গতবছর নাইজেরিয়ার চার হাজার মহিলা ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইটালিতে এসেছেন – গণিকা হিসেবে কাজ করতে৷ কিন্তু তাদের যারা এনেছে, সেই মানুষ পাচারকারীদের প্রায় কোনো বিচার নেই, না আফ্রিকায়, না ইউরোপে৷
বিজ্ঞাপন
ইটালিতে প্রায় চল্লিশ হাজার বিদেশিনি গণিকাবৃত্তি করেন৷ তাদের অধিকাংশই এসেছেন রোমানিয়া আর নাইজেরিয়া থেকে – স্বেচ্ছায় নয়, মানুষ পাচারকারীদের শিকার হয়ে৷ নাইজেরিয়া থেকে আসা মহিলাদের ক্ষেত্রে এই মানুষ পাচারকারীরা নিজেরাই হলেন মহিলা, তাদের বলা হয় ‘‘ম্যাডাম''৷ এই প্রভাবশালী ম্যাডামদের অধিকাংশ ইটালিতেই থাকেন এবং সেখান থেকেই তাদের মানুষ পাচারের ব্যবসা চালান৷ ম্যাডামদের নেটওয়ার্ক বা চক্র যে খুব বড়, এমন নয়: নাইজেরিয়ায় তরুণীদের ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজি করানো থেকে শুরু করে সাহারা আর ভূমধ্যসাগর পার করে তাদের ইটালিতে আনা পর্যন্ত – এ সবের জন্য খুব বেশি লোক লাগে না৷
ওদিকে যাদের পাচার করে আনা হচ্ছে, তারাও আবার তথাকথিত ‘‘জুজু'' বশীকরণের ভয়ে পুলিশের কাছে যায় না৷ এই মহিলাদের অধিকাংশ আসেন দক্ষিণ নাইজেরিয়ার বেনিন সিটি থেকে, যেখানে জুজু ওঝাদের বিশেষ প্রতাপ; তারাই নাকি হতভাগ্য তরুণীদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করায় যে, তারা ইউরোপে কোনো গোলমাল করবে না৷ নয়ত নাকি তাদের পরিবারবর্গের খুব খারাপ কিছু একটা ঘটবে৷
ওদিকে ইটালিতে আসা কোনো নাইজেরীয় তরুণীকে যদি পুলিশে এজাহার দিতে রাজিও করানো যায়, তাহলেও তাদের আঞ্চলিক, গ্রাম্য ভাষা অনুবাদ করার মতো কোনো দোভাষী পাওয়া যায় না, কেননা তাদেরও জুজুর ভয়!
বলতে কি, ইটালিতে কেউই এই নাইজেরীয় তরুণীদের সমস্যা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে রাজি নয়, কেননা সমস্যাটা পুরোপুরি নাইজেরীয়দের৷ ওদিকে নাইজেরিয়ায় ফিরলে দেখা যাবে, সেখানেও কেউ এই লাভের ব্যবসার গুড়ে বালি ঢালতে আগ্রহী নয়৷ বেনিন সিটির যে সব বস্তি থেকে এই হতভাগ্য মেয়েরা আসে, তার পাশেই গজিয়ে উঠছে একটির পর একটি প্রাসাদোপম বাড়ি – মানুষ পাচারের ব্যবসার টাকায়৷ এই সব বাড়ির মালিক সেই ম্যাডামরা – যারা ‘অবসর' নেওয়ার পর স্বদেশে ফিরতে চান!
