আমদানি শুল্ক কমিয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর পরামর্শ
১০ নভেম্বর ২০২৩যেসব পণ্যের দাম বাড়তেই থাকে, সেগুলো আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও কখনো কখনো কমতে শুরু করে দাম৷ তবে এভাবে বাজার সাময়িকভাবে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙা যায়নি, তাই সংকটের স্থায়ী সমাধানের আশাও জাগেনি৷
এমন পরিস্থিতিতে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরির পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা৷ তারা বলছেন, শুল্কহার কমিয়ে আমদানির ক্ষেত্র বাড়াতে হবে৷ মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানতেও পদক্ষেপ নিতে হবে৷
ঘাটতি থাকায় প্রতি বছরই পেঁয়াজ আমদানি করে বাংলাদেশ৷ ভারত থেকে সবথেকে বেশি পেঁয়াজ আসে৷ ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বা নতুন করে রপ্তানি শুল্ক বসালে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়৷
বছরজুড়েই ডিমের দাম আকাশছোঁয়া৷ কোল্ডস্টোরেজে আলু থাকার পরেও তা বাজারে না ছেড়ে দাম বাড়িয়েছেন- এমন অভিযোগ রয়েছে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে৷ দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকায় ডিম ও আলু আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার৷ আমদানির ডিম ও আলু বাজারে আসার পর বাজারে এসবের দাম কিছুটা কমেছে৷
বেআইনিভাবে খাদ্যদ্রব্য মজুত করলে বা মজুত সংক্রান্ত সরকারের নির্দেশনা না মানলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে এ বছর ‘খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহণ, সরবরাহ, বিতরণ (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন' করেছে সরকার৷ তবে ওই আইনের তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না৷
সাপ্লাইচেইন ঠিক রাখতে আমদানি করা হয় - এমন দাবি করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পণ্য আমদানি হলে বাজারে তার প্রভাব পড়ে৷ যারা সুযোগ নেয়, আমদানি করলে তারা চাপে পড়ে৷ কখনো কখনো কৃষিপণ্যের দাম বাড়লে সেগুলো আমদানির সিদ্ধান্ত নেই৷''
‘‘কৃষিপণ্যের দামের বিষয়ে লক্ষ্য রাখা হয়, যাতে কৃষকদের ক্ষতি না হয়৷ এজন্য কৃষিপণ্য আমাদানির আগে একটু অপেক্ষা করি৷ যখন দেখি সম্ভব হচ্ছে না, তখন আমাদানির সিদ্ধান্ত হয়৷ আমদানির ক্ষেত্রে আইনগত বিধিনিষেধ আছে৷ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইচ্ছা করলেই কৃষিজাত পণ্য আমদানি করতে পারে না৷ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়৷ কৃষি মন্ত্রণালয় অনেক সময় দেখে কৃষকদের ক্ষতি হবে কিনা৷”
আমদানি শুল্ক কমানোর এখতিয়ারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে- এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আলু, ডিম আমদানি হচ্ছে৷ পেঁয়াজ আমদানি উন্মুক্ত করা আছে কিন্তু গ্লোবাল মার্কেটে পেঁয়াজের দাম বেশি, আমাদের ওপরও তার প্রভাব আছে৷ মোটামুটি প্রয়োজনীয় যেগুলো, সেগুলোর আমদানি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে৷’’
ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘যখন কেউ চান্স নিতে চায়, যার যার মতো করে সুযোগটা নেয়৷ সেটাকে হয়ত সিন্ডিকেট বলা হয়, যখন দাম পায়৷ দেখা যায়, আলু ফেলে দিচ্ছে রাস্তায়, দুধের দাম পাচ্ছে না বলে দুধ ফেলে দিচ্ছে, সেটা তো কোনো সিন্ডিকেট না; যার যার মতো করে ফেলে দিচ্ছে৷ আমরা কি তখন বলি তারা সিন্ডিকেট করে আলু ফেলে দিচ্ছে? ব্যবসায়ীরা যারা সুযোগ নিতে চায়, তারা নেয়৷ তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে কেউ যাতে সিন্ডিকেট করতে না পারে৷''
আমদানি-রপ্তানির চিত্র
সরকারি গুদামে বর্তমানে ১৫ লাখ ৯৬ হাজার ৮৩৯ মেট্রিক টন চাল ও গম মজুদ আছে৷ এর মধ্যে ১৫ লাখ ৯৬ হাজার ১৬৫ টন চাল ও ৬৭৪ টন গম৷ গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ওএমএস, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, টিআর, কাবিখারসহ সরকারি কর্মসূচিগুলোতে ১০ লাখ ২৯ হাজার ৫৯৫ মেট্রিক টন চাল ও গম বিতরণ করা হয়েছে৷ সরকারি গুদামে এখন ২২ লাখ ৭২ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুদের সক্ষমতা রয়েছে৷
২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৩৮১ দশমিক ৪৫ লাখ টন চাল ও ১০ দশমিক ৮৬ লাখ টন গম উৎপাদন হয়৷ আর ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৪১৫ দশমিক ৬৯ লাখ টন চাল ও ১১ দশমিক ৬০ টন গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর দেশে ৬৯ হাজার ৪৯৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ কম৷ আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫২ হাজার ৩৪০ মিলয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ, যা তার আগের অর্থবছরের থেকে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি৷
কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মহামন্দায় ডলার সংকটে আমদানি ব্যয় কমিয়েছে বাংলাদেশ৷ এর ফলে যেসব পণ্য কম আমদানি হয়েছে সেগুলোর দাম বেড়ে গেছে৷
২০২২-২৩ অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের থেকে ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ কম দুধ ও গুড়া দুধ আমদানি হয়েছে৷ বাজারে সব ধরনের দুধের দাম এখন সবথেকে বেশি৷ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ দশমিক ০৩ শতাংশ কম গম আমদানি হওয়ায় বাজারে আটা ও ময়দার দাম এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি৷
উত্তরণের পথ কী?
