বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার হত্যা মামলায় বুয়েটেরই ২০ শিক্ষার্থীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস কমাতে কি কোনো ভূমিকা রাখবে?
বিজ্ঞাপন
এই মামলায় বুয়েটের আরো পাঁচজন শিক্ষার্থীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
বুধবার দেয়া রায়ে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু জাফর কামরুজ্জামান বলেছেন, শিবির সন্দেহে আবরার ফাহাদ রাব্বির বিরুদ্ধে মিথ্যা , বানোয়াট, ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, যা বাংলাদেশের মানুষকে ব্যথিত করেছে। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ রাব্বির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনার পনুরাবৃত্তি যাতে না হয়, এমন ঘটনা রোধকল্পে এই ট্রাইব্যুনালে সকল আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, "আমি চাই এই রায় যেন উচ্চ আদালতেও বহাল থাকে, তাহলে এটা একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। সেটা হলে শুধু বুয়েট নয়, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং, মারপিট,দখল- এসব বন্ধ হবে। আর কোনো ছাত্রকে শিক্ষাঙ্গনে প্রাণ দিতে হবে না।”
বরকত উল্লাহ
তিনি বলেন, "যাদের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ হয়েছে, তারা তো অপরাধী। কিন্ত দায় আমাদেরও রয়েছে। আমরা তাদের ঠিকমতো পরিচালিত করতে পারিনি। ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারিনি। সেটা পারলে আমার ছেলেকেও হয়তো জীবন দিতে হতো না। এই ২০ জন ছাত্রেরও ফাঁসি হতো না।”
তার কথা, " রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষাঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, দখলদারিত্ব বজায় রাখতে চায়, যার পরিণতি এটা। আমি এর অবসান চাই। ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করুক।”
বুয়েটের উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার মনে করেন, এই রায় সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই একটি বার্তা দেবে, ছাত্রদের আরো সতর্ক করবে। তিনি বলেন, "এটা আমাদেরও মেসেজ দেবে। ছাত্রদের ঠিকমতো অ্যাডভাইস করতে হবে। তাদের মনিটরিং-এর মধ্যে রাখতে হবে। আমাদের দেশে অ্যাকাডেমিক অ্যাডভাইজিং আছে। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে অ্যাডভাইজিং নেই। এটা প্রয়োজন। এটা করতে হবে। হল প্রোভোস্ট, হাউস টিউটরদের ছাত্রদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে খোঁজ রাখতে হবে। তারা কী করে তা জানতে হবে। তাদের ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ দিতে হবে। ক্যারিয়ার অ্যাডভাইজিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে।”
এই মামলায় বাদী পক্ষের আইনজীবী আবু আব্দুল্লাহ মনে করেন, শুধু শিক্ষাঙ্গন নয় আরো অনেক ক্ষেত্রেই এই মামলার রায়ের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন ,"শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক হত্যা মামলারই বিচার ঝুলছে। কিন্তু এই মামলায় ৬০ জনের মধ্যে ৪৬ জন সাক্ষী দিয়েছেন। ছয় জন সাফাই সাক্ষী দিয়েছেন। হলের কর্মচারিও সাক্ষী দিয়েছেন। চিকিৎসক সাক্ষী দিয়েছেন। ফলে ভবিষ্যতে অন্যান্য মামলায়ও সাক্ষীরা সহজেই নির্ভয়ে সাক্ষী দেবেন। আর সঠিক সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলে যে বিচার পাওয়া যায় তা প্রমাণ হলো।”
আসামিদের আইনজীবীরা যদিও মনে করেন তারা ন্যায় বিচার পাননি, তারা এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন, তারপরও তারা মনে করেন, এই হত্যাকাণ্ডে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতি ব্যর্থতা আছে। আসামিদের একজন আইনজীবী আমিনুল গনি টিটু বলেন, " যিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এবং যে ২০ জনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে, তারা সবাই বুয়েটের মেধাবী ছাত্র। ওই ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। তাহলে বুয়েটে?র হলের প্রভোস্ট, হাউজ টিউটররা কী করেছেন? তারা দায় এড়াবেন কীভাবে? আর যদি কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা ও রাজনীতি দেশে থাকে, তার প্রভাব সবখানে পড়ে। এই বিষয়গুলো নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে।”
