কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর আবারো হামলা হয়েছে৷ হামলা থেকে চারজন শিক্ষকও রেহাই পাননি৷ হামলার শিকার একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছেন৷
বিজ্ঞাপন
কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে রবিবার সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ ছিল৷ আর এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ৷ তারা মাইক লাগিয়ে পাল্টা কর্মসূচি পালন শুরু করে৷ কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে ওই প্রতিবাদে অংশ নেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. তানজিম উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ছাত্রলীগের ছেলেরা মাইকে আমাদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকে৷ এমনকি আমার দিকে টাকা ছুড়ে মেরে আমাকে বলে আমি নাকি জামায়াতের টাকা খেয়ে আন্দোলন করি৷ এই পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের একজন ছাত্রকে তারা ব্যাপক মারপিট করে৷ আমরা এর প্রতিবাদ জানাতে উপচার্যের অফিসের দিকে রওয়ানা হলে আমাদের ঘেরাও করে হামলা চালানো হয়৷ আমরা মোট চারজন শিক্ষক ছিলাম৷ আর ছাত্ররা ছিল৷ হামলাকারীদের মধ্যেই আমাদের যারা পরিচিত ছাত্র ছিল, তারা আমাদের রক্ষা করে৷ ১০-১৫ জন ছাত্র আহত হয়৷''
DR Tabzim Uddin - MP3-Stereo
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘আমার মনে হয়েছে হামলাটি পূর্ব পরিকিল্পিত৷ কারণ, যখন আমাদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও হামলার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিলো, তখন ভিসি ও প্রক্টর দু'জনকেই ফোন করি৷ কিন্তু তাঁদের মেবাইল ফোন বন্ধ ছিল৷ কিন্তু হামলা শেষ হওয়ার পর আমি প্রক্টরকে ফোনে পাই৷ তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্য উল্টো আমাদেরই দায়ী করেন৷ তাঁর এই কথা আমাকে মানসিক পীড়ণের মধ্যে ফেলে দিয়েছে৷''
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, ‘‘মানববন্ধনের শেষ পর্যায়ে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আমাদের ঘিরে ফেলে৷ পরে আমরা রাজু ভাস্কর্যের দিকে যাওয়ার পথে শিববাড়ি মোড়ে শেখ রাসেল টাওয়ারের সামনে গেলে তারা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় এবং আমাদের লাঞ্ছিত করে৷''
Professor AKM Golam Rabbani - MP3-Stereo
শিক্ষার্থী রাফিয়া তামান্না বলেন, ‘‘তারা প্রথম থেকে আমাদের মানববন্ধনে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে৷ তারা আমাদের শিক্ষকদের জামায়াত-শিবির বলে অপমান করেছে৷ আমরা মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় হামলা চালায়৷ সাংবাদিকরা এগিয়ে এলে তাঁদের ওপরও হামলা করে৷ এসএম হলের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সায়েম সাংবাদিকদের ক্যামেরা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে৷ এবং কয়েকটি মোবাইল ফোন ভেঙে ফেলে৷''
হামলার শিকার চাটার্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্র এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা তুহিন ফারাবি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ছাত্রলীগের চিহ্নিত নতা-কর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এই হামলা চালায়৷ আমাকে প্রতিবাদ সমাবেশ চলাকালে পাশে ডেকে নিয়ে নির্যাতন করা হয়৷ আমাকে ছাত্রলীগ আগেই টার্গেট করে৷ কারণ, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা গ্রেপ্তার ও হামলার শিকার হওয়ার পর আমি প্রকাশ্যে আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলাম৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানি ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন, ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার শহীদ মিনারে কর্মসূচি পালন করতে কেউ আমাদের পূর্বানুমতি নেয়নি৷ ফলে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়৷ আমরা প্রক্টরিয়াল বডি'র চারজন সদস্যকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে তথ্য নিয়েছি৷ তাতে আমাদের মনে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে অশান্ত করার এক ধরনের ইন্ধন আছে৷''
Tuhin Farabi - MP3-Stereo
ড. তানজিম উদ্দিনের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে তাঁর ফোনে কথা হয়েছে৷ একজন সহকর্মী হিসেবে তাঁকে আমি যথেষ্ট সম্মান দিয়ে কথা বলেছি৷ তবে তিনি আমাকে কোনো সহযোগিতা করেননি৷ পরিস্থিতি শান্ত করতে আমি তাঁদের সহযোগিতা পাইনি৷''
প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীরা এখন আর মাঠে নামতে পারছেন না৷ তাঁদের ওপর দফায় দফায় হামলার পর এখন প্রতিবাদ সমাবেশেও হামলা হচ্ছে৷
কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্তত ১৩ জন নেতা এখন কারাগারে আছেন৷ তাঁদের রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে৷ আহতরা কোনো হাসপাতালে চিকিৎসাও পচ্ছেন না৷ আর যাতে তাঁরা রাস্তায় নামতে না পারেন, তার জন্য হুমকি অব্যাহত আছে৷
অনেক পিটুনি, ধরপাকড়ের পর সামান্য অগ্রগতি