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর গবেষণা পরিচালক সায়েমা হক বিদিশা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মূল্যস্ফিতির কারণ হচ্ছে, যে পণ্যগুলো আমদানি করতে হয়, সেগুলোর সঙ্গে পরিবহণ ব্যবস্থার জন্য মূল্যমান নির্ভর করবে৷ ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়ায় আমদানিতে মূল্যমানের জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়৷ দেশের বাজারে কিছু পণ্য রয়েছে, কোনো কারণে সরবরাহ কমে গেলে বা চাহিদা বেড়ে গেলে বাজারে মূল্য বেড়ে যায়৷’’
সরবরাহ-ব্যবস্থা অনেক সময় প্রতিযোগিতামূলকভাবে কাজ করে না- এমন মত প্রকাশকরে বিদিশা বলেন, ‘‘এর কারণে মূল্যস্ফীতি হলে তা ব্যাখ্যার বাইরে থেকে যায়, দেশে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থায় চলে এসেছে৷ সরবরাহ ব্যবস্থায় কৃষক ও ক্রেতার মধ্যে যত বেশি মানুষ থাকবে, তত বেশি তারা সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে৷ ক্রেতা-বিক্রেতাকে যত কাছাকাছি আনা যাবে, সরবরাহ-ব্যবস্থা তত স্মুথ হবে৷''
‘‘অনেকে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন৷ অনেক সময় দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেয়৷ বাজার-ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করলে এগুলো হওয়ার কথা ছিল না৷ বাজার ব্যবস্থাপনাকে খুব শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার৷ বাজারে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থাকে যারা বিঘ্নিত করছে, তাদেরকে শক্তভাবে নজরদারি এবং শাস্তির মধ্যে আনতে হবে৷ চাঁদাবাজিসহ ব্যবসার কিছু অনাকাঙ্খিত খরচ থাকে৷ এই জায়গাগুলো কমাতে হবে৷ আমদানি শুল্ক কমাতে পারলে সেটাও গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে পারে৷’’
ক্যাব-এর সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘‘ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো, বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ বাংলাদেশে প্রতিযোগিতার পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রে নেই৷ নানাভাবে আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে৷ বাংলাদেশে শুল্কহার প্রতিবেশী যেকোনো দেশের থেকে অনেক বেশি এবং অনেক পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ৷ এতে অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর সুযোগ পায়৷ যদি শুল্কহার সহনীয় পর্যায়ে থাকে আর আমদানির পথটা অবাধ থাকে, তাহলে কিন্তু বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ে৷''
গোলাম রহমান জানান, করোনা শুরুর আগে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান ড. জায়েদি সাত্তারের একটা গবেষণায় বলা হয়েছে, আমদানি নিষিদ্ধের কারণে বা উচ্চ শুল্কের কারণে এক বছরে বাংলাদেশের ভোক্তাদের ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে৷
‘‘দেশে মজুত আইন আছে, এটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করলে কেউ মজুত করে সংকট সৃষ্টি করতে পারবে না৷ ওই আইন প্রয়োগ করে ব্যবসায়ীকে তাদের অপকর্মের জন্য দ্রুত শাস্তির আওতায় আনার নজির খুব বেশি নেই৷ বাজার অভিযান করে মাঝেমাঝে কিছু জরিমানা করা হয়৷ কিন্তু বড় বড় ব্যবসায়ীরা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি৷’’
গোলাম রহমান বলেন, বাংলাদেশে মূদ্রাস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে৷ পণ্যের অভাবে কিন্তু এটা হয়নি৷ পৃথিবীর সব দেশ মূদ্রাস্ফীতির লাগাম টানতে সফল হয়েছে৷ তারা মুদ্রানীতি, সুদনীতি, রাজস্ব নীতি, সরকারের আয়-ব্যয় নীতি ব্যবহার করে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনেছে৷ এক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখনও বড় ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি৷