সরকার একমাসের মধ্যেই একবার গ্যাসের দাম এবং দুইবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ফেললো নির্বাহী আদেশে৷ ফলে খুচরায় গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে দাঁড়াবে ৭ টাকা ৮৫ পয়সা, যা আগে ৭ টাকা ৪৮ পয়সা ছিল৷ আর ভারিত গড়ে পাইকারি বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের দাম ৬ টাকা ২০ পয়সা থেকে বেড়ে হচ্ছে ৬ টাকা ৭০ পয়সা৷

সোমবার বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসের বিদ্যুৎ বিলের ক্ষেত্রে নতুন এই মূল্যহার কার্যকর হবে৷

ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, "ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য বিদ্যুতের খুচরা গ্রাহকদের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্নভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে৷ তাতে খুচরায় গড়ে ৫ শতাংশ দাম বেড়েছে৷

"এছাড়া পাইকারিতেও ২৩০ কেভি লাইন, ১৩২ কেভি লাইন ও ৩৩ কেভি লাইনের জন্য বিতরণ সংস্থাভেদে বিভিন্ন রকম দাম ঠিক করা হয়েছে৷ তাতে গড়ে ৮ দশমিক ০৬ শতাংশ দাম বেড়েছে৷ "

গত ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দর ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়িয়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা ঠিক করেছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বিইআরসি৷ আড়াই মাসের মাথায় সরকার নির্বাহী ক্ষমতাবলে তা আরও ৮ দশমিক ০৬ শতাংশ বাড়ালো৷

আগে বছরে সর্বোচ্চ একবার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুযোগ পেত নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বিইআরসি৷ পরে নীতি পরিবর্তন করে বছরে একাধিকবার মূল্য সমন্বয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়৷

সেখান থেকে আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে গণশুনানি এড়িয়ে সরাসরি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের পথ সুগম করা হয় গত বছরের শেষে৷ পরে একমাসের মধ্যেই একবার গ্যাসের দাম এবং দুইবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ফেললো সরকার৷ 

সর্বশেষ ১২ জানুয়ারি খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়, তাতে ভারিত গড়ে প্রতি ইউনিটের দাম দাঁড়ায় ৭ টাকা ৪৮ পয়সা, যা জানুয়ারি মাসের বিলের সঙ্গে কার্যকর হওয়ার কথা৷ এরপর ফেব্রুয়ারির জন্য তা আরও ৫ শতাংশ বাড়ল৷

ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা আগেই জানিয়েছিলেন৷

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সোমবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন,  "প্রত্যেক মাসেই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করার কথা আমরা আগেই বলেছিলাম৷ আগামী মাসে বিদ্যুতের দাম আরেকবার সমন্বয় করতে হবে৷ আমাদের আর ভর্তুকি দেওয়ার সুযোগ নেই৷ এখন এভাবে সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই যেতে হবে৷”

দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, "আমরা আগেই বলেছি, ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দাম বাড়াতে হবে৷ আমরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে প্রয়োজনে মাসে মাসে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করবে৷ সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশেও কমবে৷”

শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম গত ১৮ জানুয়ারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার৷ তবে বাড়তি দর আপাতত কার্যকর না করে আরও কিছুটা সময় নেওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী৷

খুচরায় দাম বাড়ল যেভাবে

প্রজ্ঞাপনে বিদ্যুৎ সরবরাহের নিম্ন, মধ্যম, উচ্চ ও অতি উচ্চ চাপ অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রাহক শ্রেণির বিদ্যুতের মূল্য (এনার্জি রেট বা চার্জ) নির্ধারণ করা হয়েছে৷ এর সঙ্গে গ্রাহককে শ্রেণি অনুযায়ী প্রতিটি সংযোগের বিপরীতে ডিমান্ড রেট এবং মোট বিলের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়৷

জানুয়ারিতে খুচরা পর্যায়ে ডিমান্ড চার্জও ৫ টাকা থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল৷ ফেব্রুয়ারির জন্য ওই হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে৷

প্রজ্ঞাপনে চাপ অনুযায়ী আবাসিক, সেচ বা কৃষিকাজে ব্যবহার করা পাম্প, ক্ষুদ্র শিল্প, নির্মাণ, শিক্ষা, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল, ব্যাটারি চার্জিং স্টেশন, বাণিজ্যিক ও অফিস, শিল্প গ্রাহক শ্রেণিতে নতুন হার নির্ধারণ করা হয়েছে৷

তাতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম সর্বনিম্ন ৪ টাকা ১৪ পয়সা এবং সর্বোচ্চ ১৭ টাকা ৬৪ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে৷