তার মতে, "শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র্যাগিং-এর নামে, রাজনীতির নামে নানা নির্যাতন, অন্যায় হয়। এর দায় সবাইকে নিতে হবে।”
আর এই রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বড় ভাইদের "বড়ভাইগিরি” বন্ধ করবে বলে মনে করেন রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল।
ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক নৃশংসতা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক নৃশংস ঘটনার জন্ম দিয়েছে ছাত্রলীগ৷ বিশ্বজিৎ থেকে আবরার পর্যন্ত তাদের নির্যাতনে মারা গেছে বেশ কয়েকজন৷ কেউ হারিয়েছেন দৃষ্টি, কারো ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে শরীরের হাড়৷ বিচার হয়নি অনেক ঘটনারই৷
ছবি: bdnews24.com
দখলবাজির শিকার আবু বকর
২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলে সিট দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন মেধাবী ছাত্র আবু বকর৷ ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী শক্ত ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে আবু বকরের মাথা থেঁতলে দেয়া হয়৷ এই হত্যার ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা হয়৷ ২০১৭ সালে আদালতের রায়ে ছাত্রলীগের অভিযুক্ত ১০ নেতা-কর্মীর সবাই বেকসুর খালাস পায়৷ (ছবি: সাম্প্রতিক)
ছবি: bdnews24.com
খাবার নিয়ে বিরোধে হত্যা
২০১০ সালে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ইফতারের টোকেন সংঘর্ষ বাধে রাজশাহী ছাত্রলীগের মধ্যে৷ তার জের ধরে দলটির কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে পিটিয়ে শাহ মখদুম হলের দ্বিতীয় তলা থেকে ফেলে দেয়া হয়৷ ১০ দিন হাসপাতালে থাকার পর তার মৃত্যু হয়৷ এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় ১০ জন, যাদের সবাই এখন জামিনে৷
ছবি: DW/A. Khanom
জুবায়েরকে কুপিয়ে হত্যা
২০১২ সালে জানুয়ারিতে মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের৷ তাকে পরিকল্পিতভাবে কুপিয়ে হত্যা করে তারই সংগঠনের প্রতিপক্ষরা৷ এই মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০১৫ সালে পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ছয় জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন৷ গত বছরের জানুয়ারিতে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড ও দুজনের যাবজ্জীবন বহাল রাখে হাইকোর্ট৷ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে চারজনই পলাতক৷
ছবি: bdnews24.com
দুর্ভাগা বিশ্বজিৎ
বিশ্বজিৎ দাস ছিলেন পুরান ঢাকার একজন দর্জি৷ ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নৃশংস হামলায় তাঁর মৃত্যু হয়৷ সেসময় ১৮ দলের অবরোধ চলছিল৷ বিশ্বজিৎ শিবির কর্মী এমন ধারণা করে তাঁকে চাপাতি, কিরিচ দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে কোপায় ছাত্রলীগ কর্মীরা৷ আলোচিত এই ঘটনায় নিম্ন আদালতে আট আসামির মৃত্যুদণ্ড হলেও চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন, দুইজনকে খালাস আর পলাতক দুইজনের রায় বহাল রাখে হাইকোর্ট৷
ছবি: bdnews24.com
বাদ যায়নি শিশুও
২০১৩ সালে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয় মারা যায় ১২ বছরের শিশু রাব্বি৷
ছবি: bdnews24.com
আধিপত্য বিস্তারের বলি তাপস
২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র তাপস সরকার৷ ২০১৬ সালে এই ঘটনায় ২৯ নেতাকর্মীর নামে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ৷ মূল আসামী আশরাফুজ্জামানসহ গ্রেপ্তারকৃত ১৫ জনই জামিনে পান৷ (ছবি: প্রতীকী)
