কালিমালিপ্ত ভারতীয় ক্রিকেট!
৩০ মে ২০১৮ক্রিকেট ও ম্যাচ ফিক্সিং যেন সমার্থক! আবারও কালিমালিপ্ত হলো ক্রিকেট৷ সেইসঙ্গে ফের নাম জড়ালো ভারতের৷ তবে শুধু ভারত নয়, বেশ কয়েকটি দেশ জুড়ে ম্যাচ গড়াপেটা হয়েছে বলে দাবি করেছে দোহাভিত্তিক সংবাদ চ্যানেল আল জাজিরা৷ কয়েকদিন আগে ‘আ ডকুমেন্টারি অন ক্রিকেট করাপশন’- নামে একটি তদন্তমূলক প্রামাণ্যচিত্রে তথ্য প্রমাণসহ ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ওপর আলোকপাত করেছে ওই চ্যানেলটি৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইচ্ছেমতো ক্রিকেটের পিচ তৈরি করানো থেকে শুরু করে গত তিন বছরে ইচ্ছেমতো খেলানো হয়েছে ক্রিকেটারদের৷ যে ক'টি দেশে এই কাণ্ডগুলি ঘটেছে তারমধ্যে ভারতও রয়েছে৷ প্রশ্ন উঠছে, তবে কি ক্রিকেটে ম্যাচ গড়াপেটার কলঙ্কিত অধ্যায় আবার ফিরে এলো ভারতে?
ক্রিটেটে ম্যাচ গড়াপেটা নিয়ে চিন্তিত হলেও এমন অভিযোগ প্রমাণ করা নিয়ে বেজায় সংশয় রয়েছে ক্রিকেট কোচ, ‘ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল’-এর প্রাক্তন প্রশাসক এবং ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন নির্বাচক সম্বরণ ব্যানার্জির৷ তিনি নির্বাচক থাকাকালীনই ভারতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ পেয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী৷ আল জাজিরার ক্রিকেট-বোমা নিয়ে ডয়চে ভেলেকে সম্বরণ বললেন, ‘‘যাঁকে নিয়ে বিতর্ক, সেই রবিন মরিসকে আমি ভালো করে চিনি৷ মুম্বাইয়ের হয়ে খেলেছেন৷ এতদিন পরে এটা নিয়ে কেন কথা হচ্ছে? তাছাড়া এর প্রমাণ কী আছে? ম্যাচ ফিক্সিং কীভাবে প্রমাণ হবে? এই ধরনের অভিযোগ কেউ প্রমাণ করতে পারেনি৷ পুরো বিষয়টি অদ্ভুত লাগছে৷ আইসিসি-র তদন্তে বিসিসিআই নজর রাখছে৷ দেখা যাক৷’’
আরও জানালেন, ‘‘ম্যাচ ফিক্সিং যখনতখন হতে পারে৷ কিন্তু, এটা প্রমাণ হবে কীভাবে? এটাই বড় সমস্যা৷ হতে পারে প্রচারের জন্য বা অন্য কোনও কারণে এই ধরনের অভিযোগ ওঠে৷ মনে রাখতে হবে, গোটা বিশ্বে অনেক ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ উঠলেও হ্যান্সি ক্রোনিয়ে ছাড়া আর কেউই অভিযোগ স্বীকার করেননি৷ ফলে, সমস্যাটা কোথায় তা বুঝতে হবে৷’’
এক প্রশ্নের জবাবে সম্বরণ আরও বললেন, ‘‘ভারতের উদীয়মান ক্রিকেটারদের জন্য এই ধরনের ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক৷ খারাপ একটা বিজ্ঞাপন৷ কেউ যদি দুটো বল ওয়াইড করে বা একটা বল নো-বল করে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যায়, তবে তা ক্রিটেটের জন্য সর্বনাশের শামিল৷’’
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ক্রিকেটে ম্যাচ-ফিক্সিং এক লোভনীয় ব্যবসা৷ আন্তর্জাতিক স্তরে যে কোনও ক্রিকেট ম্যাচ-ফিক্সিং এবং দুর্নীতি দ্বারা পরিব্যাপ্ত হতে পারে৷ আল জাজিরার সাংবাদিক ডেভিড হ্যারিসন সেই প্রামাণ্যচিত্রে দাবি করেছেন, গত তিন বছরে ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটি করে ম্যাচে ফিক্সিংয়ে জড়িত ছিল ভারতীয়রা৷ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে চেন্নাইয়ে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট ম্যাচ, গত জুলাইয়ে গলে ভারত-শ্রীলঙ্কা টেস্ট এবং ২০১৭ সালের মার্চে রাঁচিতে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার টেস্টে ক্রিকেট জুয়াড়িদের ভূমিকা ছিল বলে তাদের দাবি৷ ২০১৭-এর ২৬ থেকে ২৯ জুলাই গলে ভারত-শ্রীলঙ্কা, ওই বছরেই ১৬ থেকে ২০ মার্চ রাঁচিতে ভারত-অস্ট্রেলিয়া এবং ২০১৬ সালের ১৬ থেকে ২০ ডিসেম্বর চেন্নাইয়ে ভারত-ইংল্যান্ডের মধ্যে হওয়া টেস্ট ম্যাচগুলি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে৷ এরমধ্যে প্রথম ও শেষ ম্যাচটি জিতেছিল ভারত৷ কিন্তু, দ্বিতীয় ম্যাচটি ড্র হয়েছিল৷ এখানেই শেষ নয়৷ আগামী নভেম্বর ওই একই স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট খেলবে শ্রীলঙ্কা, সেই ম্যাচের