ক্যামেরুনে ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই সাংবাদিক ও সমকামী অ্যাক্টিভিস্ট এরিক লেমবেমবেকে তাঁর বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়৷ সারা দেহে মারাত্মক নির্যাতনের চিহ্ন৷ পুলিশ তদন্ত শুরু করে৷ এক বছর পর ফলাফল ‘কিছুই না' – ক্ষোভের সাথে এ কথা জানান ক্যামেরুনস্থ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংঘের উপপ্রধান ড্রিসা৷ তাঁর কথায়, ‘‘সম্ভবত এব্যাপারে কোনো জিজ্ঞাসাবাদই করা হয়নি৷ আজ পর্যন্ত কোনো অগ্রগতিই লক্ষ্য করা যায়নি৷''
যৌন সংখ্যালঘুরা ঝুঁকির মুখে
আফ্রিকায় যৌন সংখ্যালঘুদের সময়টা ভাল নয় এখন৷ এবছরের প্রথম দিকে নাইজেরিয়া ও উগান্ডার প্রেসিডেন্ট একটি আইনে স্বাক্ষর করেছেন, যার আওতায় সমকামিতাকে দণ্ডণীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হয়৷ এরফলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে৷
সরকারি পর্যায়ে এই ধরনের ‘সমকামী আতঙ্ক' সমকামীদের প্রতি বৈরিতাকে সাহস জোগাচ্ছে৷ আর তাই তো লেমবেমবের মতো অ্যাক্টিভিস্টদের হত্যা করেও পার পেয়ে যাচ্ছে খুনিরা৷ ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা ও আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে সমকামীরা আত্মগোপন করে থাকতে বাধ্য হন৷
পুলিশ নির্বিকার
এক্ষেত্রে পুলিশের সাহায্য পাওয়া যায় খুব কমই, বলেন কেনিয়াস্থ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কর্মী নীলা ঘোষাল৷
সমকামীদের বিয়ে এবং সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের৷ ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ তবে পূর্ব ইউরোপের পরিস্থিতি ভিন্ন৷ বিস্তারিত দেখুন এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpaসমকামীদের বিয়ে এবং সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার দিতে সরকারি পরিকল্পনার সমর্থনে গত রবিবার প্যারিসে হাজির হন লাখো মানুষ৷ কিছুদিন আগে অবশ্য সেখানে সমকামীদের বিয়ের বিপক্ষে লাখো মানুষ সমবেত হয়৷ এই ইস্যু নিয়ে বেশ উত্তপ্ত সেদেশ৷ বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চ এবং ডানপন্থি বিরোধী দল ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলঁদকে এই আইন করা থেকে বিরত রাখতে চাইছে৷
ছবি: Reutersইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের পরিস্থিতি মিশ্র৷ নেদারল্যান্ডস হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম দেশ যেখানে সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে বৈধ ঘোষণা করা হয়৷ ২০০১ সালের এপ্রিল থেকে সেদেশে এই আইন কার্যকর আছে৷
ছবি: AP২০০৩ সালের জুন মাসে নেদারল্যান্ডসের প্রতিবেশী দেশ বেলজিয়ামে সমলিঙ্গের মধ্যে বিবাহ বৈধ করা হয়৷ প্রথম দিকে সেদেশে বিদেশিদের মধ্যে এ ধরনের বিবাহে খানিকটা জটিলতা ছিল৷ কিন্তু ২০০৪ সালের অক্টোবর থেকে সকল দেশের নাগরিকদের এই সুবিধা দেওয়া হয়৷ এক্ষেত্রে যে কোনো একজনকে কমপক্ষে তিন মাস বেলজিয়ামে থাকতে হবে৷ ২০০৬ সাল থেকে সমকামী পুরুষ এবং নারীকে সন্তান দত্তক নেওয়ার সুবিধাও প্রদান করা হয় বেলজিয়ামে৷
ছবি: picture-alliance/dpaখোসে লুইস রোদ্রিগেজ সাপাতেরো-র সমাজতন্ত্রী সরকারের মেয়াদকালে পৃথিবীর তৃতীয় দেশ হিসেবে স্পেন সমকামীদের মধ্যে বিয়ে বৈধ করে৷ ফ্রান্সের মতো সেদেশেও ক্যাথলিকদের শক্ত অবস্থান রয়েছে৷ তা সত্ত্বেও ২০০৫ সালের জুলাই মাসে স্পেনে এ ধরনের বিয়ে বৈধ করা হয়৷ ২০১০ সাল থেকে পর্তুগালও একই পথের পথিক হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpaআইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইওয়াহানা সিগুরডোটির এবং তাঁর সঙ্গিনী ইওহিনা লিওসডোটির সমকামীদের বিয়ে বৈধ ঘোষণার পর প্রথমেই সেই সুযোগ নিয়েছেন৷ সিগুরডোটির হচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম মেয়ে সমকামী রাষ্ট্রপ্রধান৷ ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি৷ এরপর ২০১০ সালে সেদেশে সমকামীদের বিয়ে বৈধ করা হলে সঙ্গিনী লিওসডোটিরকে বিয়ে করেন সিগুরডোটির৷