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের মারধর ও পুলিশের ধরপাকড়ের শিকার হয়েছেন শিক্ষার্থীরা৷ অবশেষে সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে৷
ছবি: bdnews24.com
আন্দোলনের শুরু
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের জন্য ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু হয়৷ সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০, জেলা ১০, নারী ১০ এবং উপজাতিদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা বরাদ্দ আছে৷ এই ৫৫ শতাংশ কোটায় পূরণযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে এক শতাংশ পদে প্রতিবন্ধী নিয়োগের বিধান রয়েছে৷ এই কোটা ব্যবস্থায় সংস্কার আনার দাবিতে আন্দোলন করছিল শিক্ষার্থীরা৷
ছবি: bdnews24.com
ঢাবি উপাচার্যের বাসা ভাঙচুর
৮ এপ্রিল শাহবাগে শিক্ষার্থীদের পূর্ব নির্ধারিত একটি র্যালি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা প্রদক্ষিণের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘাত শুরু হয়৷ সেই সময় পুলিশ টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে৷ এরপর সারাদিনই ক্যাম্পাসে উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করে৷ পরে রাত একটার দিকে আন্দোলনকারী ছাত্ররা উপাচার্যের বাসভবনে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর করে৷ এছাড়া রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে৷
ছবি: bdnews24.com
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও এতদিন অগ্রগতি হয়নি
আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১১ এপ্রিল সংসদে দেয়া এক ভাষণে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন৷ এ বিষয়ে কাজ করতে তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশনাও দেন৷ কিন্তু তারপর এতদিন অগ্রগতি দেখা যায়নি৷
ছবি: DW
আবার আন্দোলন
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও কোটা বাতিল বা সংস্কারে সরকারের সক্রিয় কোনো কার্যক্রমের দেখা না পেয়ে পরবর্তী করণীয় জানাতে গত শনিবার একটি সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা৷ সেই সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের মারধর করেন বলে অভিযোগ ওঠে৷ এরপর সোমবারও শহিদ মিনার এলাকায় ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন আন্দোলনকারীরা৷
ছবি: bdnews24.com
অভিযোগ অস্বীকার
হামলার জন্য যাদের দায়ী করা হয়, তাদের একজন ঢাবি বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্রলীগ নেতা আল আমিন রহমান৷ মঙ্গলবার তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা হামলা করিনি, আমরা তাদের প্রতিহত করেছি৷ আমরাও কোটা সংস্কারের পক্ষে৷ প্রধানমন্ত্রী সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন৷ কিন্তু জামাত-শিবির, ছাত্রদলের কিছু লোক এই ইস্যু ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল৷ আমরা তা করতে দেইনি৷ আমরা ক্যাম্পাসের শৃঙ্খলা রক্ষা করছি৷’’
ছবি: bdnews24.com
আন্দোলনকারীদের আটক
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানিয়েছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা ফারুক হাসানকে শাহবাগ থানা পুলিশ মঙ্গলবার গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে৷ ‘‘তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা হয়েছে৷ তাঁর সঙ্গে তরিকুল ইসলাম এবং জসিমউদ্দিন নামে আরো দু'জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে,’’ বলে ডয়চে ভেলেকে জানান তিনি৷
ছবি: privat
আটকদের ছেড়ে দেয়ার দাবি
কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্ববায়ক হাসান আল মামুন ডয়চে ভেলেক বলেন, কোটা সংস্কারের জন্য সোমবার যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা আগে করা হলে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হতো না৷ ‘‘আমরা চাই, কোটা সংস্কারে আর দেরি করা হবে না৷ আটকদের ছেড়ে দিতে হবে, আহতদের সরকারি খরচে চিকিৎসা দিতে হবে এবং হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের আইনের আওতায় আনতে হবে,’’ মঙ্গলবার বলেন তিনি৷
ছবি: bdnews24.com
হেনস্তার শিকার শিক্ষক
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদে ‘উদ্বিগ্ন অভিবাবক ও নাগরিক’দের আয়োজনে মঙ্গলবার ঢাকায় প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছিল৷ সেই সময় পুলিশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বাকী বিল্লাহকে ধরে নিয়ে গিয়ে এক ঘণ্টা পর ছেড়ে দেয়৷ একই সময়ে পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহমিদুল হক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক রেহনুমা আহমেদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে৷
ছবি: bdnews24.com
প্রায় তিন মাস পর অগ্রগতির লক্ষণ
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রায় তিন মাস পর সোমবার বিকেলে সরকার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোটা সংস্কারে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে৷ কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে৷