তুরস্কের সেন্ট্রাল ব্যাংক বৃহস্পতিবার সুদের হার ১৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৩ শতাংশ করেছে। সেন্ট্রাল ব্যাংকের যুক্তি, ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি কমেছে বলে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মার্কিন ডলারের তুলনায় তুরস্কের লিরার দাম সমানে কমছে। গত ১২ মাসে দাম কমে অর্ধেক হয়েছে। গত পাঁচ বছরের হিসাব ধরলে লিরার দাম ডলারের তুলনায় ছয়গুণ কমেছে।
তবে তুরস্কের মানুষ অনেক বেশি চিন্তিত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে। এখন মুদ্রাস্ফীতির হার হলো ৮০ শতাংশ। এই বছরের শেষে তা আরো বাড়তে পারে।
এর্দোয়ানের সিদ্ধান্ত
প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ানের নির্দেশে তুরস্ক এইভাবে সুদের হার কমাচ্ছে। এর্দোয়ান বিশ্বাস করেন, সুদের হার কমালে মুদ্রাস্ফীতি কমে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিবিদদের ধারণা একেবারেই উল্টো। তারা মনে করেন, এরকম পরিস্থিতিতে সুদের হার কমালে তা মুদ্রাস্ফীতি আরো বাড়িয়ে দেবে।
যেভাবে তুরস্কের অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে চান এর্দোয়ান
১৯ বছর ধরে ক্ষমতায় এর্দোয়ান৷ তবে আগের ১৮ বছরে এত সংকট দেখেনি তুরস্ক৷ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১১ বছর, তারপর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৮ বছর পার করা এর্দোয়ান অবশ্য সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছেন৷ ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: Dilara Senkaya/REUTERS
যে কারণে সংকট
করোনাকালে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই সংকটে পড়েছে৷ সেই সংকট কাটিয়ে উঠছে অনেক দেশ৷ তুরস্কও বেশ সামলে নিচ্ছিলো৷ কিন্তু গত বছর ব্যাংকে সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত নিলেন এর্দোয়ান৷ অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত তুরস্কের অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করেছে৷ গত দু বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিনজন গভর্নরকে সরিয়েছেন এর্দোয়ান৷ তিনজনই ছিলেন সুদের হার কমানোর বিপক্ষে৷
ছবি: DW/U. Danisman
মুদ্রাস্ফীতি
ইতিমধ্যে তুরস্কে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে৷ ডলারের তুলনায় তুর্কি লিরার দাম অতি নিম্নগামী৷ ২০২১-এর শেষ দিকে লিরার দাম ৪৪ শতাংশ কমে যায়৷
ছবি: Getty Images/C. McGrath
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং ওষুধের দাম বাড়ছে দ্রুত৷ মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় ৩৭ শতাংশ৷ গত ২০ বছরে আর কখনো মূল্যস্ফীতি এ পর্যায়ে যায়নি৷ বিশ্বের অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদের হার বাড়ানো হয়৷ তাতে মানুষের ঋণ নেয়ার প্রবনতা কমে, হাতে টাকা কমে যায় আর টাকা কম থাকলে কেউ কম প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে চায় না৷ এর ফলে অনেক পণ্যের দাম কমে যায়৷ এর্দোয়ান সুদের হার কমানোয় উলটো ফল হয়েছে৷
ছবি: DW
আমদানি-ব্যয় বৃদ্ধি
তুরস্কের অর্থনীতি প্রধানত আমদানিনির্ভর৷ কিন্তু ডলারের বিপরীতে তুর্কি লিরার দাম কমে যাওয়ায় অনেক পণ্যের আমদানি-ব্যয় বেড়ে গেছে৷ তাতে স্থানীয় বাজারেও বেড়েছে পণ্যের দাম৷ অনেক পণ্যের দামই এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে৷
ছবি: Tolga Ildun/ZUMA/picture alliance
এর্দোয়ানের যুক্তি
ক্ষমতায় আসার পর থেকে এর্দোয়ান বিভিন্ন সময় সুদের হার কমিয়ে মূলত শিল্পপতিদের ঋণ নেয়ায় উৎসাহিত করেছেন৷ এর ফলে অতীতে শিল্পের বিকাশ হয়েছে, প্রবৃদ্ধিও এসেছে৷ এর্দোয়ান মনে করেন, সুদের হার কমালে সাধারণ মানুষও ঋণ নেবে, সেই ঋণের টাকায় তারা খাবার এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনবে, তাতে বাজার চাঙা থাকবে, কর্ম সংস্থান বাড়বে৷ কিন্তু করোনাকালে নানাভাবে ভুগতে থাকা মানুষের জীবনে এমন পরিবর্তন এখনো দেখা যায়নি৷