ছবি: Getty Imagesসমকামীদের অধিকারের বিষয়ে আইনিভাবেই সচেতন স্ক্যান্ডিনেভিয়া৷ সুইডেনে ২০০৯ সালে সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে বৈধ করা হয়৷ পুরুষ এবং নারী সমকামী যুগল সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে সেদেশে কোনো বাধা নেই৷ নরওয়ে ২০০৮ সালে এ সংক্রান্ত এক বিল অনুমোদন করেছে৷ ২০১২ সালের গ্রীষ্ম থেকে ডেনমার্কেও সমকামীদের বিয়ে বৈধ করা হয়েছে৷ ফিনল্যান্ডও এ ধরনের বিয়েকে বৈধতা প্রদানের পথে রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpaএই ছবিটি গত শতকের ৮০-র দশকের৷ এতে দেখা যাচ্ছে, সমকামীদের অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করছেন একদল মানুষ৷ এরপর অনেকদিন পেরিয়েছে৷ যুক্তরাজ্যে সমলিঙ্গের পুরুষ বা নারী যুগল সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি রয়েছে৷ ২০০৫ সাল থেকে রয়েছে এই প্রথা৷ তবে চার্চে সমলিঙ্গের নারী বা পুরুষ বিয়ে করতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP২০০১ সাল থেকে সমলিঙ্গের যুগলের রেজিস্ট্রেশন বৈধ করেছে জার্মানি৷ এই প্রক্রিয়ায় জার্মানিতে বিয়ের সুযোগ সুবিধার অনেকটাই পান সমকামীরা৷ কিন্তু যৌথভাবে সন্তান দত্তক নেওয়া কিংবা পূর্ণ আয়কর সুবিধা এখনো পায়না সমকামী দম্পতিরা৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, জার্মানির ৬৬ শতাংশ জনসাধারণই সমকামীদের বিয়ের পক্ষে৷
ছবি: picture-alliance/dpaতবে ইউরোপের পর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি ভিন্ন৷ সেখানকার সমাজে সমকামী নারী বা পুরুষকে ভালোভাবে গ্রহণ করা হয়না৷ লিথুনিয়া, পোল্যান্ডের মতো লাটভিয়াতেও বিষমকামী দম্পতির মতো সমান অধিকার পায় না সমকামী দম্পতি৷ পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ জনগণই সমকামীদের বিয়ের বিপক্ষে৷
ছবি: Reutersরাশিয়ার সংসদ সম্প্রতি শিশুদের মাঝে ‘সমকামীদের প্রচারণা’ নিষিদ্ধ করেছে৷ আর আগেই অবশ্য সেন্ট পিটার্সবুর্গের (ছবিতে) মতো বিভিন্ন শহরে সমকামিতাকে উৎসাহ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ নতুন এই আইনের ফলে সমকামীদের অধিকার বিষয়ক প্রচারণা রাশিয়ায় অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং আয়োজকদের জরিমানা হবে৷ বলাবাহুল্য, রাশিয়াতে সমকামীদের বিয়ে বৈধ নয়৷
ছবি: Dmitry Lovetsky/AP/dapd
সমকামী, উভলিঙ্গ কিংবা যৌন সংখ্যালঘুরা প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হন৷ পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে গেলে হাস্যাস্পদ হতে হয় তাঁদের৷ এমনকি কারাবন্দি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷
সমকামিতাকে অবৈধ করার ফলে অনেক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও ঘটছে৷ যেমন এইডস দমনে সাফল্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷ উগান্ডার নতুন আইনের কারণে চিকিত্সকরা এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন৷ সমকামীদের সংস্পর্শে এলেও কারাদণ্ডের ঝুঁকি থাকে৷ একারণে এইডস দমনে প্রচারণা ও পরামর্শদান অসম্ভব হয়ে পড়ছে৷
উগান্ডার সাফল্য এখন স্তিমিত
এইডস প্রতিরোধে উগান্ডা একসময় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিল৷ এই সাফল্য এখন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করছে জাতিসংঘ৷ পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, যেসব দেশ সমকামীদের অপরাধী হিসাবে গণ্য করে, সেসব দেশে এইচআইভি সংক্রমণের হারও বেশি৷
সম্প্রতি জাম্বিয়াস্থ ‘আফ্রিকান কমিশন অন হিউম্যান রাইটস'-এর পক্ষ থেকে একটি নীতিমালা গ্রহণ করা হয়৷ এতে বলা হয়, সমকামীরা অন্য আফ্রিকানদের মতোই সমান সুরক্ষা ভোগ করার দাবি রাখেন৷ এই নীতিমালায় সমকামীদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আফ্রিকার দেশগুলির প্রতি আহ্বান জানানো হয়৷ বলা হয় মানবাধিকার কর্মীরা যাতে তাদের কাজকর্মের জন্য বৈষম্যের শিকার না হন তা নিশ্চিত করতে৷
নীলা ঘোষাল এই নীতিমালাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এটা এক বিরাট অগ্রগতি৷ এই প্রথম আফ্রিকান কমিটি আফ্রিকাব্যাপী সমকামীদের বিরুদ্ধে সহিংস আচরণের নিন্দা জানালো৷
আশার আলো
আফ্রিকান সমকামী আন্দোলনগুলি এই নীতিমালা প্রণয়নে চাপ সৃষ্টি করেছে, তৈরি করেছে খসড়া, বলেন নীলা ঘোষাল৷
এক্ষেত্রে পশ্চিমের কোনো প্রভাব ছিল না বলে জানান আফ্রিকান কমিশনের সদস্য বেনিনের রেইনে আলাপিনি গানসু৷ তাঁর কথায়, ‘‘কেউ বলতে পারে না যে, সমকামিতা পশ্চিমের আবিষ্কার, আফ্রিকা এর ব্যতিক্রম৷ সবার জানা উচিত, সমকামিতা একটি মানবিক দিক৷ আফ্রিকান দেশগুলির দায়িত্ব নাগরিকদের শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা দেওয়া, নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করা৷ যা প্রযোজ্য হবে সকলের জন্যই৷''