউ এর সিদ্ধান্তে। দুটো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই প্রাধান্য পেয়েছে 'আম্পায়ার'স কল'। পরের ওভারে নরকিয়ার বলে বোল্ড হয়ে গেলেন রশিদ খানও। নাভিন উল হককে লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে ফেলার মাধ্যমে আফগান ইনিংসের ইতি টানেন শামসি। ১১.৫ ওভারে মাত্র ৫৬ রানে অলআউট আফগানিস্তান। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস ১০ রানের, করেছেন আজমতউল্লাহ ওমরজাই। সেটাই একমাত্র দুই অংকের ঘরের ইনিংস। অবশ্য সর্বোচ্চ রানের কৃতিত্ব 'মিস্টার এক্সট্রা'কেও দেয়া যায়, কারণ ৫৬ রানের ১৩ রানই যে এসেছে অতিরিক্ত খাত থেকে!
স্বল্প পুঁজি নিয়েও লড়াই করেছে আফগানরা। এলাম-দেখলাম-জয় করলাম, এমন ভঙ্গিতে সাউথ আফ্রিকাকে জিততে দেয়নি রশিদ খানের দল। কুইন্টন ডি কককে মাত্র পাঁচ রানেই বোল্ড করেছেন ফজল হক ফারুকি। এইডেন মার্করামকে কট বিহাইন্ড করার সুযোগ হাতছাড়া করেছে প্রযুক্তির সহায়তা না নিয়ে। রিভিউ নিলেই রশিদ দেখতে পেতেন বল গুরবাজের গ্লাভসে যাবার আগে ছুঁয়েছিল প্রোটিয়া অধিনায়কের ব্যাটের কানা। একটা ক্যাচও দিয়েছিলেন মার্করাম, এগিয়ে এসে থার্ডম্যানে সেটা ধরতে পারেননি নুর আহমেদ। এরকম ছোট ছোট কিছু ঘটনা ঘটেছে শুরুতে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাপটা কমে এসেছে কারণ জয়ের লক্ষ্য যে মাত্র ৫৭ রান!
এবি ডি ভিলিয়ার্স, স্মিথ, জ্যাক ক্যালিস...কত কিংবদন্তিই তো খেলেছেন প্রোটিয়া জার্সিতে। তাদের অনেকেরই ব্যক্তিগত অর্জন অসামান্য। তবে রেজা হেনড্রিকস এর কীর্তিটা অনেক কিংবদন্তিকেই ছাপিয়ে, তার বাউন্ডারিতেই যে প্রথমবারের মত কোন বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলো সাউথ আফ্রিকা। ফ্রি হিটে আজমতউল্লাহ ওমারজাইয়ের বলে স্কয়ারলেগ দিয়ে ম্যাচের একমাত্র ছক্কাটা মেরে রানটা আফগানদের সমান করেন এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান, পরের বলটা সোজা ব্যাটে ডাউন দ্যা গ্রাউন্ডে খেলে চার মেরে নিশ্চিত করেন সাউথ আফ্রিকার প্রথম সেমিফাইনাল জয়। ২৫ বলে ২৯* রানের ইনিংস খেলে ঐতিহাসিক জয়ের সাক্ষী হয়ে থাকলেন হেনড্রিকস, সঙ্গী ছিলেন ২১ বলে ২৩* রান করা অধিনায়ক মার্করাম।
হারের পর রশিদ বললেন,' আমাদের জন্য কঠিন একটা রাত গেলো। কন্ডিশনটা আমাদের পক্ষে ছিল না, তবে আরেকটু ভালো করতে পারতাম। আমাদের ব্যাটসম্যানরা সবসময় ভাল একটা শুরু এনে দিয়েছিল, সেটা আজকে হয়নি। আমরা টুর্নামেন্টটা উপভোগ করেছি, সব মিলিয়ে আমরা যা অর্জন করেছি তা নিয়ে খুশি। এটা আমাদের জন্য খুবই বিশেষ একটা আসর, সেই সঙ্গে গর্বেরও। এই আসর আমাদেরকে একটা বিশ্বাস দিয়েছে যে আমরা যে কোন দলকে হারাতে পারি। এটা আমাদের জন্য স্রেফ শুরু'।
দশ বছর আগে, ২০১৪ সালে এইডেন মার্করামের নেতৃত্বেই অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছিল সাউথ আফ্রিকা। তার হাত ধরেই আরেকটা বিশ্ব আসরের ফাইনালে, প্রথম বারের মতো। ম্যাচশেষে জানালেন, ' খুব ভাল লাগছে, দলের সবাই খুব জোরাল প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ট্রফি জিততে হলে আর একটা ম্যাচ জিততে হবে। টসটা হারায় ভাল হয়েছে কারণ আমরাও ব্যাট করতেই চেয়েছিলাম।বোলাররা সঠিক জায়গায় বল করেছে আর আমাদের কাজটা সহজ করে দিয়েছে'।
ভারত অথবা ইংল্যান্ড, এই দুই দলের এক দলকেই শনিবার বার্বাডোজে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাবে সাউথ আফ্রিকা। যদি ফাইনালটা তারা জিততে পারে, তাহলে প্রথম বারের মতো সাউথ আফ্রিকার বিশ্বকাপ জয় তো হবেই, একই সঙ্গে প্রথম কোন দল হিসেবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার হাতছানিও আছে তাদের সামনে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
আফগানিস্তান ১১.৫ ওভারে ৫৬; ওমরজাই ১০, ইয়ানসেন ৩/১৬, শামসি ৩/৬
সাউথ আফ্রিকা ৮.৫ ওভারে ৬০/১; হেনড্রিকস ২৯*, মার্করাম ২৩*; ফারুকি ১/১১
ফলঃ সাউথখেলাধুলা আফ্রিকা নয় উইকেটে জয়ী
ম্যাচসেরাঃ মার্কো ইয়ানসেন