ছবি: Fotolia/Scanrail
খাদিজার মৃত্যুর কাছ থেকে ফেরা
২০১৬ সালের ৩ অক্টোবরের ঘটনা৷ এমসি কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়ে বের হবার পরই খাদিজা আক্তার নার্গিসকে চাপাতি দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি)-র ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলম৷ নার্গিসকে মৃত ভেবে পালিয়ে যাওয়ার সময় পথচারীরা বদরুলকে আটক কোরে পুলিশে দেয়৷ আলোচিত এই ঘটনায় বদরুলের যাবজ্জীবন সাজার রায় দিয়েছে আদালত৷
ছবি: bdnews24.com
হেলমেট বাহিনীর হামলা
গত বছর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় হেলমেট পরিহিত সশস্ত্র কিছু যুবক ধানমন্ডি, জিগাতলা এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় পুলিশের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থী এবং সাংবাদিকদের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা করে৷ হামলাকারীরা ছাত্রলীগের কর্মী বলে বিভিন্ন গনমাধ্যমে পরিচয় সহ খবর বের হয়৷ কিন্তু এই ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, কারও বিচারও হয়নি৷
ছবি: Bdnews24.com
হাতুড়ি মামুনদের বিচার হয়নি
দেশব্যাপী কোটা আন্দোলনের সময় বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ ওঠে৷ তেমনই একটি ঘটনা ঘটে গত বছরের ২ জুলাই৷ তরিকুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থীকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের রাস্তায় পেটায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী৷ তাকে হাতুড়ি পেটা করে দলটির সহ-সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল-মামুন৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷
ছবি: bdnews24.com
চোখ হারানো এহসান
গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলে এহসান নামের এক ছাত্রকে পিটিয়ে আহত করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা৷ নিজের ক্যালকুলেটর ফেরত চাইলে এই হামলা চালায় তারা৷ এসময় তাকে শিবির কর্মী বলেও অপবাদ দেয়া হয়৷ হামলায় এহসানের চোখের কর্নিয়া গুরুতর জখম হয়৷ ঘটনায় ছাত্রলীগের ৭ নেতা-কর্মী বিভিন্ন মেয়াদে বহিস্কার হলেও তারা হলে থাকতেন বলে খবর বের হয়৷ অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতায় দেশ ছাড়ে এহসান৷
ছবি: bdnews24.com
আহ্ আবরার!
সবশেষ ৭ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে ছাত্রলীগের নৃশংসতার শিকার হল বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ৷ রাত ২টার দিকে শেরে বাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এই ছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতারা আগের দিন সন্ধ্যায় তাকে রুম থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে৷ আবরারের বাবা বরকতুল্লাহ ১৯ জনকে আসামি করে মামলা করেন, যার মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ১০ জন ৷
ছবি: bdnews24
১০ বছরে ২৪ হত্যা
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী গত ১০ বছরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে৷ যার প্রায় সবগুলোর সাথেই ছাত্রলীগ জড়িত রয়েছে৷ এর মধ্যে ১৭ টিই ঘটেছে নিজেদের অন্তর্কোন্দলে৷ সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ গত ১০ বছরে সেখানে ৮ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে৷
ছবি: bdnews24
ইচ্ছে হলেই মারধর, হামলা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচীতে ইচ্ছে হলেই হামলা চালায় ছাত্রলীগ কর্মীরা৷ কোটা আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন সময় মারধর করেছে সংগঠনটির নেতা কর্মীরা৷ গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের আন্দোলনেও ছাত্রলীগের হামলা এবং ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনা ঘটে৷ একাধিকবার তাদের হামলার শিকার হয়েছেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর৷