ওদিকে লিবিয়ায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার পর মানুষ পাচারকারীদের একটা বিরাট পথ খুলে গেছে৷ ফলে বেনিন সিটির হাজার কিলোমিটার উত্তরে আগাদেজ শহরটি আজ নাইজেরিয়া থেকে ইউরোপ অভিমুখে মানুষ পাচারের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে৷ এলাকার অর্থনৈতিক গতিবিধির ৫০ শতাংশ আজ মানুষ পাচার৷
বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের কথা
পৃথিবীর আদিম এক পেশা পতিতাবৃত্তি৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই চালু রয়েছে এই পেশা৷ বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন আছেন বাংলাদেশের যৌনকর্মীরা? এই ছবিঘরে তাঁদের অবস্থা কিছুটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
যেভাবে যৌনপল্লীতে আগমন
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়ে যৌনপল্লীতে হাজির হন মেয়েরা৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতিদরিদ্র্য পরিবারের সদস্যরা কখনো কখনো অর্থের লোভে মেয়েদের বিক্রি করে দেন বলে জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা৷ এছাড়া ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে কিংবা বিদেশ যাওয়ার লোভ দেখিয়েও মেয়েদের যৌনপল্লীতে আনা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir uz ZAMAN
যৌনকর্মীদের জন্য ‘গরুর ট্যাবলেট’
ফরিদপুরের সরকার অনুমোদিত যৌনপল্লীর ছবি এটি৷ অভিযোগ রয়েছে, পল্লীর মালিক নতুন আসা যৌনকর্মীদের স্টেরয়েড ট্যাবলেট সেবনে বাধ্য করেন, যা সাধারণত গরুকে খাওয়ানো হয়৷ গরুর স্বাস্থ্য বাড়াতে ব্যবহার করা এই ট্যাবলেট মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ‘ইনজেকশন’
বাংলাদেশের এক যৌনপল্লীর মালিক রোকেয়া জানান, স্টেরয়েড ওষুধ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালো কাজে দেয়৷ কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়৷ অপ্রাপ্তবয়সিদের স্বাস্থ্য ভালো করতে বিশেষ ধরনের ইনজেকশন ব্যবহার করা হয় বলে জানান ৫০ বছর বয়সি রোকেয়া৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
অধিকাংশ যৌনকর্মী ‘স্টেরয়েড আসক্ত’
আন্তর্জাতিক উন্নয়নসংস্থা একশনএইড ইউকে এক সমীক্ষার ভিত্তিতে ২০১০ সালে জানায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ যৌনকর্মী ওরাডেক্সন বা অন্যান্য স্টেরয়েড ট্যাবলেট নিয়মিত গ্রহণ করে৷ তাঁদের গড় বয়স ১৫-৩৫ বছর৷ বাংলাদেশে দু’লাখের মতো যৌনকর্মী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ
স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা চালাচ্ছে একশনএইড৷ সংস্থাটির বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার জানিয়েছেন, ‘‘ওরাডেক্সন গ্রহণ করার পর শুরুতে মেয়েদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকে৷ কিন্তু এটি নিয়মিত সেবন করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চামড়ায় ক্ষতসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়৷’’
ছবি: GMB Akash
এইচআইভি সংক্রমণ
বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ বা এইডস রোগ হওয়ার খবর মাঝে মাঝে পত্রিকায় প্রকাশ হয়৷ তবে ঠিক কতজন যৌনকর্মী এইচআইভি আক্রান্ত তার হালনাগাদ কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি৷ অনেকক্ষেত্রে কনডম ব্যবহারে খদ্দেরের অনীহা যৌনকর্মীদের মাঝে যৌনরোগ ছড়াতে সহায়ক হচ্ছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: AP
‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ যৌনকর্মী
বাংলাদেশের যৌনপল্লীগুলোতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের জোর করে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে৷ আর এই পেশায় যাঁরা একবার প্রবেশ করছেন, তাঁদের জীবনেও নানা ঝুঁকি থাকে৷ পতিতাপল্লীতে হামলার খবর কিন্তু মাঝেমাঝেই শোনা যায়৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
শত বছরের পুরনো পল্লী উচ্ছেদ
মাদারিপুরের পতিতাপল্লীটি ছিল শত বছরের পুরনো৷ গত বছর এই পল্লী উচ্ছেদ করেছেন স্থানীয়রা৷ এমনকি পল্লীটি জোরপূর্বক উচ্ছেদ না করার হাইকোর্টের আদেশও এক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছে৷ সেখানে পাঁচশ’র মতো যৌনকর্মী বাস করতেন৷ কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলের একটি পতিতাপল্লীও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এ রকম উচ্ছেদের আতঙ্কে রয়েছেন আরো অনেক যৌনকর্মী৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
মধ্যপ্রাচ্যে ‘যৌনদাসী’ বাংলাদেশের মেয়েরা!
বাংলাদেশের বেশ কয়েক নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে৷ তাঁদের পাচার করে সিরিয়ায় নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক বার্তাসংস্থা৷ এ সব নারীকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে৷ তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়েও বাংলাদেশি নারীদের জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
9 ছবি1 | 9
টাকা পাঠাতে গেলে ছোট ছোট দোকান থেকেও তা করা যায়, আবার সাতটি ব্যাংকও গত কয়েক বছরে এখানে শাখা খুলেছে৷
কিছু কিছু নাইজেরীয় তরুণীকে জোর করে ফেরতও পাঠানো হয়েছে, তবে তারা নাইজেরিয়ার এই পরিবেশে মুখ খুলতে চান না৷ আর বাদবাকি তরুণীরা সুদূর ইউরোপে সুখের আশায় বুক বাঁধেন...৷
এই ট্র্যাজেডিরও আরেক নাম উদ্বাস্তু সংকট৷
শরণার্থী এই ‘ম্যাডাম’ বা গণিকাদের উদ্ধারে, মানবপাচার রোধে আমরা কী করতে পারি? জানান নীচের ঘরে৷