বর্ধিত দর অনুযায়ী একজন গ্রাহক ফেব্রুয়ারিতে লাইফলাইনে (৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহার) বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য ইউনিট প্রতি (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) দেবেন সর্বনিম্ন ৪ টাকা ১৪ পয়সা, যা জানুয়ারিতে ছিল ৩ টাকা ৯৪ পয়সা৷ আর প্রতি ইউনিটে সর্বোচ্চ ১৭ টাকা ৬৪ পয়সা দিতে হবে অস্থায়ী বাণিজ্যিক বা অফিসে বিদ্যুৎ খরচের জন্য, যা জানুয়ারিতে ছিল ১৬ টাকা ৮০ পয়সা৷

নিম্ন চাপের আবাসিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশি সাধারণ ৭৫ থেকে ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়ে থাকে৷ এসব গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার হলে প্রতি ইউনিটের দর হবে ৪ টাকা ৬২ পয়সা (আগে ৪ টাকা ৪০ পয়সা); ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট হলে প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৩১ পয়সা (আগে ছিল ৬ টাকা ০১ পয়সা); ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট হলে প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৬২ পয়সা (আগে ছিল ৬ টাকা ৩০ পয়সা) ৷

এর বাইরে আবাসিকে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীরা ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিট হলে প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৯৯ পয়সা (আগে ছিল ৬ টাকা ৬৬ পয়সা); ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিট ১০ টাকা ৯৬ পয়সা (আগে ছিল ১০ টাকা ৪৪ পয়সা) এবং ৬০০ ইউনিটের ঊর্ধ্বে ১২ টাকা ৬৩ পয়সা (আগে ছিল ১২ টাকা ০৩ পয়সা) করা হয়েছে৷

নতুন মূল্যহারে সেচ বা কৃষি কাজের জন্য ব্যবহৃত পাম্পের বিদ্যুতের জন্য দিতে হবে ৪ টাকা ৫৯ পয়সা৷ এক্ষেত্রে আগের দর ৪ টাকা ৩৭ থেকে বাড়ানো হয়েছে ১২ পয়সা৷

ক্ষুদ্র শিল্পে ফ্যাট রেট করা হয়েছে ৯ টাকা ৪১ পয়সা (আগে ছিল ৮ টাকা ৯৬ পয়সা); অফ পিকে ৮ টাকা ৪৬ পয়সা ( আগে ছিল ৮ টাকা ০৬ পয়সা) এবং পিক আওয়ারে ইউনিটপ্রতি দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১ টাকা ২৯ পয়সা (আগে ১০ টাকা ৭৫ পয়সা ছিল) ৷

বাণিজ্যিক ও অফিসের ক্ষেত্রে ফ্ল্যাট রেট ১১ টাকা ৩৬ পয়সা (আগে ছিল ১০ টাকা ৮২ পয়সা); অফপিক ১০ টাকা ২২ পয়সা (আগে ছিল ৯ টাকা ৭৩ পয়সা) এবং পিক ১৩ টাকা ৬৩ পয়সা (আগে ছিল ১২ টাকা ৯৮ পয়সা) ৷ এছাড়া মধ্যম, উচ্চ ও অতি উচ্চ চাপে এসব শ্রেণির গ্রাহকদের প্রতি ইউনিটের জন্য আরও বেশি টাকা গুনতে হবে৷

অপরদিকে উচ্চ চাপে শিল্পের জন্য ফ্ল্যাট রেট ধরা হয়েছে ৯ টাকা ৩১ পয়সা (আগে ছিল ৮ টাকা ৮৭ পয়সা), অফি পিকে ৮ টাকা ৩৯ পয়সা (আগে ছিল ৭ টাকা ৯৯ পয়সা) এবং পিক আওয়ারে ১১ টাকা ৬৪ পয়সা (আগে ১১ টাকা ০৯ পয়সা ছিল) ৷ 

পাইকারিতে যে হারে বাড়ছে

নতুন মূল্য হারে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলোর কাছে বিক্রি করবে গড়ে ৬ টাকা ৭০ পয়সায়, যা জানুয়ারিতে ৬ টাকা ২০ পয়সা ছিল৷

মোট ছয় কোম্পানির ২৩০ কেভি, ১৩২ কেভি ও ৩৩ কেভি লাইনের জন্য পৃথক ট্যারিফ ঠিক করা হয়েছে৷

• নতুন পাইকারি মূল্যহার অনুযায়ী শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত ডেসকোর ৩৩ কেভি লাইনে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে সর্বোচ্চ ৮ টাকা ২৪ পয়সা, যা আগে ৭ টাকা ৭৪ পয়সা ছিল৷
• আর ডিপিডিসির ৩৩ কেভি লাভনের বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ৮ টাকা ২২ পয়সা, যা এতদিন ছিল ৭ টাকা ৭২ পয়সা৷
• বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সমিতিগুলোর ৩৩ কেভি লাইনের জন্য প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ৫ টাকা ৯০ পয়সা যা, পাইকারি বিদ্যুতের সর্বনিম্ন দর৷ এতদিন এই দর ছিল ৫ টাকা ৩৯ পয়সা৷

এনএস/কেএম (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)