পিচটিও ইচ্ছেমতো তৈরি করার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন এক গ্রাউন্ডসম্যান৷ এবার যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার হাসান রাজা, ভারতের প্রথম শ্রেণীর সাবেক ক্রিকেটার রবিন মরিস ও তিন শ্রীলঙ্কান৷ গল স্টেডিয়ামের কিউরেটর থারাঙ্গা ইন্ডিকার নামটিও উঠে এসেছে৷ তিনি নিজেই জুয়াড়িদের কাছ থেকে মোটা টাকা নিয়ে তাদের কথামতো পিচ তৈরি করার কথা স্বীকার করেছেন৷ বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই তদন্ত শুরু করেছে আইসিসি৷ আইসিসি-র তদন্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বিসিসিআই৷
ভারতীয় ক্রিকেটার লক্ষ্মীরতন শুক্লার কথায়, ‘‘কেউ অভিযুক্ত হলেই তাঁর বিরুদ্ধে মন্তব্য করা উচিত নয়৷ এটা স্পর্শকাতর বিষয়৷ কারও নাম নিয়ে অপপ্রচার করা ঠিক নয়৷ এই ঘটনায় ভারতীয় ক্রিকেটে কোনও প্রভাব পড়বে না৷ তাছাড়া বিদেশি সংবাদমাধ্যম কী বলল, তাতে আমার মাথাব্যাথা নেই৷ আইসিসি এবং বিসিসিআই অনেক বেশি সংবেদনশীল৷ তারা আগে প্রমাণ করুক৷ তারপর দেখা যাবে৷ আমি চাই, অভিযোগ আগে প্রমাণিত হোক৷ তারপর কঠোর শাস্তির দাবি জানাবো৷’’
এদিকে, আল জাজিরার স্টিং ভিডিও সামনে আসার পর অনেকেই অভিযুক্ত রবিন মরিসের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন৷ তাঁর পুরোনো বন্ধুদের কেউ কেউ বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে আচমকাই জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন মরিস৷ এমনকি বেশ কয়েকবার দুবাই পাড়ি দিয়েছিলেন বিনা কারণে৷ আল জাজিরার দাবি, ম্যাচ ফিক্সিংয়ে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রবিন মরিস৷ তিনিই নাকি ইন্ডিকাকে বুঝিয়ে বুকিদের মনের মতো পিচ বানিয়েছিলেন৷ এর জন্য ইন্ডিকাকে ভারতীয় মুদ্রায় ২৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল৷ একটি হোটেলের ঘরে মরিসের সঙ্গে কথা বলার সময় ইন্ডিকাকে বলতে শোনা গেছে, ‘‘স্পিন বোলিং, পেস বোলিং বা ব্যাটিং, যেরকম পিচ চাইবেন আমরা বানিয়ে দেবো৷’’ তবে, ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর অবশ্য সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইন্ডিকা৷ বলেছেন, আল জাজিরার সাংবাদিকদের বিদেশি পর্যটক মনে করে ওই কথাগুলো বলেছিলেন তিনি৷ এদিকে, বিতর্ক মাথাচাড়া দিতেই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন মরিস৷ তাঁর মোবাইল ফোনটিও বন্ধ রয়েছে৷ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা বলছেন, এই বিষয়ে আইসিসি-র তদন্তে তাঁদের আস্থা আছে। তদন্তে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে বলেও জানিয়েছে বিসিসিআই৷ কিন্তু, পুরো ঘটনায় রবিন মরিসের নাম জড়ানোর বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বোর্ডের দুর্নীতিদমন শাখা৷ যেহেতু মরিস এখন বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত নন তাই তাকে সরিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না৷ তবে, ক্রিকেটারের পেনশন হিসেবে মাসে ২২,৫০০ টাকা পেয়ে থাকেন৷ অভিযোগ প্রমাণিত হলে সেই পেনশন বন্ধ করে দিতে পারে বোর্ড৷
শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডও এই তদন্তে সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে৷ তদন্ত শুরুও করেছে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ড৷ তারা বলেছে, ক্রিকেট-দুর্নীতিতে কোনওরকম আপোষ করবে না শ্রীলঙ্কা৷ কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তৎক্ষণাৎ কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে৷
আল জাজিরা চ্যানেলের কাছে পুরো স্টিং অপারেশনের ‘র’ ভিডিও ফুটেজ চেয়ে পাঠিয়েছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া৷
তবে ক্রিকেটে ম্যাচ গড়াপেটা প্রমাণ হোক বা না হোক, আল জাজিরা টিভির এই প্রামাণ্যচিত্রে গোটা ক্রিকেট বিশ্বে ভূমিকম্প ঘটেছে৷