আবেগের রসে আপ্লুত বাঙালি
১৬ নভেম্বর ২০১৭কোনো উৎপাদিত পণ্য মূলত যে অঞ্চলের, জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন, অর্থাৎ ভৌগোলিক অবস্থান সূচক দিয়ে তাকে চিহ্নিত করা হয়৷ এর আগে এই জিআই ট্যাগিং হয়েছে দার্জিলিংয়ের চা, জয়নগরের মোয়া, বর্ধমানের সীতাভোগ আর মিহিদানার ক্ষেত্রে৷ কিন্তু সমস্যা হয়েছিল রসগোল্লার জিআই ট্যাগিংয়ের আবেদন করতে গিয়ে৷ বাংলার পাশের রাজ্য ওড়িশা দাবি করে বসেছিল, রসগোলার সত্ত্ব আসলে তাদের৷ কলকাতা শহরে ১৮৬৮ সালে বাগবাজারের জনৈক ময়রা নবীন চন্দ্র দাশ নতুন ধরনের মিষ্টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে প্রথম রসগোল্লা তৈরি করে ফেলেন বলে কথিত৷ যদিও সে নিয়েও খাদ্য-বিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে৷ কেউ কেউ বলেন, কলকাতার আগে হুগলিতে ময়রারা আগেই রসগোল্লা তৈরি করে ফেলেছিলেন৷ যেহেতু বাংলায়, তথা ভারতে দুধ থেকে কাটানো ছানা প্রথম ঢুকেছিল হুগলি দিয়েই, পর্তুগিজ নাবিকদের হাত ধরে৷ পর্তুগিজরাই প্রথম ছানা আমদানি করেন এখানে, তারপর ওলন্দাজ, অর্থাৎ ডাচ এবং ফরাসি ব্যবসায়ীরা৷
কিন্তু বাদ সাধে প্রতিবেশী ওড়িশা৷ তারা দাবি করে, ১৮ শতকের অন্তত ৬০০ বছর আগে, পুরীতে জগন্নাথ মন্দির তৈরি হওয়ার সময় থেকেই দেবতার ভোগে তাদের ‘পাহালা রসগোল্লা' ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়৷ এবং এই মিষ্টির যে উৎস, ‘ক্ষীরমোহন' নামক সেই মিষ্টির উল্লেখ আছে জগন্নাথদেবের কাহিনিতেই, যা সহস্রাব্দ প্রাচীন৷ তাই রসগোল্লার জিআই ট্যাগের আসল হকদার ওড়িশাই৷ এই যুক্তির প্রতিবাদে বাঙালি গবেষক হরিপদ ভৌমিক প্রাচীন ধর্মীয় আচারের ইতিহাস খুঁজে তথ্য দেন, ছানা যেহেতু দুধ ‘ছিন্ন' করে, অর্থাৎ দুধ কাটিয়ে, এক অর্থে দুধকে নষ্ট করে তৈরি হয়, সেই নষ্ট উপাদান দিয়ে তৈরি মিষ্টান্ন দেবতাকে উৎসর্গ করা হতো না৷ এ বহু বছরের প্রথা৷ এমনকি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরেও ছানার প্রবেশ অনেক পরে, সেও দেবতার নৈবেদ্য নয়, রাজভোগ হিসেবে৷ সুতরাং ওড়িশার দাবি ধোপে টেকে না৷
প্রায় আড়াই বছর এই নিয়ে আইনি বিতর্কের পর অবশেষে দক্ষিণ ভারতের চেন্নাইয়ে অবস্থিত জিআই ট্যাগিং বিষয়ক সংস্থাটি বাংলার পক্ষেই রায় দিল৷ যদিও এই রায় সম্পর্কে জনমানসে একটা বিভ্রান্তিও সম্ভবত আছে, রসগোল্লা নিয়ে আবেগের উচ্ছ্বাসে যে ভুলটা কেউ ধরিয়ে দিচ্ছে না৷ জিআই ট্যাগ পাওয়া গিয়েছে বাঙালি রসগোল্লার, সামগ্রিকভাবে রসগোল্লার নয়৷ অর্থাৎ বাংলায় তৈরি যে রসগোল্লা৷ সেটাই স্বাভাবিক৷ যে কারণে প্রথম দফার হারের পর অপ্রস্তুত ওড়িশা এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাদের নিজস্ব যে রসগোল্লা, সেই ‘ওড়িশারা রসগোল্লা'-র জিআই ট্যাগিংয়ের জন্য আর্জি জানাতে৷ সেটাও খুবই স্বাভাবিক৷ ওড়িশায় তৈরি রসগোল্লা তো ওড়িশার রসগোল্লা হিসেবেই স্বীকৃতি পাবে, যেমন বাংলার রসগোল্লা বাংলার! তা হলে বিরোধটা আদতে কী নিয়ে ছিল? কেউ বোধহয় জানেন না৷ আপাতত আবেগে ভেসে বাঙালিরা একে অপরকে মিষ্টিমুখ করাতে ব্যস্ত৷ অবশ্যই রসগোল্লা দিয়ে৷
তবে উৎপাদিত পণ্যের জিআই ট্যাগিং সেই বিশেষ পণ্যটির বাণিজ্যিক বিপণনে সুবিধে করে দেয়৷ রসগোল্লার জিআই ট্যাগ সেই সুবিধে দেবে কি? ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে প্রশ্নটা সরাসরি করা হয়েছিল রসগোল্লার আবিষ্কারক বলে খ্যাত নবীন দাসের উত্তরসূরি, তাঁর প্রপৌত্র সঞ্জয় দাশকে৷ তিনি বললেন, আলাদা করে কোনো সুবিধে পাওয়ার কথা নয়, কারণ এ তো সবারই জানা কথা৷ সেই জানা কথাটাই এবার স্বীকৃতি পেল৷ যে কারণে তাঁদের পরিবারের সবাই খুব খুশি৷ ওঁরা বিশেষ করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে৷ মূলত তাঁর উদ্যোগে বিষয়টার এত তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হলো বলে ওঁরা কৃতজ্ঞ৷
আর যাদের রসগোল্লা শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত নয়, সারা বিশ্বেই বিখ্যাত, অ্যামেরিকা, ইউরোপের একাধিক দেশে যাদের রসগোল্লা নিয়মিত রপ্তানি হয়ে আসছে বহু বছর ধরে, সেই কে সি দাস প্রতিষ্ঠানের নবীন কর্ণধার ধীমান দাশ ডয়চে ভেলেকে জানালেন, এই জিআই ট্যাগিং তাঁদের রসগোল্লার বিপণনের ক্ষেত্রে অন্তত দরকার নেই৷ কারণ কে সি দাশের রসগোল্লা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত৷ যে প্রতিষ্ঠান নতুন করে রসগোল্লা রপ্তানির পরিকল্পনা করছে, তাদের ক্ষেত্রে এটা প্রয়োজন হতে পারে৷ যদিও রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের অনুরোধ করা হয়েছে এই জিআই ট্যাগ ব্যবহার করার জন্য৷ তাঁরা ভেবে দেখছেন, কী করা যেতে পারে৷
আপনার কি মনে হয় রসগোল্লা পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছে? আপনার উত্তর লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