গত কয়েক মাস কিছুটা শান্ত থাকা দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে যেন বাক্যের ঝঞ্ঝনা শুরু হয়েছে৷ কিন্তু তা-তে কোনো পক্ষের লাভ হচ্ছে কি?
বিজ্ঞাপন
তাঁর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন যে, তাঁর দেশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হাত থেকে বাংলাদেশের পরিত্রাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে৷ অপরদিকে পাকিস্তানের চিরকালের অভিযোগ যে, ভারত ঢাকার বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রয়াসকে প্রেরণা এবং মদত দিয়েছিল৷ বিশেষজ্ঞরা এবার বলছেন যে, বাংলাদেশে মোদীর সর্বাধুনিক মন্তব্য পাকিস্তানের অভিযোগকেই আরো জোরদার করেছে – অপরদিকে বাঙালিদের নিজস্ব সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো হয়েছে৷
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বিদেশনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ গত বুধবার সেনেটে বলেন যে, মোদীর মন্তব্য পাকিস্তানের ‘‘ভেঙে যাওয়ায়'' ভারতের সংশ্লিষ্ট থাকার স্বীকৃতি৷ সেনেটে অন্যান্য মন্ত্রীরা পশ্চিমের বালুচিস্তান প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে নতুন দিল্লির সমর্থন ও সাহায্যের কথা বলেন৷
লাহোরের রাজনৈতিক কর্মী ইদ্রিস আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন: ‘‘(মোদীর মন্তব্য) সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়৷ এ কথা বলে তিনি ঢাকার কোনো উপকার করেননি৷ তিনি সম্ভবত বলতে চেয়েছিলেন যে, ভারত বাংলাদেশের সংগ্রামে নৈতিক ও রাজনৈতিক সাহায্য দিয়েছে৷ কিন্তু এর ফলে ইসলামাবাদে যুদ্ধপন্থিরাই উৎসাহ পাবে৷''
বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বৃহস্পতিবার ভারতের একটি সংবাদপত্রকে বলেন: ‘‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী খোলামনে বলেছেন যে, ভারত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে৷ এর অর্থ পাকিস্তানে হস্তক্ষেপ নয়, কেননা বন্ধু প্রতিবেশী হিসেবে ভারত বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, যার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ৷ কাজেই এটি একটি তৃতীয় দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এক দেশের আরেক দেশের প্রতি সমর্থন৷''
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
ওদিকে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার উপমন্ত্রী রাজ্যবর্ধন সিং রাঠোর বুধবার বলে বসেছেন যে, ভারত ‘‘আমাদের বাছাই করা স্থান এবং সময়ে ‘শল্যচিকিৎসা মূলক' আক্রমণ চালাবে'' – যার পটভূমিতে রয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মিয়ানমারে অবস্থানকারী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আন্তঃ-সীমান্ত আক্রমণ৷ ‘‘পশ্চিমে গোলযোগের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যবস্থা নেওয়া হবে,'' রাঠোর সেই সংবাদ সম্মেলনে বলেন৷ প্রশ্নটা ছিল: ভারত পাকিস্তান সীমান্তে অনুরূপ আক্রমণ চালাতে পারে কিনা৷
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াও আসে দ্রুত৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধরি নিসার আলি খান বৃহস্পতিবার বলেন: ‘‘আমাদের সামরিক বাহিনী যে কোনো বিদেশি আগ্রাসনের মোকাবিলা করতে পুরোপুরি সক্ষম এবং ভারতীয় নেতাদের দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করা উচিত৷'' ভারতের পাকিস্তানকে মিয়ানমারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয় – তিনি আরো যোগ করেন৷ পাকিস্তানের সেনাপ্রধান রহিল শরিফও ভারতকে ‘‘পাকিস্তানের ওপর কুনজর'' দেওয়া সম্পর্কে সাবধান করে দেন৷
এই নতুন বাগযুদ্ধ থেকে শুধু উভয় দেশের সামরিক বাহিনী, অস্ত্রশিল্প, উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা লাভবান হবে, বলে ইদ্রিস আহমেদ মনে করেন: ‘‘ভারতীয় রাজনীতিকরা কা-র উপকার করার চেষ্টা করছেন? (পাকিস্তানের) প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বেসামরিক সরকারের নিশ্চয় নয়৷ তাঁরা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হর্তাকর্তা এবং তাঁদের তাঁবেদার ইসলামপন্থিদের দেশে বিদ্বেষ ও যুদ্ধবাজ পরিবেশ সৃষ্টি করার সুযোগ এনে দিচ্ছেন৷''