নানা সমালোচনার মুখে এক মাসের বেশি সময় বিরতির পর আবারও নিয়মিত টহল-তল্লাশিতে মাঠে নেমেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)৷ র্যাব জানিয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই তারা এবার টহল তল্লাশিতে সক্রিয় হচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
গত এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় র্যাব-১১-এর তিন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠার পর চরম সমালোচনার মুখে পড়ে এলিট ফোর্স৷ তিন কর্মকর্তা এরই মধ্যে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন৷ নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর র্যাবের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে৷ অনেকে র্যাব বিলুপ্তির দাবি তোলেন৷ কেউ কেউ র্যাব সংস্কারের কথাও বলেছেন৷
এ অবস্থায় র্যাব গত ২৬শে মে থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে নিয়মিত সড়ক টহল-তল্লাশি বন্ধ করে দেয়৷ তখন র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেসুর রহমান জানিয়েছিলেন, র্যাব তার নির্ধারিত দায়িত্বের বাইরে কোনো কাজ করবে না৷ টহল-তল্লাশি তাদের দায়িত্বের আওতায় পরে না৷'
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
কিন্তু বুধবার র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার হাবিবুর রহমান জানান, সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে র্যাবকে আবারও মাঠে নামতে হয়েছে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে র্যাব আগের মতো নিয়মিত টহল-তল্লাশিতে অংশ নেবে ৷
র্যাব মহাপরিচালক মোখলেসুর বৃহস্পতিবার রহমান বলেন, ‘‘রমজানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে র্যাবকে নিয়মিত টহল-তল্লাশিতে অংশ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ নির্দেশের পর থেকেই রাজধানীসহ সারা দেশে র্যাবের সদস্যরা টহল ও তল্লাশিতে মাঠে নেমেছেন৷''
তবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘র্যাবের ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন৷ প্রয়োজন জবাবদিহিতার আওতায় আনা৷ শুধু নারায়ণগঞ্জের ঘটনা নয়, র্যাবের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আছে তার স্বাধীন তদন্ত প্রয়োজন৷ তদন্তের পর দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া খুবই জরুরি৷'' তিনি আরও বলেন, এ সব করা না হলে র্যাবের বিরুদ্ধে যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা কমবে না৷ সাধারণ মানুষ এই বাহিনীকে গ্রহণ করবে না৷ তিনি মনে করেন, ‘‘এসব না করে র্যাবকে যে আবার পুরো মাত্রায় সক্রিয় করার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তাতে র্যাবের দুষ্কর্ম আরো বাড়বে৷'' তিনি বলেন, ‘‘মনে হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের ঘটনা ছাড়া অন্য যে সব ঘটনায় র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তার আর তদন্ত হবে না৷''
এদিকে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার'-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গত ছয় মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে ১০৮ জন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গড়ে প্রতি মাসে ১৮ জন এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷
তাদের মধ্যে ৩৯ জন পুলিশের হাতে, ১৪ জন র্যাবের হাতে এবং যৌথ বাহিনীর হাতে ৮ জন নিহত হন৷ অধিকার বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সব কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা এবং দায়মুক্তি রোধে সরকারকে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে৷