ছবি: Irina Yakovleva/ITAR-TASS/imago images
দানা বাঁধছে ক্ষোভ
অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত মানুষেরা ইতিমধ্যে ছোট ছোট মিছিলে বিক্ষোভ জানাতে শুরু করেছে৷ নার্স, খাবার সরবরাহকারীসহ অনেক পেশার মানুষ শরিক হচ্ছেন সেই মিছিলে৷
ছবি: Dilara Senkaya/REUTERS
এর্দোয়ান সরকারের আশা
তবে প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান এবং অর্থমন্ত্রী নুরেদ্দিন নেবাতি মনে করেন, জনগণ আর কয়েকটা মাস ধৈর্য ধরলেই সংকট কেটে যাবে৷ ধারণা করা হচ্ছে, লিরার দরপতন রুখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিসেম্বরে ২০ বিলিয়ন ডলার এবং জানুয়ারিতে ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে৷ তাছাড়া আগামী মে নাগাদ তুরস্কে পর্যটকদের ভিড় আবার হয়ত বাড়বে৷ এর্দোয়ানের তাই আশা- সংকট কাটিয়ে উঠতে আর বেশি সময় লাগবে না৷
ছবি: Dilara Senkaya/REUTERS
সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ
অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা-না-ওঠার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে এর্দোয়ানের ভবিষ্যৎ৷ ২০২৩ সালে আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন৷ দেশের অর্থনীতির প্রভাব তো নির্বাচনে পড়তেই পারে!
ছবি: Sertac Kayar/REUTERS
8 ছবি1 | 8
কিন্তু এর্দোয়ান নিজের অভিমত থেকে সরে আসতে রাজি নন। তিনি সেন্ট্রাল ব্যাংককে তার নীতি অনুসরণ করার জন্য জোরাজুরি করেন। ২০১৯-এর পর থেকে সেন্ট্রাল ব্যাংকের তিনজন প্রধানকে তিনি বদল করেছেন। আগামী বছর জুনে নির্বাচন। এর্দোয়ান এর আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, দ্রুত আর্থিক উন্নয়ন করবেন।
গত বছর সেন্ট্রাল ব্যাংক একাধিকবার বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে সুদের হার কমিয়েছে। তার প্রভাব মুদ্রাস্ফীতি ও লিরার দামে পড়েছে।
নরওয়ে সুদের হার বাড়িয়েছে
বৃহস্পতিবারই নরওয়ে সুদের হার কমিয়ে মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছে।
অর্থনীতির ধাক্কায় বিপর্যস্ত কিছু দেশ
করোনা মহামারির ধাক্কা, ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে বিশ্বজুড়ে নানা দেশেই চলছে অর্থনৈতিক অস্থিরতা৷ শ্রীলঙ্কায় তা রূপ নিয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতায়৷ এমন আরো কিছু দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Ali Khara/REUTERS
আফগানিস্তান
গত বছর মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার এবং তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে আফগানিস্তান৷ দেশজুড়ে খাদ্য সংকটের ফলে অপুষ্টি মহামারি আকার নিয়েছে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, দেশটির ৫৫ শতাংশ মানুষ রয়েছেন খাদ্য নিরাপত্তার চরম হুমকিতে৷ দাতাদের নানা ধরনের অর্থ সহায়তা অবরুদ্ধ হওয়ায় এ সংকট দিনদিন আরো তীব্র রূপ নিচ্ছে৷
ছবি: Ali Khara/REUTERS
ভেনেজুয়েলা
ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক সংকট কয়েক দশক ধরেই চলমান৷ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি- ডাব্লিউএফপি-র মতে দেশটিতে প্রতি তিন জনে একজন ভুগছেন খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে৷ করোনার কারণে অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট আরো তীব্র হয়েছে৷ ইউক্রেন যুদ্ধ বাড়িয়ে দিয়েছে জ্বালানি ও খাদ্য সংকট৷ এর ফলে বিদ্যুৎ এবং সুপেয় জলের অভাবও দেখা দিয়েছে৷
ছবি: Roman Camacho/ZUMA Press/imago images
মধ্যপ্রাচ্য
মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু দেশে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে৷ এমনিতেই দেশগুলোর অর্থনীতি টালমাটাল৷ করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ এসব দেশকে নিয়ে যাচ্ছে বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে৷ সংকটে থাকা দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ও ইয়েমেন ছাড়াও রয়েছে লিবিয়া, ইরাক এবং লেবাননও৷ ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট দেশগুলোর নাগরিকদের ঠেলে দিচ্ছে চরম দারিদ্র্যের দিকে৷
ছবি: Essa Ahmed/AFP/Getty Images
সুদান
গত বছরের শেষ দিকে আফ্রিকার এই দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান হয়৷ এরপর থেকেই ধস নেমেছে দেশটির অর্থনীতিতে ৷ জানুয়ারিতে দেশটির রপ্তানি কমে যায় ৮৫ শতাংশ৷ জাতিসংঘের তথ্য বলছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশ্বজুড়ে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে দেশটির ৩০ শতাংশের বেশি মানুষ আছেন খাদ্য সংকটে৷ দেশটির ১৮টি প্রদেশে দেড় কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছেন৷
ছবি: Ashraf Shazly/AFP/Getty Images
নেপাল
ব্যাপক আমদানি-নির্ভরতার ফলে নেপালের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে৷ দেশটির বাণিজ্য ঘাটতি বাজেটের প্রায় সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ নেপালের মোট আমদানির দুই-তৃতীয়াংশই আসে ভারত থেকে৷ অন্যদিকে, ভারতের মুদ্রার সঙ্গে একই দর নির্ধারিত থাকায় ভারতীয় টাকার পতনের সঙ্গে নেপালি মুদ্রারও স্বয়ংক্রিয় পতন ঘটছে৷ ইউক্রেন থেকে তেল ও নানা খাদ্যদ্রব্যের আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশটির অর্থনীতিতে ধসের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Diego Azubel/dpa/picture alliance
পাকিস্তান
বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যমতে, মে-জুন মাসের মূল্যস্ফীতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কার পরই রয়েছে পাকিস্তান৷ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি এক অংকের ঘরে থাকলেও শ্রীলঙ্কায় ৫৬.৬% এবং পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি পৌঁছে গেছে ২১.৩ শতাংশে৷ বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়ে জটিলতা এবং দ্রুত খালি হয়ে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ দেশটিকে দ্রুতই অস্থিরতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: KARIM ULLAH AFP via Getty Images
তুরস্ক
তুরস্কের পরিসংখ্যান সংস্থা জানিয়েছে, জুন মাসে দেশটির বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭৮.৬২%৷ দেশটির মূল্যস্ফীতির এ হার গত ২৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ ইউক্রেন যুদ্ধ, পণ্য়ের মূল্যবৃদ্ধি এবং টার্কিশ মুদ্রা লিরার দর কমতে থাকায় এই মূল্যস্ফীতি আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ দেশটির সরকারি তথ্য অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় এ বছর পরিবহণের খরচ বেড়েছে ১২৩.৩৭ শতাংশ, খাদ্য ও পানীয়ের মূল্য বেড়েছে ৯৩,৯৩ শতাংশ৷
ছবি: Sha Dati/Xinhua/imago images
7 ছবি1 | 7
নরওয়ের সেন্ট্রাল ব্যাংক বেস রেট শূন্য দশমিক পাঁচ থেকে বাড়িয়ে এক দশমিক সাতপাঁচ করেছে।
গত বুধবার নিউজিল্যান্ডও সুদের হার বাড়িয়েছে। ২০০৮-এর পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলিতে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল খুবই কম। বছরের পর বছর তারা এই অবস্থা ধরে রাখতে পেরেছিল।
কিন্তু প্রথমে করোনা ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত পরিস্থিতি পুরো বদলে দিয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে চলেছে। এরপর অ্যামেরিকা, ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেনের সেন্ট্রাল ব্যাংক ও ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়েছে।